সোমবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

পাকিস্তানি সেনাদের পিটিয়ে মারা হয়েছিল

মাকিদ হায়দার

পাকিস্তানি সেনাদের পিটিয়ে মারা হয়েছিল

১৯৭১ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তার আগে আমি পাবনা শহরের কালাচাঁদপাড়ার মনি বশাকের ফেলে যাওয়া রেশনশপের দোকানদার হয়েছিলেম। অগ্রজ জিয়া হায়দার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়েছিলেন দাঁড়িপাল্লার ওজনদার। চাল ছিল ১২ আনা সের, লবণ ৫ আনা, চিনি একসের ১.৭৫ পয়সা, গম ছিল সাড়ে আট আনা। সয়াবিন তেলের  আবির্ভাব তখনো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হয়নি। জিয়া ভাই নতুন ওজনদার।  ওজনে প্রায়শই বেশি বেশি করে মালামাল রেশন কার্ড হোল্ডারদের দিয়ে দিতেন। লাভের চেয়ে লোকসানের পরিমাণটা ছিল অনেক বেশি। ওই সময় বেশি জ্বালাতন করতেন বন্দুক হাতে রমজান নিকেরী!

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানি আর্মিরা আরিচা, নগরবাড়ী পাড়ি দিয়ে ৮ অথবা ৯ তারিখে গ্রামগঞ্জ পুড়িয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করতে করতে তারা পাবনা শহরের পলিটেকনিক স্কুলের তিনতলার ওপর মেশিন গান বসিয়ে অনবরত গুলিবর্ষণ করে। পাবনাবাসী, হিন্দু, মুসলমানদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে, একদল আর্মি আশ্রয় নিয়েছিল এডওয়ার্ড কলেজের পশ্চিমে নূরপুর নামে গ্রামের একটি মহল্লায়। ওই মহল্লাতেই ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের বিশাল রেস্ট হাউস।

পুরো এপ্রিল মাসটায় শুরু হয়েছিল বৃষ্টি। একই সঙ্গে কারণে-অকারণে কামানের গর্জন। তবে মার্চের পাবনা শহর ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন। মার্চের ২৭ থেকে ৩১ তারিখের মধ্যে শহরের হিরাজ ম্যানসনের পশ্চিমদিকের টিঅ্যান্ডটি অফিসের দোতলায় এবং তিনতলায় ২০-২৫ জন পাকিস্তানি আর্মি আগে থেকেই অবস্থান করছিল। তাদের ঢাকা থেকে পাঠানো হয়েছিল মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে।

২৬ মার্চের ক্র্যাক ডাউনের পরে ওই টিঅ্যান্ডটি অফিসের দোতলা, তিনতলায় অবস্থানরত পাক আর্মিরা শহরের হিন্দু-মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা নিধন শুরু করলে সঙ্গে সঙ্গে গোপালপুর মহল্লার রফিক ইসলাম বক্শ, বেবী ইসলাম, ইকবাল হোসেন নিখিলেশ সান্যাল (তপন) দিপক রায়সহ কয়েক হাজার মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে এমনকি শহরের দক্ষিণ দিকের চরতারাপুর, চরআশুতোষপুর থেকে শয়ে শয়ে লোক হাতে সড়কি, বল্লম, গাদা বন্দুক, এমনকি হাঁসুয়া হাতে নিয়ে পাক আর্মিদের আক্রমণ করলে টিঅ্যান্ডটি অফিসের দোতলা তিনতলা থেকে পাক আর্মিদের গুলিতে অনেক লোক নিহত হয়েছিল। একপর্যায়ে পাক আর্মিদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে রফিকুল, বেবী, ইকবালসহ যুবকদের এবং চরের ক্ষুব্ধ লোকদের আক্রমণে পাক আর্মিদের সবাই নিহত হয়েছিল।

চর আশুতোষপুরের খলিল, চরতারাপুরের হামিদ এবং হেমায়েতপুরসহ শহরের অনেকেই আহত হয়েছিল পাক আর্মিদের গুলিতে। তারই প্রতিশোধ নিয়েছিল তরুণসহ পাবনা শহরবাসী। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের পরের দুই সপ্তাহ শহরবাসী নিশ্চিত ছিলেন যে কোনো দিন পাবনার নগরবাড়ী ঘাট থেকে আশপাশের গ্রামগঞ্জ, লোকজনকে বিনা দ্বিধায় জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে গুলি করে হত্যা করবে পাক আর্মিরা। কেননা ঢাকার ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্বে থাকা মেজর জেনারেলের কাছে খবর এসেছিল পাবনায় ২০-২৫ পাক আর্মিকে শহরবাসী পিটিয়ে, গুলি করে, সড়কি, বল্লম দিয়ে হত্যা করেছে। এদের আটজনকে পাবনা সদর গোরস্তান আরিফপুরে মাটি দিয়েছে। অন্যদের নূরপুরের কবরস্থানে।

আমাদের হায়দার পরিবার ১৯৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কোনোরকমে পাবনায় গিয়ে পৈতৃক বাড়িতে পা রাখতেই আমাদের মেজ কাকা হাবীবুর রহমান, ছোট কাকা আবুল কাশেম, দুই কাকি সমস্বরে কান্না শুরু করে দিলেন। বিশেষত মেজ কাকাকে ওইভাবে কাঁদতে আমি জীবনে দেখিনি। বিশেষ করে আমার মায়ের অত্যন্ত আদরের দেবর ছিলেন আমাদের সেজ কাকা। আর ছোট কাকা, কাঁদলেন জিয়া ভাইকে জড়িয়ে ধরে। তিনি জানালেন, তোরা যেহেতু মালিবাগে থাকিস তোদের বাসার কাছেই রাজারবাগ, আমরা নিশ্চিত হয়েছিলাম তোরা আর কেউ বেঁচে নেই। হয়তো ওই একইভাবে কাঁদতেন, আমাদের প্রয়াত পিতা শেখ মোহাম্মদ হাকিম উদ্দিন। তিনি ১৯৭০ সালের ২৩ ডিসেম্বরে পৃথিবী ত্যাগ করে পাড়ি দিয়েছিলেন অনন্তে। নয়তো তিনিও ঢাকায় অবরুদ্ধ ছেলেমেয়েদের জন্য অবশ্যই কাঁদতেন। আমাদের দোহারপাড়ার বাড়ির ধানের গোলা পুড়িয়ে দোতলা বিল্ডিংয়ের এক অংশ এবং কাচারি ঘরে শায়িত পাগল উজ্জ্বল শেখকে পাকিস্তানি আর্মিরা ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালের রবিবারে হত্যা এবং পুড়িয়ে ফিরে গিয়েছিল সেই নূরপুরের ক্যাম্পে এবং শহরের পলিটেকনিক স্কুলের দোতলা, তিনতলায়। ওই দিন সকাল ১১টার সময় দিল্লি থেকে সংবাদ পাঠিকা নীলিমা সেন বাংলা সংবাদে জানিয়েছিলেন ‘পাকিস্তানি আর্মি, আরিচা নগরবাড়ী পার হয়ে এখন পাবনা শহরের দিকে এগোচ্ছে’। সংবাদ পাঠিকা নীলিমা সেনের সেই সংবাদের সত্যতা পাওয়া গেল ঘণ্টা দুয়েকের ভিতরেই। চারদিকে আগুন আর আগুন। যে যার মতো ছুটে পাল্লাচ্ছে। আমাদের বাড়ির সবাই পালিয়ে গেলেও আমি আর আমার মা-রহিমা খাতুন না পালিয়ে বাড়ির অনেক পশ্চিমে পায়খানার পাশে আম আর খেজুর গাছের গোড়ার আড়ালে যখন গিয়ে লুকালাম তখনই শুনলাম অজস্র গুলির শব্দ। কাচারি ঘরের বারান্দায় শায়িত পাগলটাকে হত্যা শেষে বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে অনেক পাক আর্মির হাসাহাসি শুনলাম। এক পর্যায়ে শুনলাম ‘ছব ছালা ভাগ গিয়া’। আর একজন বললেন, ‘এ ছালে পাকিস্তানি হ্যায়!’

পাকিস্তানি হ্যায় বলার পেছনের কাহিনী হচ্ছে, অনুজ খোকন (দাউদ হায়দার) মেজ কাকার ছেলে রাজা (আনিসুর রহমান)। এবং ছোট কাকার ছেলে রতন (হাসনাত, মোশারফ) ওই তিনজন মিলে বাড়ির দোতলার ছাদে পাকিস্তানি ফ্ল্যাগ লাগিয়ে ছাদ থেকে নামতে না নামতেই শুরু হয়ে গিয়েছিল গ্রামের ভিতর গোলাগুলির শব্দ। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে পাক আর্মিরা আমাদের বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় ধানের গোলা এবং নিচতলায় আগুন দিয়ে ফাঁকা গুলি করতে করতে জিপে গিয়ে উঠল ক্যাপ্টেন। এবং সিপাইরা ট্রাকে করে ফিরে গেল শহরের দিকে। দিনকয়েক পরে আমার দ্বিতীয় মায়ের পিতা ডাক্তার (হোমিওপ্যাথ) কাজী হাবিবুল ইসলাম আমাদের খোঁজখবর নিতে এসে দেখলেন ধানের গোলা প্রায় ৩০-৪০টি, আখের গুড়ের কোলা এবং রবিশস্য সবই জ্বলে-পুড়ে একাকার। তারই পরামর্শে পাবনা মিউনিসিপ্যালিটির আদেশক্রমে কালাচাদপাড়ার মনি বশাকের পরিত্যক্ত রেশন শপের মালিক হলাম আমি। জিয়া ভাই হলেন ওজনদার। যিনি ১৯৬৬-৬৮ সাল পর্যন্ত আমেরিকার হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাট্যকলায় উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নাট্যকলা বিষয়ে পাঠ্যক্রম এবং অধ্যাপনাসহ ঢাকায় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেই তিনি হলেন— রেশন শপের ওজনদার। এর চেয়ে দুঃখ-কষ্টের আর কী থাকতে পারে। আমি দিনে রেশন শপ চালালেও রাতে ছিলাম মুক্তিযুদ্ধের ইনফরমার এবং অর্থদাতা। যদিও সামান্য।

এমনি করে দিনগুলো ভয়ে ভয়ে কাটতে কাটতেই একদিন খবর দিলেন পাবনা শহরের ডিসি ফুড। ডিসি ফুডের ছেলে রুনু আমার বন্ধু ছিলেন। সেই সুবাদে ডিসি ফুড জানালেন, জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাবনায় বিবিসির সাংবাদিক মার্কটালি এবং আরেকজন সাংবাদিক আসবেন, যে কোনো উপায়ে তাদের দুজনকে আমার তারক নিকেতনের বাড়িতে আনতে হবে। তারক নিকেতন শহরের রায় বাহাদুরের বাড়ির পূর্বের দোতলা বাড়ির পেছনের গোয়ালঘরের ভিতর দিয়ে জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মার্কটালি, আরেকজন সাংবাদিকসহ ঠিকই পৌঁছেছিলেন প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে রাত ৯টার দিকে আর সেই কালাচাদপাড়ায় ফিরেছিলাম রাত ১টায়। আমার বন্ধু শামসুল দিনকয়েক পরে জানালেন, তিনিও রেশন শপ দেবেন। তাদের সংসারের অবস্থা শোচনীয়।

১৯৭১ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে শামসুল হামিদ রোডের ওপর রেশন শপ দিল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ নিয়মিত রাখতে লাগল। ইতিমধ্যে কৃষ্ণপুরের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা রিদ্দিক হোসেন দিলালপুরের বাদলেরা দুই ভাই এবং সাধুপাড়ার কোবাদ আলী শেখকে হত্যা করেছিল পাক বাহিনীর দোসররা। কোবাদ আলীকে হত্যার কারণ ছিল তার দুই ছেলে মুক্তিযোদ্ধা— শহীদুল্লাহ এবং হাবীবউল্লা। দিন দুয়েক পরে শামসুল আমাকে জানাল, আগামী কাল-পরশুর ভিতরে নাটোর, মুলাডুলি এবং চলনবিলের হান্ডিয়ালের মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করবে পাকিস্তানি আর্মিদের। দিন দুয়েক পরেই আমরা শুনলাম ঢাকা-রাজশাহী রোডে অনেক পাকিস্তানি আর্মি মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় কতল হয়েছে। যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল রাতে। পরদিন দুপুর বেলায় আমাদের দোহারপাড়ার বাড়িতে রাজকার সুলতান এসে আমার মেজ কাকাকে হুকুম দিলেন এক্ষণি কোদাল নিয়ে আসেন, অনেক পাকিস্তানি আর্মির লাশ এসেছে। মাটি দিতে হবে। কবর খোঁড়ার (গোর খোদক) লোক পাওয়া যাচ্ছে না। বয়সী মেজ কাকাসহ আমাদের পাড়ার এবং রাজাকার সলকদের পাড়ায় যাদের পেয়েছে তাদেরকেই কোদাল জোগাড় করে আরিফপুর সদর গোরস্তানে এক সারিতে আটজনকে কবর দিয়েছিলেন মেজ কাকাসহ অন্য গোর খোদকেরা।

মাটি দেওয়া শেষে পাক মেজর জানিয়েছিল, বাঙাল শালারা তোরা যদি কবর না কেটে দিতি তবে তোদের জ্যান্ত ফিরে যেতে দিতাম না। গত কয়েক বছর আগে আরিফপুর সদর গোরস্তানে জিয়া ভাইয়ের কবর জিয়ারত করতে গিয়ে দেখি অনেক পাকিস্তানি সম্ভবত বেলুচি পাঞ্জাবি তারা গোরস্তানের প্রধান গোরখোদক আবদুর রহমানের সঙ্গে দাঁড়িয়ে মোনাজাত করছে ওই এক সারিতে কবর দেওয়া আটজনকে। তখনই মনে পড়ল— আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেওয়া শামসুলের কথাগুলো। আজকাল শুনছি, কবর দেওয়াকে নিয়ে অনেক হাঙ্গামা হচ্ছে। মেয়ে চাইছে পিতাকে গ্রামে কবর দিতে আর সদ্য ধনী ছেলে চাইছে পিতাকে বনানীর গোরস্তানে কবর দিতে। ছেলের ধনীত্ব ফলানোর জন্য। ছি!

রবীন্দ্রনাথ বঙ্গবিভাগ (সমূহ) প্রবন্ধে সংঘাত নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আজ থেকে শত বছর আগেই দিয়েছিলেন।

সংঘাত।

‘সংঘাত ব্যতীত বড়ো কোনো জিনিস গড়িয়া ওঠে না, ইতিহাসে তাহার অনেক প্রমাণ আছে।’

তারই উত্কৃষ্ট প্রমাণ বাংলাদেশ।

লেখক : কবি।

 

সর্বশেষ খবর