বুধবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভোটযুদ্ধের ফ্যাক্টর এরশাদ, কৃষকের বন্ধু মঞ্জু

পীর হাবিবুর রহমান

ভোটযুদ্ধের ফ্যাক্টর এরশাদ, কৃষকের বন্ধু মঞ্জু

গেল বছর নববর্ষের আনন্দ স্পর্শ করেনি বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলের কৃষকসহ মানুষকে। এক ফসলি বোরো ফসল বা একমাত্র অর্থনৈতিক উৎস বোরো ফসল অতিবৃষ্টি, অকালবন্যা ও বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে তলিয়ে যায়। এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ফসল হারানোর ট্র্যাজেডি অতীতে কখনো ঘটেনি। তাই নববর্ষ মানুষের জীবনে এসেছিল বিষাদ হয়ে। হতাশার চাদরে ঢাকা পড়েছিল কৃষকের জীবন। স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় চোখজুড়ে অসহায়ত্বের চাউনি। বুকজুড়ে ছিল রিক্ত-নিঃস্ব ফসল হারানো কৃষকের যন্ত্রণাবিদ্ধ কান্না।

সেবার প্রশাসন, রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি কেউ নববর্ষ উদ্যাপন করেনি। সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের মানুষের বুকের তপ্ত নিঃশ্বাস-আর্তনাদ গোটা দেশের মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছিল। গণমাধ্যম রিক্ত-নিঃস্ব ও অসহায় কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছিল। স্বয়ং হাওরে জন্ম নেওয়া রাজনীতির দীর্ঘ পথ হেঁটে আসা রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদ ছুটে গিয়েছিলেন ফসলহারা হাওরাঞ্চলের মানুষের পাশে। কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে।

বিরোধী দলের নেত্রী থাকাকালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ‘কৃষক বাঁচাও দেশ বাঁচাও’ স্লোগান তুলে নরসিংদী থেকে কৃষক সমাবেশের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের শুভসূচনা ঘটিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। ২০০৮ সালের গণরায়ে অভিষিক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন হাওরের রাজধানী সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে। লাখো কৃষকের মধ্যে বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ করেছিলেন। বিনিময়ে তার মুখের হাসি ছড়িয়েছিল কৃষকের মাঝে। ঢেউ খেলানো সবুজ দিগন্ত বিস্তৃত হাওরে ফসলের বাম্পার ফলন নিয়ে কৃষকের ঘর আলোই করেনি, দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণ করেছিল।

গেলবার ফসলহানির মতো ভয়াবহ বিপর্যয় অতীত ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, কেউ না খেয়ে মরবে না। একদিকে আইনের কঠোর খড়্গ নেমেছিল যারা অনিয়ম করেছিল তাদের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে ফসলহারা কৃষকের ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়েছিলেন। কৃষককে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে দিয়েছিলেন সার্বিক সহায়তা। একই সঙ্গে এবার কৃষকের জমি চাষাবাদের আগেই মন্ত্রিসভার রদবদল ঘটিয়ে তার প্রথম শাসনামলের সফল যোগাযোগমন্ত্রী ও এরশাদ সরকারের গুড মিনিস্টার খ্যাত বন ও পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে নিয়ে আসেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে। কৃষকদরদি মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা জানতেন, কৃষকের ফসল বৈরী প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে ঘরে তুলতে হলে কৃষকের বন্ধু কার্যত কৃষিমন্ত্রী নয়, পানিসম্পদমন্ত্রীকেই হতে হয়। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদানের দিনই শেখ হাসিনা সাহসী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ বঙ্গবন্ধুর প্রিয় মানিক ভাইয়ের ছেলে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে হাওরের কৃষকের ফসলের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন।

আনোয়ার হোসেন মঞ্জু দীর্ঘ রাজনীতি, সাংবাদিকতা, সংসদ ও মন্ত্রিত্বের অভিজ্ঞতা নিয়ে আত্মোপলব্ধি করেছেন। কৃষকের জন্য বুকভরা ভালোবাসা আর কোমল হৃদয় নিয়ে তিন দফা ছুটে গেছেন কৃষকের মাঝে। সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা হাওরাঞ্চলের সহজ-সরল কৃষিবান্ধব মানুষের কথা মন দিয়ে শুনেছেন। মন খুলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে কথা বলতে দিয়েছেন। প্রথমবার তিনি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা পালন করতে প্রয়োজনে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে তিন মাসের জন্য সুনামগঞ্জে নিয়ে যাবেন। কৃষকের বন্ধু হয়ে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সেই কথা রেখেছেন। প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বাইরে ঠিকাদারি প্রথা নয়, স্থানীয় সরকার, মাঠ প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তদারকির সমন্বয় ঘটিয়ে বাঁধ নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। পলি পড়ে জলাবদ্ধতা যাতে অকালবন্যার আগমনে ফসল তলিয়ে নিতে না পারে সেজন্য ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করে ভৈরবে পানি বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

গেল বছর যেখানে প্রায় ৪০ কোটি টাকা বাঁধ নির্মাণে বরাদ্দ হয়েছিল, সেখানে এবার প্রধানমন্ত্রীর উদার মনোভাবের ফলে ১২০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। যদিও অনেক জায়গায় ধানের চেয়ে বাঁধ নির্মাণে খরচ হয়েছে, সরকারদলীয় জনপ্রতিনিধিদের পছন্দের লোকেরা মুনাফা লুটেছেন। তবুও বাঁধ নির্মাণে কোনো ঘাটতি দেখা যায়নি। সর্বশেষ হাওরাঞ্চল সফরকালে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেছেন, ‘আমরা সকল পর্যায়ের মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। মহান আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের সেই ফল দেবেন।’ পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর পাগলের মতো হাওরে ছুটে যাওয়া, কৃষক ও মানুষের সঙ্গে একাত্ম হওয়া এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন একজন মন্ত্রী আন্তরিক হলে, দক্ষ হলে আর যাই হোক মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারেন।

ইতিমধ্যে ধানের জাত বিআর-২৮ কাটা প্রায় শেষ পর্যায়ে। হাওরের উঁচু জমিতে আবাদ করা এ ধান কাটার মধ্য দিয়ে কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। আর সাত-দশ দিনের মধ্যে কৃষকের ঘরে বিআর-২৯ জাতের ধানও উঠে যাবে। কৃষকের চোখজুড়ে এখন আনন্দের দ্যুতি। বাম্পার ফলনের বিস্ময়কর সম্ভাবনার প্রাণখোলা আনন্দের হাসি। কৃষকের মুখে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাঁর প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে দিয়ে হাসি ফুটিয়ে তুলেছেন। কৃষকের ঘরে ঘরে এখন নববর্ষের আনন্দ। বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলের মানুষের ঘরে ঘরে এখন ফসল তোলার আনন্দ। ধান কাটার মহানন্দে ভাসছে হাওরের লড়াকু কৃষকের মন।

সুনামগঞ্জেই এবার ২ লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে ফসল ফলানো হয়েছে। সবুজ ধান খেত সোনার রং ধারণ করেছে। পক্ষকালের মধ্যে ১৩ লাখ টন ধান কৃষকের ঘরে উঠবে। নবান্নের উৎসব এখন হাওরের মানুষের মাঝে। এক ফসলি বোরো ধান ঘরে তোলার মধ্য দিয়ে, বাম্পার ফলনের সাফল্য ঘরে তোলার মধ্য দিয়ে, কৃষকের চোখজুড়ে সারা বছরের অর্থনৈতিক শক্তি দৃঢ় করার স্বপ্ন খেলা করছে। পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু তার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে নিয়মিত সুনামগঞ্জ ও হাওরের উপকূলবর্তী পাহাড়ি অঞ্চলের ভারতীয় আবহাওয়া বার্তা পর্যবেক্ষণ করছেন।

পানিসম্পদমন্ত্রী মঞ্জু স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখছেন। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক একজন আদর্শিক চিরসংগ্রামী, রাজনৈতিক নেতার সন্তান সাবিরুল ইসলাম বিপ্লব কৃষকের ফসলের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করেছেন। মন্ত্রণালয়, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, কৃষক ও হাওরের মানুষ ফসল ঘরে তোলার লড়াইয়ে এক গণজাগরণ ঘটিয়েছে।

শান্তিপূর্ণ ও বর্ণাঢ্য উৎসবমুখর পরিবেশে এবার ১৪২৫ বাংলার পয়লা বৈশাখ বাঙালি জাতির সর্ববৃহৎ বর্ষবরণের মহোৎসব হয়ে গেল। সাতসকালে রমনার বটমূলে ছায়ানটের সুরের ধারা, চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা, পথে পথে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত শিশু-কিশোর, তরুণ ও বৃদ্ধদের আনন্দ-উচ্ছল অংশগ্রহণ, লাল-সাদা শাড়ি পরিহিতা শিশু-কিশোরী, তরুণী ও রমণীদের গলায় মালা, কানে দুল, কপালে লাল টিপ শোভিত সাজসজ্জার এ উৎসব নগর থেকে লোকালয়, শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়েছে। বাউলের গানের আসর বসেছে। বসেছে মেলা। নাগরদোলা থেকে লাঠিখেলা, ষাঁড়ের লড়াই কোনো আনন্দ আয়োজনই বাদ যায়নি। বিকালে বৃষ্টি ও ঝড় নামলেও কালবৈশাখীর তাণ্ডব সইতে হয়নি মানুষকে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক নবজাগরণে উদ্বেল-উত্তাল পয়লা বৈশাখ ঘিরে গোটা জাতি সব মত-পথ ভুলে গিয়ে এক মোহনায় মিলিত হয়েছিল। নির্বিঘ্নে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছাড়া উৎসবমুখর পরিবেশে নববর্ষ শেষ হওয়ায় বাইরে না বেরোলেও আনন্দ-তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছি।

আজকাল ইউটিউব খুললেই একদল ধর্মান্ধ তথাকথিত হুজুরের ওয়াজ শুনতে শুনতে ভয়ে গা শিউরে ওঠে। পয়লা বৈশাখকে তারা হিন্দুদের পূজা বলে ধর্মবিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন। বুঝতে পারি না, গ্রামগঞ্জের এ ওয়াজ করা হুজুরদের বেলায় তথ্যপ্রযুক্তি আইন ৫৭ ধারা বা ডিজিটাল অ্যাক্ট ৩২ কোথায় থাকে?

ওপারে আনন্দবাজার পত্রিকা খবরে বাড়াবাড়ি রং মাখিয়ে উসকানি দেয়। এপারে একদল মূর্খ ধর্মের নামে ভুল ব্যাখ্যায় সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ায়। কার স্বার্থে কেন তারা এমনটি করে বুঝতে পারি না। ধর্মান্ধ বিদ্বেষ ও নাস্তিকতার নামে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত কার্যত বাংলাদেশের উদার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনকে শিথিল করে।

মুক্তিযুদ্ধকালে আমার বয়স ছিল সাত-আট। এখনো মনে পড়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর আক্রমণের মুখে ঘরবাড়ি ফেলে আমরা যখন সীমান্ত এলাকায় আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। মাকে মা, বাবাকে বাবা ডাকছি বলে এক আত্মীয় ভর্ত্সনা করেছিলেন। তাচ্ছিল্য করে জানতে চেয়েছিলেন, আমরা হিন্দুদের মতো মা-বাবা কেন ডাকি।

আমাদের পরিবার ধর্মভীরু। মা-বাবার নামাজ কখনো কাজা হতে দেখিনি। মা-বাবা ও বোনদের নিয়মিত কোরআন তিলাওয়াতে কোনো দিন ছন্দপতন হতে দেখিনি। আল্লাহতায়ালার কাছে আত্মসমর্পণ করা মা-বাবা আমাদের ধর্মবর্ণনির্বিশেষে গভীর আত্মীয়তার বন্ধনে পাড়া-পড়শি সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলার উদার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ এবং স্বাধীনতা দিয়েছিলেন বলে তাদের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। মা-বাবা ডাকার কারণে যে আত্মীয় তিরস্কার করেছিলেন, তাকে কোনো দিন ক্ষমা করতে না পারলেও তার মৃত্যুর পর চেয়েছি, আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন। ধর্মের নামে পাকিস্তান আমলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের ভারতের দালাল ও হিন্দুত্ববাদী বলে অভিযুক্ত করার চেষ্টা হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ধর্মের নামে সংখ্যালঘুরা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দাসত্ববরণ করে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো পাপাচারে নিমজ্জিত হয়েছে।

ধর্মের নামে মনস্তাত্ত্বিক বিকৃতির উন্নাসিক আস্ফাালন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যেমন ঘটেছে, মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার আমলেও তাদের ওয়াজ-ফতোয়াদান বহাল রয়েছে। পয়লা বৈশাখে মুসলমানরা পাঞ্জাবি পরলে জাহান্নামি হবে এমন মূর্খ বয়ান অনেকে দিচ্ছেন। যেন বিচারের মালিক আল্লাহ শাস্তির রায় ও বেহেশতে যাওয়ার টিকিট এসব গ্রাম্য মোল্লার হাতে দিয়েছেন। ধর্মের নামে এ উগ্রতা, মিথ্যাচার, হঠকারিতা সমাজে বিষের বাতাস ছড়াচ্ছে।

একসময় দেখতাম আলেম-ওলামারা ইসলামের বাণী প্রচার করতেন। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রতিষ্ঠা, ইমানি মনোবল সুদৃঢ় করা, নিয়মিত নামাজ পড়া, সত্য কথা বলা, সৎ পথে চলা, পাড়া-পড়শি গরিব-মিসকিনদের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ানোর মতো মানবতাবাদী ধর্মীয় চিন্তাভাবনার আলোকিত পথ দেখাতেন। অহংকার ও পরনিন্দা পরিত্যাগ করার তাগিদ দিতেন। ঘুষ-দুর্নীতি ও পাপাচারের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। সেসব আলেমের অনুপস্থিতি দিনে দিনে ঘটেছে।

এখন একদল কাঠমোল্লা আবির্ভূত হয়েছে। যাদের জ্ঞানের পরিধি ওয়াজ শুনলেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। কেউ কেউ হিন্দি গান পরিবেশন করছে। কেউ বা আইয়ুব বাচ্চুর ব্যান্ডসংগীতও গাইছে। নামের সঙ্গে ‘জিহাদি’ যুক্ত করে ওয়াজের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষের বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সামাজিক শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে এমন উসকানিও দিচ্ছে। তারা ভুলে যাচ্ছে এটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হলেও সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ, সব শ্রেণি-পেশার বীর জনতা আত্মত্যাগই করেনি, বীরত্বের লড়াই করে জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে ও নেতৃত্বে এ দেশ স্বাধীন করেছে।

একাত্তরের রক্তঋণে বাঁধা অঙ্গীকার হচ্ছে, একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। এ চেতনার জায়গায় ধর্মের নামে যারা আঘাত করছে তাদের বিষয়ে সব মহলকেই সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এখন সময় দরজায় কড়া নাড়ছে।

জীবনের পড়ন্ত বেলায় আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সাবেক সেনাশাসক ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ তার দল নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। নব্বইয়ের গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত ’৯১ ও ’৯৬ সালের নির্বাচনে কারাগারে বসে পাঁচটি আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন। রংপুর তার রাজনৈতিক দুর্গ সেটি প্রমাণ করেছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের কঠিন দমননীতির মুখে পতিত জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞাই জারি হয়নি, অসংখ্য নেতা-কর্মী ছিলেন পলাতক, নয় জেলবন্দী। টেলিভিশন ভাষণের সুযোগ এরশাদকে দেওয়া হয়নি। তবু অসম ভোটযুদ্ধে জাতীয় পার্টি ৩৫টি করে আসনে জয়লাভ করেছিল।

’৯৯ সালে চারদলীয় জোটে যাওয়ায় এরশাদকে ফের কারাবরণ করতে হয় এবং নির্বাচন করার যোগ্যতা হারাতে হয়। জোট থেকে বেরিয়ে ঝড়ের কবলে পতিত বিভ্রান্ত-বিধ্বস্ত জাতীয় পার্টি ১৪টি আসনে জয়লাভ করলেও এরশাদকে কখনো কোনো শাসক স্বাধীনভাবে রাজনীতির অধিকার দিতে পারেননি। যখনই এরশাদ সরকারবিরোধী অবস্থান নিতে গেছেন তখনই তার ঘুমন্ত মামলা জেগে উঠেছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের অংশীদার হয়ে এরশাদের জাতীয় পার্টি ২৮টি আসনে জয়লাভ করেছিল। তবুও হাত-পা খুলে তাকে সাঁতার কাটতে দেওয়া হয়নি।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ বর্জন নাটকীয়তার ভিতর দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ সংসদে ৪০টি আসন নিয়ে এখনো রাজনীতির ময়দানে বহাল রয়েছে। ভোটরাজনীতিতে এরশাদের জাতীয় পার্টি বড় ব্যবধানে হলেও তৃতীয় বৃহত্তম দলই নয়, মেয়র নির্বাচন ও উপনির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছে এখনো রংপুর এরশাদের ও জাপা তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল।

আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে অযোগ্যই নয়, কারাদহন ভোগ করছেন। তার পুত্র বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মামলায় দণ্ডিত, নির্বাচনে অযোগ্যই নয়, নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। বিএনপি নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। মানুষের মধ্যে সরকারবিরোধী অসন্তোষ থাকলেও বিএনপি ঐক্যবদ্ধভাবে জাতীয় নির্বাচনে ভোটযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ নিতে পারবে এমন আলামত এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। সরকারবিরোধী যে জায়গাটিতে গণমানুষের মধ্যে বিএনপি অবস্থান নিয়েছিল, সেখানে দলটি দমন-পীড়ন ও কারাদহনে পতিত হওয়ায় এরশাদ ও জাতীয় পার্টি সেখানে দাঁড়াতে চাইছে। সরকারবিরোধী সমালোচনায় মুখর হয়ে স্লোগান তুলেছে, এইবার এরশাদের সরকার।

জীবনের পড়ন্ত বেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২৪ মার্চ এরশাদ বিশাল সমাবেশ-শোডাউন করেছেন। বলেছেন, আগামী নির্বাচনে ইতিহাস গড়বেন তিনি। আগামীতে সিলেট শহরে বড় শোডাউন করতে যাচ্ছেন। চট্টগ্রামেও করেছেন। দলের মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ঘুমন্ত জাপাকে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে জাগিয়ে তুলছেন। এরশাদের পাশে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, রুহুল আমিন হাওলাদার, জিয়াউদ্দিন বাবলু ও কাজী ফিরোজ রশীদরা ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়েছেন। রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের তো আছেনই।

৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার চিন্তা করে মোটা নির্বাচনী বাজেটের সন্ধানে রয়েছে জাপা। এরশাদ বলেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় গেলে তার পার্টিকে ৭০টি আসন ও ১০টি মন্ত্রণালয় দিতে হবে। বিএনপি নির্বাচনে এলে এক রকম না এলে এরশাদ তার জাতীয় পার্টি নিয়ে আরেক রকম খেলবেন। জীবনের শেষ খেলায় এরশাদ জাতীয় পার্টিকে ফ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত করিয়েছেন। সামনে ভোটরাজনীতির গতিপ্রকৃতি তফসিল ঘোষণার আগে পর্যন্ত এক রকম, ঘোষণার পর আরেক রকম দেখা যাবে। পর্যবেক্ষকরা শেষ দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি ডট নিউজ

 

 

সর্বশেষ খবর