রবিবার, ১১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

তারুণ্যের ক্রীড়াঙ্গন

ইকরামউজ্জমান

তারুণ্যের ক্রীড়াঙ্গন

যেসব দেশ ক্রীড়াঙ্গনে এগিয়ে গেছে, এগিয়ে চলেছে, দুনিয়ার সামনে উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে তারা সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ করে তৃণমূল পর্যায় থেকে তারুণ্যের শক্তিকে পরিকল্পনামাফিক কাজে লাগিয়ে কামিয়াব হয়েছে এবং হচ্ছে। ক্রীড়াঙ্গনে এটি একটি বিরামহীন প্রক্রিয়া। ক্রীড়াঙ্গনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগানো ছাড়া উপায় নেই। ক্রীড়াঙ্গনে মূল শক্তিটাই তো তারুণ্য। তারুণ্য পারে ক্রীড়াঙ্গনের চেহারা বদলে দিতে, পারে ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। তাই সুন্দর তারুণ্য নিয়ে ভাবতে হবে, মনোযোগী হতে হবে। আজকের তরুণ তরুণীরাই তো আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। ওরাই আমাদের এগিয়ে চলার প্রেরণা জোগায়।

অলিম্পিক আন্দোলন সবসময় যুবসমাজকে কাজে লাগানোর কথা বলে। যুবসমাজকে প্রাধান্য দেয়। লক্ষ্য ঠিক করে কাজ করতে বলে। আরও দ্রুত ছোট আরও উঁচুতে ওঠ এবং আরও শক্তির পরিচয় তো দিতে পারে শুধু তরুণ ও যুবসমাজ।

বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ যুব গেমস-২০১৮, গত ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে। ২১টি খেলা নিয়ে যুব গেমস দেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে জেলা, বিভাগীয় পর্যায়ের পর সর্বশেষে ঢাকায় জাতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ১০ থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত এবারই প্রথম। এ গেমসকে ঘিরে অনূর্ধ্ব-১৭ তরুণ-তরুণীদের মধ্যে যে উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষণীয় হয়েছে এটা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ও অনুপ্রেরণাদায়ক। ইতিবাচক চিন্তা ও ইতিবাচক বিশ্বাস জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও অপরিহার্য। বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে যুব গেমসে ঢাকার বাইরে তরুণ-তরুণীরা যেভাবে অংশ নিয়েছেন তাদের মধ্যে যে চেতনা লক্ষ্য করা গেছে এটা অনেক বড় প্রাপ্তি ক্রীড়াঙ্গনের। নিজেদের প্রকাশ ও আবিষ্কারের চেষ্টা যুব গেমস বৈশিষ্ট্যকে উজ্জ্বল করেছে। দেশের প্রত্যন্ত এলাকার তরুণ-তরুণীরা বুঝতে পেরেছেন এটি একটি বড় সুযোগ। এ সুযোগকে তারা দুই হাতে আলিঙ্গন করেছেন। এখানে কিছু করা ও পাওয়ার সুযোগ আছে। সুযোগ আছে নিজের সামর্থ্য, সম্ভাবনা ও ইচ্ছাশক্তি বিচারের।  ক্রীড়াঙ্গনে এ গুরুত্বপূর্ণ জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়টি নিয়ে বিওএর অনেক আগেই ভাবা উচিত ছিল। বিভিন্ন কারণে এ উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। ক্রীড়াঙ্গনের মূল শক্তিটাই তারুণ্য। আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের সমষ্টিগত মেরুদণ্ড কতটা শক্ত সেটা তো আমরা সবসময় দেখতে পাচ্ছি! স্থিতিশীল অগ্রগামী ক্রীড়াঙ্গনের কথা ভাবলে যুব ক্রীড়াঙ্গনকে প্রাধান্য দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আর এ জন্য প্রয়োজন পুরনো মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন। মানুষ দেখতে চায় সম্ভাবনাময় ক্রীড়াঙ্গন যা বাংলাদেশকে পরিচিত করবে। জাতির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। প্রথামিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় ৬৪ জেলার আওতায় ৫০০ উপজেলা থেকে ২৩ হাজার ২১০ জন তরুণ-তরুণী অংশ নিয়েছেন। এরপর বিভাগীয় পর্যায়ে অংশ নিয়েছেন তিন হাজার ৪৭৩ জন। ঢাকায় জাতীয় পর্যায়ে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় ১৫৭টি স্বর্ণের জন্য লড়ছেন দুই হাজার ৬৬০ জন ক্রীড়াবিদ ও খেলোয়াড়।

বাংলাদেশে মানব সম্পদের ঘাটতি নেই। বিশ্বজুড়ে তরুণ-তরুণীরা অলিম্পিকের আসল উপাদান। আমাদের জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশের বয়স এখন ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে অর্ধেক পুরুষ আর অর্ধেক নারী। এ ধরনের অবস্থা আগামী ১০-১৫ বছরের পর আর থাকবে না। জনসংখ্যার সুবিধা (পপুলেশন ডিভিডেন্ট) আমরা এখন পেতে পারি ক্রীড়াঙ্গনকে যুব সমাজকে বিনিয়োগ করে। বিওএ যুব গেমসের উদ্যোগ নেওয়ার আগে এ বিষয়টি মাথায় রেখেছে। আমাদের লক্ষ্য ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৩তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হওয়া। যুবশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে কেন আমরা পারব না ২০২৪ সালের অলিম্পক থেকে একটি পদক জিততে।

সুস্থ দেহ সুন্দর মন, সুনাগরিক সৃষ্টিতে ক্রীড়াচর্চার কোনো জুড়ি নেই। আমরা লক্ষ্য করছি তরুণ সমাজের একাংশের মধ্যে হতাশা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নৈরাজ্য, নানাবিধ মানসিক বৈকল্য এবং নিঃসঙ্গতা। এক্ষেত্রে শিক্ষাঙ্গনের পাশাপাশি দেশের বড় ক্রীড়াঙ্গনেরও দায়িত্ব আছে। দেশের যুবসমাজকে বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে খেলাধুলার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে অনুপ্রাণিত করাই হচ্ছে সময়ের সবচেয়ে বড় কাজ। জাতীয় মানস গঠনে খেলাধুলার ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত। খেলার চর্চা, সবল দেহ গঠন ও শারীরিক সুস্থতা রক্ষা করা ছাড়াও মানুষের মানবিক ও চারিত্রিক গুণাবলি অর্জনে বিশেষভাবে সহায়তা করে। খেলা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আছে প্রচুর আগ্রহ। সংস্কৃতি ও বিনোদন জগতে খেলা চর্চাই সবার জন্য সহজ বিষয়। এখানে কোনো ধরনের বিতর্ক নেই। বিভিন্ন ধরনের শিল্প-সংস্কৃতি একদল বোঝেন, একদল বোঝেন না। আর তাই সংস্কৃতিচর্চায় বিনোদনের জগতে খেলার গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদরা আন্তর্জাতিক চত্বরে যেভাবে দেশকে তুলে ধরতে পারেন, পারেন পরিচিত করতে— সংস্কৃতির অন্য কোনো ক্ষেত্রে এটা সম্ভব নয়।

অনূর্ধ্ব-১৭ যুব গেমস-২০১৮। এ গেমস দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে নাড়া দিয়েছে। রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন স্থানে গেমসকে ঘিরে যে ধরনের উৎসাহ-উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়েছে, এটা অত্যন্ত ইতিবাচক। পাশাপাশি আছে বিভিন্ন ধরনের পর্যবেক্ষণও দেশজুড়ে বিভিন্ন স্থানে গেমসের আয়োজন করাতে বাস্তবতায় ক্রীড়াঙ্গনের সবলতা, দুর্বলতা, সম্ভাবনা, ক্রীড়াঙ্গন-সংশ্লিষ্ট সংগঠক, সাধারণ মানুষের ইতিবাচক ও নেতিবাচক চিন্তাভাবনা এবং মানসিকতার পরিচয় মিলেছে। ফুটে উঠেছে ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোতে খেলাধুলার চর্চার প্রকৃত অবস্থা, কাঠামোগত ও বস্তুগত সুযোগ-সুবিধা জেলাপর্যায়ে সংগঠকদের মধ্যে উদ্যমী এবং নিরুৎসাহী—উভয়ের বাস্তবতার আলোকে ভূমিকা। রাজধানীর বাইরে তরুণ-তরুণীরা খেলাধুলা করতে চায়; কিন্তু সুযোগ কম! সুযোগ পেলে যে তারা খেলাধুলা করতে চায়, উৎসাহী, তার প্রমাণ হলো যুব গেমসে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আগ্রহ। ক্রীড়াঙ্গনের চিন্তাকে বড় করে দেখা উচিত। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করেই বিওএ গেমসের আয়োজন করেছে। বিওএ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিভিন্ন খেলায় নতুন প্রতিভা চিহ্নিত করতে চাইছে। এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাস্তবানুগ এ উদ্যোগকে ক্রীড়াসচেতন মহল সাধুবাদ জানিয়েছে। পাশাপাশি এটাও বলা হচ্ছে, চিহ্নিত প্রতিভাকে কীভাবে কাজে লাগানো হবে— এ বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া উচিত।

বিশ্বের সব দেশেই জাতীয় পর্যায়ে যুব গেমসের নিয়মিত আয়োজন করা হয়। এত বছর ধরে আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ছিল অনুপস্থিত। লক্ষ্যের গুরুত্ব অনুধাবনে অক্ষমতা উদাসীনতা ক্রীড়াঙ্গনের অগ্রযাত্রাকে অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত করেছে—বারবার। বিওএ গেমসের আয়োজন করেছে এতে কোন লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেছে-এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। উদ্দেশ্য ব্যতীত কিছুই সম্ভব নয়। কিছু করলেই যে লক্ষ্যের দিকে যাওয়া হচ্ছে— এটা ভাবার সুযোগ নেই। লক্ষ্যের পথে কতদূর অগ্রসর হওয়া গেল তা জানার জন্য কাজের মূল্যায়ন প্রয়োজন। ক্রীড়া সচেতনতা যত বাড়বে, ততই অনেক কিছুই সহজ হবে।

বিশাল আয়োজন তিনটি স্তরে জেলা বিভাগ এবং জাতীয় পর্যায়ে সবকিছুই ঠিকমতোই হয়েছে বা হবে তা হওয়ার নয়, তবে আগামীতে এগুলো সংশোধিত হবে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে এটাই কাম্য। এ গেমস থেকে নতুন প্রতিভা চিহ্নিত হয়েছে এবং হবে। এদের কীভাবে কাজে লাগোনো হবে সে চিন্তা উদ্যোগ এখন জরুরি। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ক্রীড়াকাঠামোগত এবং বস্তুগত সুযোগ-সুবিধার একটি ছবি বেরিয়ে এসেছে এ গেমের মাধ্যমে। ঢাকার বাইরে উৎসাহী এবং উদ্যমী ক্রীড়া সংগঠক অনেকেই সাধ্যমতোই চেষ্টা করেছেন চমৎকার কাজ করেছেন, লক্ষণীয় হয়েছে পাশাপাশি সাংগঠনিক ক্ষেত্রে সংগঠকদের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশও! আরও লক্ষণীয় হয়েছে দেশজুড়ে খেলার চর্চার সার্বিক অবস্থা ও কোন খেলার কী অবস্থা এবং কোন ধরনের আগ্রহ।

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর