রবিবার, ১১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

কতই রঙ্গ মশক দুনিয়ায়

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ

কতই রঙ্গ মশক দুনিয়ায়

কয়েকদিন আগে এক ছাত্র তার মোবাইলে দেখাল, মশার জ্বালায় পায়ে পলিথিন মুড়ে অফিস করছেন এক ভদ্রলোক, এ ছবি নাকি সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ রসের খোরাক জুগিয়েছে। চারদিকে শুধু মশা আর মশা— হাসপাতালে মশা, গাড়িতে মশা, বাড়িতে মশা, জলে মশা, স্থলে মশা এমনকি রেডিও টিভি, সংবাদপত্রের পাতায়ও মশা! আচ্ছা কেউ কি জানেন পৃথিবীতে মশার সংখ্যা কত? একটি আন্তর্জাতিক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কয়েক লাখ কোটি মশা। বিশ্বে জনপ্রতি মশার সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ। সংখ্যাটা বেশিও হতে পারে। এর অর্থ আমাদের প্রত্যেকের ভাগে পড়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ মশা! চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মতোই হিসাবটা। ভাবুন তো, এ পরিমাণ মশককুল যদি দল বেঁধে পেছনে লাগে তাহলে কী অবস্থা হবে? দৌড়েও তো কূল পাওয়া সম্ভব নয়! কারণ আমার আপনার হালকা একটা দৌড়ের গতির চেয়ে মশকদের গতি ঢের বেশি, ঘণ্টায় প্রায় তিন মাইল। আর আমাদের দেশের অবস্থা কী, মাথাপিছু বা কয়টা করে মশা পড়ে জানার জন্য হলেও দেশে একটা ‘মশকশুমারি’ করলে কেমন হয়, অন্তত রাজধানীতে?

কথায় আছে, ‘মশা মারতে কামান দাগা।’ আমরা যদিও না আনি কামান, তবুও মশা কিন্তু থামিয়ে দেয় বিমান! এ বছরেরই ঘটনা, ঘটেছে আমাদের দেশেই, হার মানিয়েছে আগের সব উদাহরণকে। বাসাবাড়ি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মশার উৎপাত তো ছিলই, কিন্তু এবার ২২ ফেব্রুয়ারি উড্ডয়নের ঠিক আগ মুহূর্তে রানওয়ে থেকে ফিরিয়ে আনতে হয় মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ। কারণটা মশা! পাসপোর্টবিহীন বিমানভর্তি মশা তাড়াতে দেরি হওয়ায় দুই ঘণ্টা উড়োজাহাজ অচল! বিমান কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের মশার উৎপাত থেকে রেহাই দিতে এ পদক্ষেপ নিল, নাকি মালয়েশিয়ায় আমদানি ঠেকিয়ে তাদের দেশে মশকবিস্তার রোধ করল-সেটাও ভাববার বিষয় বটে!

আচ্ছা মশা কামড়ালে কী-ই বা হয়? একজনের শরীরে তো প্রায় পাঁচ লিটার রক্ত, না হয় তার একটু খেল মশা, তাতে আপনার কী মশাই? আপনার প্রশ্ন যদি এমন হয়, তাহলে বুঝেই নিচ্ছি আপনি গত বছর চিকুনগুনিয়ার কবলে পড়েননি! যিনি কিংবা তার কাছের কারও চিকুনগুনিয়ার অভিজ্ঞতা আছে, তিনিই জানেন মশার কামড়ে কত যন্ত্রণা আছে। এ চিকুনগুনিয়াসহ ডেঙ্গু এবং জিকা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণও এডিস মশা। এ ছাড়া ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, এনকেফেলাইটিসের মতো জটিল রোগও ঘটে মশার কামড়ে। সুতরাং সাধু সাবধান! যতই বলা হোক ঢাকার মশা খুব ভদ্র, বাস্তবে তা মোটেই ঠিক নয়। কারণ মশার কামড়ে শুধু ভোগান্তি নয়, আছে মরণেরও ভয়। আশার কথা, আমরা প্রায়শ যেসব মশার ভনভনানি গান শুনে অতিষ্ঠ হয়ে দুহাত তালি দিয়ে তাদের শেষ করার চেষ্টা করি, তার অধিকাংশই কিন্তু অক্ষতিকর কিউলেক্স মশা। এরা জ্বালায় বটে তবে রোগ ছড়ায় না।

মশা তাড়ানোর সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং কার্যকরী উপায় হচ্ছে ‘কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ এবং গালাগালি’ করা। চারদিকে সবার মুখে মুখে এ চর্চা দেখে অন্তত তাই মনে হয়। কিন্তু আমরা একটু ঠাণ্ডা মাথায় একটা বিষয় কি ভেবে দেখেছি, এ মশার ক্ষমতা কিন্তু আমাদের সিটি করপোরেশনের চেয়ে অনেক বেশি! হ্যাঁ, সত্যিই! দেখুন না, মশা কিন্তু বিনা বাধায়, বিনা অনুমতিতে আপনার বাসায় এমনকি আপনার বেডরুম পর্যন্ত যে কোনো সময় ঢুকে পড়ছে। আবার যখন তখন আপনার ওপর অতর্কিতে হামলাও চালাচ্ছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের এত ক্ষমতা কই? তাদের তো আর অন্দরে প্রবেশের অনুমতি নেই, তারা বড়জোর আপনার বাড়ির আশপাশে একটু ধোঁয়াশা তৈরি করে দিতে পারে মশা নিধনের জন্য। কিন্তু মশারা তো আরও বড় ওস্তাদ, বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়-পরিজন নিয়ে তারাও হয়তো সেদিনের জন্য সেই ধোঁয়াশা কাটিয়ে পাশের মহল্লায় পিকনিক করতে যাচ্ছে! আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, আপনি হয়তো জানেনই না, মশাদেরও গুপ্তচর থাকে আপনার-আমার বাড়িতেই! দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পোষার মতো ‘শৌখিন জমানো পানি’ দিয়ে আমরা মশা পুষি, আর তাদের সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করি। বাড়ির ব্যালকনি, টেবিলে কিংবা ঘরের অন্দরে রাখা ছোট ছোট ফুলের টব, প্লাস্টিকের পাত্র, বাথরুমে জমা পানি, এসি বা ফ্রিজের কম্প্রেসারের জমা পানি, বৃষ্টিতে জমা বারান্দা বা ছাদের পানিতে মশা ডিম পাড়ে। আর এগুলো থেকে জন্মানো মশা যেহেতু আপনাকেই আগে হাতের কাছে পায়, সুতরাং তার হালখাতা শুরু হয় আপনার চামড়ায় শুঁড় বসিয়ে। তাই বহুল প্রচলিত জননন্দিত ‘দোষারোপ পদ্ধতি’ বাদ দিয়ে নিজে সচেতন হয়ে কিছু অতি সাধারণ কাজ শুরু করলে বরং মুক্তি মিলতে পারে চামড়া জ্বালানো মশার কামড় থেকে। সাধারণত বাড়িঘরের আশপাশে যে কোনো জায়গায় বা পাত্রে জমে থাকা পানি তিন থেকে পাঁচ দিন পরপর ফেলে দিলে মশার লার্ভা মারা যায়; পাত্রের গায়ে লেগে থাকা মশার ডিম অপসারণে পাত্রটি ঘষে পরিষ্কার করলে ভালো; ফুলের টব, প্লাস্টিকের পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, মাটির পাত্র, টিনের কৌটা, ডাবের খোসা, কন্টেইনার, মটকা, ব্যাটারির শেল, পলিথিন বা চিপসের প্যাকেট ইত্যাদিতে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করতে হবে। শিশুদের ক্ষেত্রে ফুলপ্যান্ট পরিধান করাতে হবে। যথাসম্ভব শরীরকে পোশাকে আবৃত করে দিনে ও রাতে ঘুমানোর আগে মশারি বা মশা প্রতিরোধক ব্যবহার করতে হবে। স্প্রে, লোশন বা ক্রিম এবং রিপেল্যান্ট ব্যবহার করা যায়। জানালায় নেট লাগানো যেতে পারে।

আবার শুধু নাগরিকদের একক প্রচেষ্টায় যে এ বিশাল মশক বাহিনী নিধন সম্ভব, তাও কিন্তু নয়। বাড়ির বাইরে যততত্র বদ্ধ ড্রেন, খোলা ম্যানহোল, উন্মুক্ত আবর্জনার স্তূপ করে যেভাবে মশককুলের জামাই আদরের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তাতে এরা আর শ্বশুরালয় ছাড়ার কোনো ইচ্ছা করবে বলে মনে হয় না। সুতরাং মশাদের এসব আমোদ-প্রমোদের উপসঙ্গ কমিয়ে তাদের বিতাড়িত করতে হবে। এ মশকবাহিনী কিন্তু ভয়ঙ্কর দখলবাজ! যেমন গুলশান-বনানীর মতো বড় বড় লেক মানুষের হাত থেকে যেইনা দখলমুক্ত করা হলো, তখনই সদলবলে সেগুলো দখল করে নিল মশকবাহিনী। কারণ এসব লেকের আশপাশের বাসাবাড়ির ড্রেনের লাইন উন্মুক্ত করে, ময়লা আবর্জনা ফেলে এ দখলবাজদের সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করছি আমরাই। ফলাফল কী? যে লেকের স্বচ্ছ জলে আপনার আমার প্রিয় মানুষদের নিয়ে প্রমোদ ভ্রমণে নির্মল আনন্দ পাওয়ার কথা ছিল, সেখানে মশককুল বাচ্চা-কাচ্চা, নাতি-নাতনি নিয়ে আমোদ আহ্লাদে সাম্রাজ্যের সীমানা বিস্তৃতিতে ব্যস্ত। এ মশারা কিন্তু আবার বেশ প্রতিবাদীও বটে! ফুটপাথে বিশেষ করে ড্রেনের ওপর গড়ে ওঠা টংগুলোর দোকানিরা তাদের ময়লা-আবর্জনা সবার আড়ালে দোকানের নিচের ড্রেনে চুপিসারে ফেলে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের লোকজন না জানতে পারে, না মশা নিধনে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে। তারপরও দখলদারকে কিন্তু রেহাই নেই, বুমেরাং হয়ে ওই ড্রেন থেকেই জন্ম নিয়ে ফিরে আসছে মশা, কুট্টুস করে কামড় লাগাচ্ছে ওই লোকগুলোরই পদ এবং পশ্চাতে। মশা আবার বেশ বেরসিক! বিমানবন্দরে কিছু লেক আছে, আপদকালীন অবতরণের জন্য কিংবা কোনো দুর্ঘটনাজনিত অগ্নিসংযোগে যাতে এ লেকের পানি ব্যবহার করা যায়। দীর্ঘদিনের এ বদ্ধ লেকের জলে মশা থাকবে, বংশবিস্তার করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ বেরসিক মশাগুলো মাঝে মাঝে জলাশয় ছেড়ে বিদেশ ভ্রমণের মানসে বিমানে চড়ে বসে! তাদের পাসপোর্ট ভিসা লাগে না, তাই বিমানে উঠে স্বভাবসুলভভাবে যাত্রীদের উত্ত্যক্ত করে, আবার প্রবাসী হয়ে অন্য দেশেও নতুন সাম্রাজ্য বিস্তারের বাসনাও করে। এভাবেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে মশাবাহিত রোগবালাই; যেমন আমাদের দেশে সুদূর আফ্রিকা থেকে আমদানি হয়েছে চিকুনগুনিয়া।

একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে, একবার কীটনাশক পানে আত্মহত্যার চেষ্টা করা এক রোগী ভর্তি হলো হাসপাতালে। তত্ক্ষণাৎ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হলো রোগীকে সুস্থ করতে। কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে, এ ধরনের রোগীর যেসব তীব্র বিষক্রিয়ার লক্ষণ দেখা দেওয়ার কথা, তার সামান্যও সেই রোগীর ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হলো না। রোগীকে সুস্থই মনে হলো, এতে ডাক্তারদের দুশ্চিন্তা উল্টো আরও বেড়ে গেল কোনো ভুল হলো, নাকি রোগী কোনো মিথ্যা তথ্য দিল? সংশয় দূর করতে পুনরায় ঘটনা খতিয়ে দেখে জানা গেল, রোগী ঠিকই কীটনাশক পান করেছে অথচ তার আত্মহত্যার বাসনা পূর্ণ হলো না! অবশেষে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল, ওই বিষেই ভেজাল!!! তাই নিজের অজান্তেই মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমাদের সব সম্ভবের এ দেশে মশক নিধনে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে যে ওষুধ ব্যবহার করা হয়, তাতেও সবার অজান্তে ভেজাল নেই তো? আবার অনেকের অভিমত হেলিকপ্টার বা বিমানের মাধ্যমে ওষুধ ছিটিয়ে আশির দশকের মতো মশক নিধন কি সম্ভব নয়? উত্তর হচ্ছে, আকাশযানের মাধ্যমে ওষুধ ছিটানো হয়তো সম্ভব, কিন্তু এত বহুতলভবনের ভিড়ে তা আদৌ কতটা কার্যকারী হবে, তা প্রশ্নাতীত নয়। তাছাড়া এভাবে সরাসরি পদ্ধতিতে মুক্ত আকাশে ছিটানো ওষুধ, সিটি করপোরেশনের ফিউমিগেটিং মেশিনের মাধ্যমে ছিটানো ওষুধের চেয়ে অধিকতর স্বাস্থ্যহানিকারক এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণও বটে।

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, শুধু ব্যক্তি কিংবা সরকারি প্রচেষ্টায় মশক নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। আবার সরকারি কোনো একক প্রতিষ্ঠানের চেষ্টায়ও তা সম্ভব নয়। কারণ রাজধানীর এয়ারপোর্টসহ বিভিন্ন জলাবদ্ধ জমি শুধু সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে নেই, বরং ওয়াসা, রাজউক, গণপূর্ত অধিদফতর কিংবা ভূমি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দফতরের দায়িত্বে রয়েছে। সুতরাং শুধু সিটি করপোরেশন নয়, সব সংশ্লিষ্ট দফতর, মন্ত্রণালয় এবং সর্বোপরি সাধারণ জনগণের সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া এ মশককুলকে বিরহে ব্যাকুল করে দমন করা প্রায় অসম্ভব। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, মশা ছিল, এখনো বহাল তবিয়তে দাপটের রাজত্ব কায়েম করে চলছে এবং ভবিষ্যতেও মশা থাকবে। তবে এদের দাপট কমাতে এবং স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা মাথায় রেখে সব নাগরিক যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করলে মশার বংশ পুরোপুরি ধ্বংস না হলেও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।

লেখক : অধ্যাপক ও ডিন, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর