শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

কৃষকের স্বপ্নের জাদুঘর

শাইখ সিরাজ

কৃষকের স্বপ্নের জাদুঘর

গত নয় বছর ধরে নিভৃতপল্লীর কল্যাণমুখী একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম লক্ষ্য করছি। প্রতিদিনই কিছু না কিছু যুক্ত হচ্ছে সেখানে। সবুজে আচ্ছাদিত হচ্ছে এর চারপাশ। ভিতরে যুক্ত হচ্ছে কৃষির নানা উপকরণ। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, ত্যাগ আর স্বপ্নের ভিতর দিয়ে সেই প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিচ্ছেন শাহ আলম জাহাঙ্গীর নামের এক স্বপ্নচারী মানুষ। বলছিলাম নওগাঁর মান্দা উপজেলার কালিগ্রামের ‘শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও জাদুঘর’-এর কথা। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ২০০৯ সালেই প্রথম গিয়েছিলাম এ উদ্যোগটি দেখতে। এখন এর পরিসর বেড়েছে আরও অনেকখানি। এর সঙ্গে বাণিজ্যিক কোনো সম্পর্ক নেই। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের সহকারী শিক্ষক শাহ জাহাঙ্গীর কাজ করে চলেছেন নিজের মতো করে হৃদয়ের টানে। যখন যেখান থেকে যে সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন তা ঢালছেন কৃষকের এই প্রতিষ্ঠানের পেছনে। এখানে এসে স্বপ্ন দেখতে পারেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। যারা সারা দিন মাটি আর ফসলের সঙ্গে থাকেন তাদের যেমন আশ্রয়স্থল এটি, একইভাবে এই কালিগ্রাম ও আশপাশ এলাকার শিশুরা এখানে কৃষি আর মাটির ভালোবাসায় সিক্ত হয়। এখানে যুক্ত হয়েছে কৃষকের শিশু সন্তানদের জন্য অন্যরকম এক পাঠশালার। সেখান থেকেই অক্ষরজ্ঞান ও প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ নিচ্ছে অনেক শিশু।

মাটিতে মাদুর পেতে সারি বেঁধে পড়ছে কৃষকের সন্তানরা। এমন আনন্দের পাঠশালা এই যুগে আর পাওয়া যায় না। মাটির ঘর, মাটির বারান্দা। সেখানে গভীর মনোযোগে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ। এই শিশুরা সবাই গড়ে উঠছে মাটির মমতায়। কথা হলো সেই পাঠশালার শিক্ষক আবদুল করীম প্রামাণিকের সঙ্গে। জানালেন শিশুদের সঙ্গে কাটানো নিবিড় এই সময় তার জীবনের সমৃদ্ধতম অধ্যায়।

পাঠশালার খোলা শ্রেণিকক্ষের দেয়ালে রয়েছে ফসলি পঞ্জিকা। রয়েছে নানা তথ্যের সমাবেশ। শুধু শিশুরাই নয়, এ থেকে সমৃদ্ধ হচ্ছে কৃষকও। পুরো বাড়িটাই গ্রামীণ আর কৃষি উপকরণে ঠাসা। বাড়ির সব অংশেই জাদুঘর। আবহমান বাংলার ব্যবহৃত নানা সামগ্রীর দেখা মেলে এখানে। শাহ আলম জাহাঙ্গীরের এই কর্মকাণ্ড দেখে দারুণ অভিভূত হয়েছি। জাদুঘরে রয়েছে সেমিনার কক্ষ। সেখানে কৃষকদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়।

কী নেই শাহ জাহাঙ্গীরের জাদুঘরে? মাথার ওপরে টাঙানো সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন মডেলের মাথালের সারি। কৃষিকাজের নানা উপকরণ দড়ি পাকানোর ঢ্যারা, ঢেঁকি, আম পাড়ার জালি, লাঙল-জোয়াল, গরুর গাড়ির ছই, সেচের জোত, মাছ ধরার চাঁই সবই আছে। আছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ঢঙের কৃষি উপকরণ। পাঠাগারে রয়েছে কৃষকের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও চাষবাসের জন্য থরে থরে সাজানো দুর্লভ সব বই। জাহাঙ্গীর আলম শাহের পৈতৃক মাটির বাড়িটি আজ কৃষি জাদুঘর।

সেমিনার কক্ষে দেখলাম কয়েকজন কৃষক বসে অবাক দৃষ্টিতে ভিডিও দেখছেন। এটি শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগারের প্রতিদিনের চিত্র। প্রতিদিনই দূর-দূরান্তের কৃষক আসেন নতুন কিছু জানতে। এক রকম কৌতূহল থেকেই আসেন তারা। কেউ আসেন নিজেদের প্রয়োজনে। সেখানে রয়েছে দেশ-বিদেশের কৃষি নিয়ে নানা প্রামাণ্যচিত্রের ডিভিডি। দেখলাম ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এ বিভিন্ন পর্বের ডিভিডি রাখা আছে। সন্ধ্যার পর বড় পর্দায় সেগুলো দেখানো হয় কৃষকদের।

আমার মনে পড়ছে ফিলিপিন্সের লস ব্যানোসে অবস্থিত আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের রাইস মিউজিয়ামের কথা। ১৪ বছর আগে অর্থাৎ ২০০৪ সালে গিয়ে মিউজিয়ামটি ঘুরে দেখেছিলাম। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা ওই সংগ্রহশালা গড়ে তোলাটা কঠিন কিছু নয়। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামে এই বিরল আর দুর্লভ উপকরণের এমন সংগ্রহশালা গড়ে তোলার কাজটি অনেক বড়।

২০০৮ সালের ১৮ এপ্রিল তারিখে যাত্রা করে এই কৃষি তথ্য পাঠাগার। মাত্র নয় বছরে শাহ জাহাঙ্গীর স্বপ্নের এই প্রতিষ্ঠানকে যেখানে নিয়ে গেছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। মৌলিক ও সৃজনশীল কাজের মতো করে দিনে দিনে বাড়িয়ে চলেছেন এর পরিধি ও কার্যক্রম। ইতিমধ্যে এই আলোকিত ক্ষেত্রের তথ্যগুলো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে দেশে-বিদেশে। শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগারের একটি ওয়েবসাইটও তৈরি করেছেন শাহ জাহাঙ্গীর। সেখান থেকে তথ্য পেয়ে গবেষণার জন্যও অনেকে আসেন এখানে। সেসব গবেষক ও অতিথিদের জন্যও এখানে রয়েছে দারুণ ব্যবস্থা।

শুরুতেই বলেছি, শাহ জাহাঙ্গীর একজন স্বপ্নচারী মানুষ। সচ্ছল কৃষক পরিবারের সন্তান। তার বাপ-দাদার কৃষি-ঐতিহ্য রক্ষার তাগিদ থেকে পাঠাগার গড়ার এই কাজে হাত দিলেও এর পরিধি এখন পৌঁছে গেছে বহুদূর। কৃষির সব বিষয় নিয়েই তিনি ভাবছেন ও কিছু করার চেষ্টা করছেন। জৈব বালাই দমন ব্যবস্থা নিয়েও তিনি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালু রেখেছেন।

শাহ জাহাঙ্গীর জানালেন, আমেরিকার বেক্স স্টার করপোরেশনের পরিচালক ও কিডনি বিশেষজ্ঞ স্টিভেন গেস্ট ২০০৯ সালে এই জাদুঘর পরিদর্শন করেছেন। এই জাদুঘর ঘুরে দেখেছেন জাপানি ডাক্তার কাতাসু হিরো ইয়ামসিতা ও তার স্ত্রী সেইকো ইয়ামসিতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. মল্লিকা ব্যানার্জি। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আগাছাবিজ্ঞানী স্টেভ অ্যাডকিন্স এখানে এসে বিষাক্ত আগাছা পার্থেনিয়াম বিষয়ে কৃষকদের নিয়ে একটি সেমিনার করেন। এ ছাড়া জাপান, ভারত, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অতিথিরা এসে এ কাজকে একটি চমৎকার উদ্যোগ বলে উল্লেখ করে গেছেন জাদুঘরের পরিদর্শন বইতে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা আসেন প্রতিনিয়ত।

বাংলাদেশ কৃষিসংস্কৃতির দেশ। বাংলা আমাদের ভাষা, বাঙালিত্ব আমাদের চেতনায় গাথা। আজকের দিনে জ্ঞান-বিজ্ঞান আর তথ্য যোগাযোগ মানুষের মাঝে নতুন এক সমতা আনছে। কিন্তু তৃণমূল মানুষের মাঝে সঠিক জ্ঞান পৌঁছে দেওয়ার কাজটি সমানভাবে করতে পারছে না। কৃষির বাইরে আমাদের যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে পূর্ণাঙ্গ কৃষি জীবনব্যবস্থাভিত্তিক একটি জাদুঘর গড়ে তোলার উদ্যোগ আজও নেওয়া হয়নি। টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের শালিয়াবহ গ্রামের কৃষক আবদুল আজিজ ২০০৯ সালে চ্যানেল আই কৃষিপদক গ্রহণ করে তার বক্তব্যে বলেছিলেন, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষকের জন্য কোনো স্কুল নেই। এটা ছিল তার মনের কথা। ২০১৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ পদার্পণ করেছে ১৫ বছরে। এ উপলক্ষে টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক কৃষক ফোন করে কৃষি ও কৃষকের সমস্যা নিয়ে কথা বলছিলেন। সেখানে তিনি এ দেশে সরকারিভাবে প্রত্যেক জেলায় কৃষকের জন্য পাঠাগার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছিলেন। সত্যিই এ দেশের কৃষকের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার জন্য পাঠাগার বা লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে শাহ জাহাঙ্গীর যে উদ্যোগকে তিল তিল করে এগিয়ে নিচ্ছেন তা আমাদের ভবিষ্যতের এক বুনিয়াদ। এ কাজটিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যেমন সরকারি-বেসরকারি সহায়তা প্রয়োজন, একইভাবে শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগারের আদলে দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন পাঠাগার ও কৃষি তথ্যের জাদুঘর গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে। তা দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে কৃষির সঙ্গে থাকতে যেমন সহায়তা করবে, একইভাবে কৃষকের তাত্ক্ষণিক তথ্যসুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রেও রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

 

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর