রবিবার, ১১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

রাজনীতিতে সুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতা দরকার

খায়রুল কবীর খোকন

রাজনীতিতে সুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতা দরকার

আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল কি সুস্থ প্রতিযোগিতার রাজনীতি চর্চায় আগ্রহী? কোটি টাকার প্রশ্ন সেটা। বর্তমান সরকারের নয় বছরের শাসনকালে ক্ষমতাসীনদের বিরোধী দলের প্রতি নিদারুণ অসহিষ্ণু আচরণ, বিশেষভাবে মামলা-হামলার মাধ্যমে বিরোধী দলকে ঠাণ্ডা করার মানসিকতা চরমে পৌঁছেছে। অথচ এ দেশটি একাত্তরে এক সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছিল—২৩ বছর টানা গণতন্ত্র-প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের মাধ্যমে পূর্ব-বাংলার বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ের অধ্যায়টি সমাপনের মাধ্যমে। অগণন শহীদের রক্ত-নদী পেরিয়ে,  লাখ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে, লাখ লাখ মানুষের অপরিসীম আত্মত্যাগের ফলে প্রকৃত গণতন্ত্র ও সুশাসন কায়েমের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমৃদ্ধ একটি দেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখে।

কিন্তু আমাদের চরম দুর্ভাগ্য, বলতেই হবে, এখন এখানে গণতন্ত্র আর তার বাণী ‘নীরবে নিভৃতে কাঁদে’। আমাদের রাষ্ট্রটি এখন একটি নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার দ্বারপ্রান্তে এসে এবং মধ্যম আয়ের দেশরূপে প্রতিষ্ঠার কাছাকাছি এসেও এ দেশে সীমাহীন দারিদ্র্যে ধুঁকে মরছে লাখ লাখ মানুষ। আর এরশাদ-স্বৈরাচারকে তাড়ানোর জন্য শত শত ছাত্র-যুবকের শাহাদাতবরণ ও অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর আত্মত্যাগের পরেও এখন অবধি স্বৈরাচার-প্রেতাত্মা বহাল তবিয়তে রয়েছে। অবৈধ ক্ষমতা দখল, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যা, জেনারেল মঞ্জুরকে খুন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অসংখ্য কর্মীকে হত্যা ও নির্যাতনের জন্য রাষ্ট্রের লাখ কোটি টাকার সম্পদ লুণ্ঠন করার অপরাধে, অগণন নারী এবং দেশের অর্থনীতি ও সমগ্র সমাজব্যবস্থার ওপরে সাংস্কৃতিক লাম্পট্য কায়েমের জন্য যে ব্যক্তিটির হাজারবার মৃত্যুদণ্ড হতে পারত সেই স্বৈরাচার এখনো মন্ত্রীর পদমর্যাদায় জাতীয় পতাকা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। জাতির জন্য এটা অপরিসীম লজ্জার। কিন্তু সমগ্র রাষ্ট্রটির সেই লজ্জা কি বর্তমান সরকারের নেতাদের মধ্যে আদৌ কোনো বোধ জাগায়! না, জাগায় না। জাগালে তার তো জেলে থাকার কথা, গাড়িতে জাতীয় পতাকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কথা নয়।

আরও বেশি গ্লানিকর, আমাদের সবার চোখের সামনেই রয়েছে-২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির  নির্বাচন। সেই নির্বাচনের (যেখানে ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ই নির্বাচিত সংসদ সদস্য) তথাকথিত ভোটাভুটিতে (বাকি আসনগুলোতে পাঁচ শতাংশ ভোটারও হাজির হননি ভোটকেন্দ্রে সবারই জানা) নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে গঠিত সরকার দেশ পরিচালনা করে যাচ্ছে চার বছরের বেশি সময় ধরে। এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা নিজে ওই নিয়ম রক্ষার নির্বাচনের পরে, পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে একটা সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বিশ্ব মিডিয়া সাক্ষী। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি, অকাতরে তা ভুলে বসে আছেন, ‘জনগণের মহান নেত্রী’। সামনে নির্বাচন আসছে, এ বছরের মধ্যেই হবে। সেই নির্বাচনটিও নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু করা এবং প্রকৃত অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে বিরোধী দলগুলোর ‘নির্দলীয় সহায়ক সরকারের’ দাবিটি মানার ধারেকাছে আসছে না ক্ষমতাসীন নেতারা। উল্টো ‘উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার’ দোহাই পেড়ে আরেক টার্ম তাদের ক্ষমতায় রাখার আবদার জুড়ে দিচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। যেটার নজির বিশ্ব রাজনীতিতেই নেই। সরকারপক্ষ কি সারা দুনিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলো ঘেঁটে এমন একটা নজিরও দেখাতে পারবেন? পারবেন না, আমরা চ্যালেঞ্জ রাখতে পারি।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে স্বৈরশাসন চালানোর প্রবণতা সব সময়ই ছিল। কারণ, মুসলিম লীগ শাসিত কেন্দ্রীয় সরকার ও পরে সামরিক শাসক আইয়ুব খাঁর সরকার এ দেশে বাঙালিদের নয়া-উপনিবেশবাদী শৃঙ্খলে বেঁধে রাখতে প্রবলভাবে তৎপর ছিল আগাগোড়া। আর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) পশ্চিম পাকিস্তানি সামন্ত-ভূস্বামী ও মোহাজের নেতাদের সঙ্গে রেখে বাঙালি পীড়ন-দমনে তৎপরতা চালিয়ে আসছিল ২৩ বছর ধরে। পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই কখনোই পূর্ব বাংলার নাগরিকদের ‘নির্ভেজাল পাকিস্তানি’ ভাবতে চায়নি, সর্বদাই নয়া-উপনিবেশবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’ প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে।

তৎকালীন পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় শাসকচক্রের হাতে মার খেতে খেতে বিধ্বস্ত হয়েছে— জেল-জুলুম, গুম-খুন সবকিছুরই শিকার হয়েছে। প্রধান রাজনৈতিক শক্তিটির সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির স্বাধিকারকামী যে কোনো বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-শ্রমিক যুব সংগঠন কর্মী ও নেতা অবিরাম নির্যাতিত হয়েছেন কেন্দ্রীয় শাসকচক্র, তাদের নিপীড়ক সংস্থা আইএসআই বা তাদের এজেন্টদের দ্বারা অথবা তাদের এ দেশীয় দালাল গোষ্ঠীর দ্বারা। মজার ব্যাপার হলো, স্বাধীন বাংলাদেশে সেসব নির্যাতিত রাজনীতিকদের একটা বড় অংশই বিরোধী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মী ও নেতাদের নিপীড়ক রূপে আবির্ভূত হয়েছেন—মিথ্যা মামলা, হামলা, গুম, খুন কোনো কিছুতেই তারা পিছপা নন। এসব ব্যক্তি ইতিহাস থেকে কি শিক্ষা নিয়েছিলেন! না, তারা কোনো শিক্ষাই নেননি। নিলে তারা এ নিষ্ঠুর কাজটি করতে পারতেন না। তারা বুঝতে পারতেন—‘বুমেরাং হয়ে তাদের নিপীড়নে তা ফিরে আসতে পারে’।

আজকে আওয়ামী লীগ টানা দুই টার্ম ক্ষমতায় থেকেও সন্তুষ্ট নয়, আরেক টার্ম ক্ষমতা চায় উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার দোহাই পেড়ে। তারা নির্বাচন করতে চান প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে অথবা ওই প্রধান দলটিকে ‘দয়াপরবশ হয়ে কিছু আসন ভিক্ষা দিয়ে’। বিএনপি প্রকৃত গণতন্ত্র কায়েমের স্বার্থে বারবার রাজনৈতিক সমঝোতা চেয়ে আসছে উপযুক্ত সংলাপ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রচণ্ড মার খাচ্ছে তার কর্মী, সংগঠক, নেতারা— জেল-জুলুম, পুলিশি হামলা, সরকারি পেটোয়া বাহিনীর হামলা অবিরাম চলছে তাদের ওপরে, তা সত্ত্বেও বিএনপি সহনশীলতা প্রদর্শন করে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ শীর্ষ নেতৃত্ব কোনোরকম সংলাপে বসতেই রাজি নয়। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন পক্ষ বিরোধী দলের প্রধান নেতা বেগম খালেদা জিয়াসহ সব নেতা-সংগঠকের বিরুদ্ধে এক/দুই/তিন/চার/ বা হাফ ডজন, এমনকি কারও কারও বিরুদ্ধে ডজন ডজন মামলা করে শায়েস্তা করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব মামলার ভিত্তি একেবারেই দুর্বল বোঝাই যায়, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে অত্যন্ত হীনমানসিকতা নিয়ে। আর এ দেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যে ‘খুবই খারাপ দশায়’ তা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। দুনিয়াব্যাপী তুমুল সমালোচনার মুখেও সরকারপক্ষ যুক্তিসঙ্গতভাবে সংযত হয়নি।

এখন বিএনপি যে নির্বাচন সহায়ক সরকারের দাবি তুলেছে তার যৌক্তিকতা কিন্তু প্রমাণিত। ১৯৭৩ সাল থেকে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো নিয়ে বিরোধীপক্ষ কখনো সন্তুষ্ট হতে পারেনি। কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো যে মোটামুটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে, দুনিয়াব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে সেটা তো মিথ্যা নয়। এমনকি ১৯৫৪ সালের পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদের বিখ্যাত নির্বাচনে মুসলিম লীগ বিরোধী হক ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের বিখ্যাত ২১ দফার মধ্যে একটি দফায় এ নির্বাচন সহায়ক সরকারের পক্ষে বক্তব্য রয়েছে। সেখানে নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ছয় মাস আগে মন্ত্রিসভা ও সংসদ (তখনকার প্রাদেশিক পরিষদ) ভেঙে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। কেন তখনকার জাতীয় নেতারা সেটা করেছিলেন? কারণ, দলীয় সরকারের অধীনে (বিশেষভাবে পূর্ববর্তী সরকারের অধীনে) নির্বাচন অনুষ্ঠানের ফলে যে প্রভাব বিস্তার ও নিরপেক্ষতা লঙ্ঘনের আশঙ্কা থাকে তা তারা উপলব্ধি করেছিলেন। যেটা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা (তৎকালীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান) উপলব্ধি করেছিলেন কিন্তু পিতার রাজনীতির অনুসারী সুযোগ্য কন্যা বর্তমান আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা তা মানতে রাজিই নন। তিনি ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ভীত, ভয়ানক সন্ত্রস্ত। তার মতো ঝানু রাজনীতিকের এটা কি মানায়!

শেখ হাসিনা এবং শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কেন ভয় পান, তাদের জনপ্রিয়তা পাকাপোক্ত হয়ে থাকলে তাদের তো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তাহলে তারা ‘নয় বছরব্যাপী ব্যাপক উন্নয়ন’ করেছেন বলে যে দাবি করেন চিৎকার করে তা কি ধোপে টিকে থাকে! আর রাজনীতি করলে কখনো ক্ষমতা পাবেন, জনগণ চাইলে, আর কখনো ক্ষমতা হারাবেন জনগণ যখন ভোট দেবে না, এটা তো চিরন্তন গণতন্ত্রের নিয়ম। এ নিয়মের বাইরে কি চান আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব, সেটা কোন গণতন্ত্র!

কোনো উপায় নেই এবার— বর্তমান সরকারকে নির্বাচন সহায়ক সরকার কায়েমের সুযোগ করে দিতে হবেই এবং তাতেই কেবল সবার জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি হতে পারে। সারাবিশ্ব তাকিয়ে রয়েছে বাংলাদেশে একটা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং প্রকৃত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান দেখার জন্য। কারণ, তারা এ রাষ্ট্রে যে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা দেখতে চায়। তাদের এবং আমাদের ১৭ কোটি মানুষের সবার সেই চাওয়া থেকে ‘অন্যকিছু’ ঘটানোর দুঃসাহস কীভাবে দেখাবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব! আসল কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে ভয় পেলে চলবে না, সবাই দেশপ্রেমিক এটা মেনে নিয়ে সুষ্ঠু রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চালাতে হবে ক্ষমতাসীন পক্ষকে। তাহলে মন থেকে ভয় দূর হবে। আর বেগম খালেদা জিয়া তো বলেই দিয়েছেন, তিনি নির্বাচনে সুষ্ঠু জনভোটের মাধ্যমে বিএনপিকে জেতাতে পারলে কখনো ক্ষমতায় বসে প্রতিশোধমূলক কিছু করবেন না; মানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে জেল-জুলুমের শিকার বানাবেন না যেমনটা হয়েছেন তিনি এবং তার দলের নেতা-কর্মীরা। এরপরে তো আর ভয় পাওয়ার কিছুই থাকে না।

            লেখক : যুগ্ম মহাসচিব-বিএনপি এবং সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর