শুক্রবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

নতুন স্নায়ুযুদ্ধ কি পারমাণবিক যুদ্ধের রূপ নেবে

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

নতুন স্নায়ুযুদ্ধ কি পারমাণবিক যুদ্ধের রূপ নেবে

মার্চের শুরুর দিকে ব্রিটেনের উইল্টশায়ার কাউন্টির সেলিসবারি শহরে সাবেক রুশ গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপাল ও তার মেয়ে ইউলিয়া স্ক্রিপাল বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তদন্ত ছাড়াই কোনোরকম কালক্ষেপণ না করে এই আক্রমণের জন্য ব্রিটেন সরাসরি অভিযোগ উত্থাপন করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং নিজে পার্লামেন্টে বক্তৃতার সময় হুমকি দেন এর জন্য রাশিয়াকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। একই সঙ্গে তেরেসা মে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের কড়া সমালোচনা করেন। তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ ব্রিটেনের সঙ্গে একই সুরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবার্তা প্রদান করে। তাতে মনে হয়েছে পুরনো স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার মতো ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলো সম্মিলিতভাবে একটা সমন্বিত প্রোপাগান্ডা যুদ্ধ শুরু করে দিল রাশিয়ার বিরুদ্ধে। কিন্তু রাশিয়া অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি কূটনীতিক বহিষ্কার শুরু হয়। তবে বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির খবর যারা রাখেন, তারা উপরোক্ত ঘটনাকে মোটেই বিচ্ছিন্ন হিসেবে দেখছেন না। কয়েক বছর ধরে, বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের দেশ ও ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ইউক্রেনের ক্রিমিয়া রাশিয়া কর্তৃক ২০১৪ সালের মার্চে দখল নেওয়ার পর থেকে ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের ইস্যু এবং উত্তর কোরিয়াকে কেন্দ্র করে যা কিছু ঘটেছে সেগুলো স্পষ্টই বার্তা দেয় আগের মতো বিশ্বে আবার দুটি জোটের উত্পত্তি ঘটেছে, যার একদিকে আছে রাশিয়া, সঙ্গে চীন আর অন্য পাশে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের দেশসমূহ। এই বিভাজন গত শতকের নব্বই দশকের আগের সেই পুঁজিবাদ ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের স্নায়ুযুদ্ধের কথাই নতুন করে বিশ্লেষকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। ইতিমধ্যে চীন-রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় চরিত্রের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের জন্য বহুলাংশে চীন দায়ী। স্ট্যালিনের অবমাননাকর আচরণ ও ক্রুশ্চেভের সংশোধনবাদের কারণে ভীষণ খেপে গিয়ে মাও সে তুং ষাট দশকে সোভিয়েতের প্রধানমন্ত্রী কোচিগিনকে বলেছিলেন, প্রয়োজন হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে চীন ৯ হাজার বছর যুদ্ধ করবে। হেনরি কিসিঞ্জার তার লিখিত হেনরি কিসিঞ্জার অন চায়না গ্রন্থে এসব কথার উল্লেখ করেছেন। তার পরও নতুন বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির স্বার্থগত সমীকরণের হিসাবে চীন-রাশিয়া আবার এক প্লাটফরমে এসে দাঁড়িয়েছে। নতুন এই ভূ-রাজনীতির সমীকরণ এবং তার পরিণতিতে স্নায়ুযুদ্ধের নতুন পদধ্বনি আগের স্নায়ুযুদ্ধের সময় যতটুকু না শঙ্কিত করেছে তার থেকে বিশ্বের মানুষ আজ বেশি শঙ্কিত। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির এক ধরনের সীমাহীন শক্তি, পুঁজিবাদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্বশক্তির প্রভাববলয় বিস্তারের লড়াই যেভাবে এগোচ্ছে এবং উত্তর কোরিয়া, ইসরায়েল ও পাকিস্তানের মতো উন্মাদ-ধর্মান্ধ রাষ্ট্রের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকায় মানুষের ভীতি ও শঙ্কা আগের তুলনায় বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে সে সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ করার জন্য স্নায়ুযুদ্ধের শুরু, শেষ ও পুনরুত্থানের প্রেক্ষাপটটি প্রসঙ্গের খাতিরে উল্লেখ করা প্রয়োজন। ১৯৪৫ সালের ৮ মে হিটলারের চূড়ান্ত পরাজয় ও আত্মহত্যার পর জুলাইয়ে জার্মানের পোটস্ডাম শহরে বসলেন চার্চিল, স্ট্যালিন এবং আমেরিকান নতুন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুমান। মূল বিষয় ইউরোপের নতুন মানচিত্রের বিন্যাস সম্পর্কে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত। জার্মানিকে ভাগ করে বার্লিন দেয়াল নির্মাণে তিনজনই রাজি হলেন। কিন্তু স্ট্যালিন পোলান্ডের কর্তৃত্ব দাবি করলে ট্রুম্যান প্রচণ্ড বেঁকে বসেন। তীব্র বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে ট্রুম্যান তার তুরুপের তাসটি বের করেন। আমেরিকা কর্তৃক পারমাণবিক বোমার আবিষ্কার ও তার সফল পরীক্ষার খবর প্রকাশ করে দেন সভার মাঝখানে। আগস্টের ৬ ও ৯ তারিখে যথাক্রমে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে ট্রুম্যান স্ট্যালিনকে বুঝিয়ে দেন কোনো ছাড়ই আর দেওয়া হবে না। পারমাণবিক বোমার ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা দেখে আমেরিকাকে মোকাবিলার জন্য স্ট্যালিন পারমাণবিক বোমা তৈরির ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেন। তারপর বিশ্বমঞ্চে অনেক কিছু ঘটেছে। কয়েকবার পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসেছে। কিন্তু একসময় তো স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। তাহলে কেন আজ আবার নতুন করে বিশ্ববাসীকে স্নায়ুযুদ্ধের সাইরেন শুনতে হচ্ছে। সেটাই এখন বোঝার বিষয়। প্রথমত, ন্যাটো সামরিক জোটের পূর্বদিকে ক্রমে আগ্রাসী বিস্তার, পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহে (সাবেক ওয়ারশ সামরিক জোটের সদস্য) ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক সামরিক উপস্থিতি, আফগানিস্তানসহ মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশে আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি ও সুবিধা, এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চল ঘিরে আমেরিকার নয়া সামরিক কৌশল ইত্যাদি কারণে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতায় আসার পর রাশিয়ার ঘুরে দাঁড়ানো, বিশ্বশক্তি হিসেবে চীনের ক্রম উত্থান এবং চীন-রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতাকে পশ্চিমা বিশ্ব পাল্টা হুমকি হিসেবে দেখছে। স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর গত ২৭ বছরে আমেরিকা ও ন্যাটো বাহিনীর পূর্ব দিকে যেভাবে সম্প্রসারণ ও বিস্তার ঘটেছে তাতে এখন মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায় চীনের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে কাজাখস্তান-কিরগিজস্তান থেকে শুরু করে কাসপিয়ান, কৃষ্ণ ও বাল্টিক সাগর পর্যন্ত চীন-রাশিয়ার পুরো উত্তর সীমান্তজুড়ে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্র একটা নিরবচ্ছিন্ন সামরিক বেষ্টনী তৈরি করেছে। আর চীনের পূর্বে প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চলে জাপান থেকে শুরু করে দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া হয়ে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত বড় বড় সামরিক ঘাঁটি ও উপস্থিতির মাধ্যমে চীনের পূর্ব দিকেও আরেকটি সামরিক বেষ্টনী সৃষ্টি করে রেখেছে আমেরিকা। আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের মূল লক্ষ্য চীনকে ঘিরে ফেলা হলেও চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাশিয়াকে প্রবল চাপের মধ্যে রাখা আবশ্যক। ২০০০ সালে ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে পশ্চিমা বিশ্বের একচ্ছত্র কর্তৃত্বের দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করে, যার গতি আরও বৃদ্ধি পায় ২০১২ সালে শি জিন পিং চীনের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সুবাদে। এর প্রত্যক্ষ প্রতিফলন দেখা যায়, ২০১৪ সালের মার্চে যখন ইউক্রেনের রাজ্য ক্রিমিয়া দখল করে রাশিয়া হজম করে ফেলতে সক্ষম হয়। এরপর ২০১৫ সাল থেকে আগের স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের মতো রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, কূটনীতি ও সামরিক ইস্যুতে প্রভাব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য পুরোদমে নেমে পড়ে। ২০১৮ সালে এসে এখন স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, রাশিয়া তার মিশনে অনেকখানিই সফল হয়েছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আঙ্কারায় প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগান আলিঙ্গন করে হাত মিলিয়েছেন একসময়ের শত্রু রাশিয়ার পুতিন আর ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে। ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য হয়েও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট যখন রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে একই সুরে কথা বলেন তখন সংগত কারণেই আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের ভাবনার কারণ আছে। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর কোরিয়ার ইস্যুতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন আপাতত কিছুটা পিছু হটেছে বলে মনে হলেও এসব অঞ্চলে তাদের সামরিক শক্তির ক্রমবৃদ্ধি প্রমাণ করে চীন ও রাশিয়াকে তারা মাঠ ছেড়ে দেবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার টিমের দুই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী ব্যক্তি মধ্যপন্থি রেক্স টিলারসন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল ম্যাকমাস্টারকে সরিয়ে দিয়ে তাদের স্থলে দুই কট্টরপন্থি যথাক্রমে মাইক পম্পে ও জন বোল্টনকে নিযুক্তি দেওয়ায় বিশ্লেষকরা মনে করছেন আমেরিকা যে কোনো সময়ে ট্যাকটিক্যাল (কম ক্ষতি নয় এমন) পারমাণবিক বোমা দ্বারা উত্তর কোরিয়া ও ইরানের ওপর আকস্মিক আক্রমণ চালাতে পারে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে জন বোল্টন লিখেছেন, নিজেদের স্বার্থরক্ষায় উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে প্রথমেই পারমাণবিক আঘাত হানা আইনসম্মত। তিনি আরও বলেছেন, ইরানের হুমকিকে মোটেই ছোট করে দেখা যাবে না। কারণ তাহলে উত্তর কোরিয়ার সহযোগিতায় ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়ে ফেলবে। ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় বলেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার প্রথম হুকুম ছিল, আমাদের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারকে আরও আধুনিক ও সমৃদ্ধ করতে হবে। অন্যদিকে ইহুদি লবির প্রভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ প্রতিরোধ চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথা জোরেশোরে বলছে। এমনটি হলে ইরান অতি দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে চাইবে। পারমাণবিক বোমাকেই তখন ইরান নিজেদের রক্ষাকবচ হিসেবে দেখবে, যেমনটি দেখছেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। তখন সৌদি আরব পাগল হয়ে যাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য, যে কথা ইতিমধ্যে বলেছেন সৌদি যুবরাজ— সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মুহাম্মদ বিন সালমান। যাকে পশ্চিমা বিশ্ব আদর করে ডাকছে এমবিএস। ইরানের চিরশত্রু ইসরায়েলের হাতে অনেক আগে থেকেই পারমাণবিক বোমা রয়েছে। এমবিএস ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের পক্ষে কথা বলা শুরু করেছেন। সম্প্রতি আমেরিকায় বসে বলেছেন, ইসরায়েলিদেরও নিজ ভূমিতে বসবাস করার অধিকার রয়েছে। সুতরাং সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়, রাশিয়ার এক ভূতপূর্ব গুপ্তচর ও তার মেয়ের ওপর রাসায়নিক অস্ত্রের আক্রমণ ঘিরে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে তা যদি নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হয় তাহলে সেই স্নায়ুযুদ্ধ শুধুই স্নায়ুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না বলে মন্তব্য করছেন বড় বড় বিশ্লেষক। তাদের মতে, বিশ্ব পরিস্থিতি ক্রমাগত একটা ভয়ঙ্কর পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর