বিকালে খবর এলো আমাকে আজই দার্জিলিং যেতে হবে। কাজটা অত্যন্ত জরুরি, আগামীকাল দুপুরে মিটিং। ইদানীং ট্রেনে যাতায়াত করি না। দার্জিলিং মেলের টিকিট চাইলেই পাওয়া যায় না। তা ছাড়া চৌদ্দ ঘণ্টা একা ট্রেনে বসে থাকতে একদম ভালো লাগে না। টেলিফোন করে জানলাম, আজকের ফ্লাইট চলে গেছে। কাল বাগডোগরায় কোনো প্লেন যাবে না। অতএব অস্বস্তি হলেও কোনো উপায় নেই। বেয়ারাকে পাঠালাম স্টেশনে। সে টিকিট কেটে রাখবে। শুনেছি টিটিকে অনুরোধ করলে বার্থ পাওয়া যায়।
আমার বেয়ারা যে এত তৎপর জানতাম না। সে মাত্র তিরিশ টাকা অতিরিক্ত দিয়ে একটি সেকেন্ড ক্লাস থ্রি-টায়ার বার্থ জোগাড় করে ফেলেছে। এককালে জলপাইগুড়ি থেকে প্রতি বছরে বার-দুয়েক যাওয়া-আসা করতাম জেনারেল কম্পার্টমেন্টে, রিজারভেশন ছাড়াই। সে বড় আনন্দের দিন ছিল। কলেজের বন্ধুদের নিয়ে সেসব যাত্রায় দারুণ মজা হতো। তারপর সেকেন্ড ক্লাস রিজারভেশন, পরে ফার্স্ট ক্লাস অথবা এসি ছাড়া যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না। সেকেন্ড ক্লাসের টয়লেটে যাওয়া যায় না, অবিরত কিচিরমিচির, জোর করে সিট দখল করা, ভোরে মুখ ধোয়ার জল পাওয়া যায় না। বেয়ারার হাত থেকে টিকিট নিয়ে অসহায় চোখে তাকালাম। ও ভেবেছিল এখন আনন্দিত হয়ে বাহ্বা দেব।
ট্রেনটা দাঁড়িয়ে ছিল। ভিড় উপচে পড়ছে। যত লোক যাবে তত লোক তুলতে এসেছে। নির্দিষ্ট কামরায় উঠে সিট খুঁজে খুঁজে আমি হতভম্ব। একেবারে টয়লেটের সামনে আমাকে চৌদ্দ ঘণ্টা কাটাতে হবে। এখনই দুর্গন্ধ ছুটে আসছে। এভাবে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ভাবলাম নিচে নেমে টিটিকে বলে বার্থটা পাল্টে নিই।সেকেন্ড ক্লাসের টিটির সামনে যাওয়ার উপায় নেই। চাক-ঘিরে-থাকা মৌমাছিদের মতো বার্থবিহীন যাত্রীরা তাকে অনুরোধ করে যাচ্ছেন সমানে। ট্রেন ছাড়ার আগেই লোকটা নিশ্চয়ই খালি বার্থগুলোর দখল দিয়ে দেবে। কী করা যায়?
দূর থেকেই দেখতে পেলাম এক মোটাসোটা গোলগাল টিকিট চেকার আসছেন। বিনা বার্থের যাত্রীরা তাকে দেখে ছুটে যাচ্ছে আবার তত্ক্ষণাৎ উত্তর শুনে ছিটকে যাচ্ছে যেন। বোঝা যাচ্ছে বার্থ দেওয়ার ক্ষমতা এর নেই। আমার সামনে এসে যেন থমকে উঠেই দাঁড়িয়ে পড়ে হাতজোড় করলেন, ‘আরে আপনি স্যার? কেমন আছেন? কোথায় যাচ্ছেন?’
গোলগাল, মাংসল মুখ, মাথায় বিস্তর টাক, কালো কোট-পরা মানুষটিকে আমি আগে কখনো দেখিনি। কিন্তু ইদানীং প্রায়ই ধরা পড়ছে আমার স্মৃতি মধ্যে মধ্যে বেইমানি করে। কী লজ্জাজনক অবস্থা হয় তখন। হয়তো এঁর সঙ্গে কখনো আলাপ হয়েছিল— হেসে বললাম, ‘যাব তো শিলিগুড়ি কিন্তু এত বিচ্ছিরি বার্থ পেয়েছি...।’ আমি কথা শেষ করলাম না। ভঙ্গিতে বোঝাবার চেষ্টা করলাম আমার একটা ভালো বার্থ চাই।
‘দিন, ব্যাগটা আমাকে দিন। আরে দিন না। আসুন আমার সঙ্গে।’
আমি ব্যাগ হাতছাড়া না করে ওঁর সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। উনি হনহনিয়ে হাঁটছেন। দুই পাশ থেকে অনুরোধ আসছে আর উনি নিঃশব্দে হাসিমুখে মাথা নেড়ে হেঁটে চলেছেন। এই হাসি মহাপুরুষ ছবিতে চারুপ্রকাশ ঘোষ হাসতে পেরেছিলেন।
সেকেন্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্ট ছাড়িয়ে ফার্স্টক্লাস এলো। ভদ্রলোক যদি ফার্স্টক্লাসের চেকার হন তাহলে আমার টিকিটটা অ্যাডজাস্ট করে নেব। কিন্তু উনি ফার্স্টক্লাসও পেরিয়ে গেলেন। দার্জিলিং মেল যে এত লম্বা হয় আমার জানা ছিল না। এসি ফার্স্টক্লাসের সামনে পৌঁছে উনি হাত বাড়ালেন, ‘এবার ব্যাগটা আমাকে দিন স্যার।’
আমি একটু দ্বিধায় পড়লাম। জীবনে কখনো এসি ফার্স্টক্লাসে উঠিনি। শুনেছি এখানকার ভাড়া প্লেন ভাড়ার সমান। প্লেনে চড়তে যার আপত্তি নেই তার কেন এসি ফার্স্টক্লাসে আপত্তি? আসলে প্রথমে নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেসে, পরে দার্জিলিং মেলে গত তিরিশ বছর ধরে দ্বিতীয় অথবা প্রথম শ্রেণিতে যাতায়াত করতে করতে একটা মানসিক স্থিতি এসে গেছে, তা এতক্ষণে টের পাচ্ছি। চব্বিশ ডলার দিয়ে বিদেশি পারফিউম নিতে অসুবিধে হয় না, কিন্তু হাজার টাকার আতর মরে গেলেও কিনব না। অনেকটা এ রকম। ভদ্রলোক তাহলে এসি ফার্স্টক্লাসের টিকিট চেকার অথবা কন্ডাক্টর। আমাকে যত্ন করে যে কুপেতে বসালেন সেখানে আর কোনো যাত্রী নেই। পায়ের তলায় কার্পেট। বাইরের গরম, হল্লা কিছুই এখানে ঢুকছে না। ব্যাগ সিটের নিচে চালান করে হাত ঝেড়ে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী খাবেন স্যার, বলুন।’
আমি দ্রুত মাথা নাড়লাম, ‘না না, কিছুই দরকার নেই।’
‘তা কি হয়! এত দিন পরে আপনাকে পেয়েছি।’ পর্দা টেনে নিয়ে ভদ্রলোক চলে গেলেন। আমি হতভম্ব। এত দিন পরে মানে? কোথায় দেখা হয়েছিল ওঁর সঙ্গে? এখন এই অবস্থায় সে কথা জিজ্ঞাসা করি কী করে? অস্বস্তি বাড়ছিল। এ রকম উপচেপড়া ভিড়ের ট্রেনে আমি একটু আগে যে অবস্থায় ছিলাম আর এখন যেভাবে আছি, তা কল্পনাও করা যায় না। সবে একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখটান দিচ্ছি এ সময় দরজায় শব্দ হলো। ভদ্রলোক উঁকি মারলেন, ‘স্যার, একজন মহিলা, মানে লেডি যদি এখানে ঢোকেন, তাহলে কি আপনার খুব অসুবিধে হবে?’ প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দিলেন, ‘হবে না মনে হয়। এই বার্থগুলো তো খালি রয়েছে। অ্যাই কোলি, সামান নামাও।’
হুকুম দেওয়া মাত্র কুলি দুটো ভারী স্যুটকেস ঢোকাল। তাদের চেহারা এত বড় যে, সিটের নিচে ঢুকছিল না। একপাশে সরিয়ে রাখতে হলো। করিডোরে মহিলার মিহি গলা শুনতে পেলাম, ‘কত দিতে হবে ভাই?’
কুলি বলল, ‘পঞ্চাশ’।
সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক ধমকালেন, ‘মারব গালে থাপ্পড়। পঞ্চাশ! চল্লিশ নে হতভাগা। মেয়েছেলে পেয়ে ঠকিয়ে নেওয়ার চেষ্টা? ম্যাডাম, চল্লিশ দিন।’
‘আমি মেয়েছেলে না, ম্যাডাম!’ গলার স্বর তীক্ষ হলো। বুঝলাম যিনি আসছেন তিনি লবঙ্গলতিকা নন।
ভদ্রলোক বললেন, ‘হেঁহেঁ। ঘরের মানুষকে বলতে বলতে মুখ ফসকে এখানে বলে ফেলেছি ম্যাডাম।’
কথাবার্তায় বুঝলাম মহিলা তিরিশ টাকায় কুলিকে বিদায় করলেন। ‘আপনাকে কত দিতে হবে বলুন?’
‘ফাইভ হানড্রেড ফিফটি।’
‘গতবার তো পঞ্চাশ কম নিয়েছিলেন।’
‘জিনিসপত্রের দাম যেভাবে হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে, আচ্ছা পঞ্চাশ কম দিন। আপনি হলেন যাকে বলে পুরনো কাস্টমার।’ আমার দিকে পেছন ফিরে ভদ্রলোক টাকা পকেটে নিয়ে চলে গেলেন দ্রুত। এতক্ষণ তাঁর শরীর আড়াল করে ছিল, আড়াল সরে যেতে মহিলাকে দেখতে পেলাম। অন্তত পাঁচ-ছয় ফুট লম্বায়, গায়ের রং পাকা ধানের মতো, ঈষৎ মেদবতী, এই মহিলা একদা অনেক পুরুষের মাথা ঘুরিয়েছেন, কিন্তু সেই স্মৃতি ভুলতে পারেননি বলে এখনো মুখের ওপর শিল্পকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। কুপের ভিতরে ঢুকে আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে উল্টো দিকের গদিতে ধপাস করে বসলেন। তারপর হাতের ব্যাগ থেকে একটা ইংরেজি সিনেমার পত্রিকা বের করে পড়তে লাগলেন।
মেয়েদের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকার অভ্যেস আমার কখনো ছিল না। কিন্তু এ রকম অতি-নাটকীয়ভাবে পত্রিকা পড়তে তো কাউকে দেখিনি। এ সময় একটা উর্দি-পরা লোক ট্রে নিয়ে ঢুকল, ‘সাব, আপনার চা?’
আমি কিছু বলার আগেই লোকটা ট্রে রেখে গেল। দেখলাম সুন্দর চায়ের পট, কাপ, ডিস, চিনি, দুধ এবং কয়েকখানা বিস্কুট রয়েছে। ট্রেনে এত পরিষ্কার কাপ-ডিস এই প্রথম দেখতে পেলাম। বুঝলাম চেকার ভদ্রলোক পাঠিয়েছেন। গম্ভীর মুখে কাপে চা ঢালছি, এ সময় প্রশ্ন ভেসে এলো, ‘তার মানে?’
উনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে আবার পড়া শুরু করলেন। আমি চা শেষ করলাম। এবার সিগারেটের প্যাকেট বের করে ধরাতে যেতেই মহিলা বললেন, ‘এক্সকিউজ মি, আমি কড়া সিগারেটের গন্ধ একদম সহ্য করতে পারি না।’
অতএব বেরিয়ে করিডোরে চলে এলাম। ট্রেন ছাড়ল। এসি ফার্স্টক্লাস বলে খালি নেই কোনো কুপে। দার্জিলিং মেলের ভিড় এখানেও পৌঁছেছে। চেকার ভদ্রলোককে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। সিগারেট শেষ করে ভিতরে ফিরে এলাম। মহিলা বই পড়ে যাচ্ছেন। মনে হলো কথা বলা দরকার। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এনজিপিতে যাচ্ছেন?’
বই সরিয়ে রেখে মাথা নাড়লেন, ‘আপনি?’
‘আমিও’।
‘বাঃ, কী ভালো। বেশ কথা বলতে বলতে যাওয়া যাবে। এর আগেরবার একটা ভুল করে ফেলে খুব বোর হয়েছিলাম।’
‘কী রকম?’
‘এই আপনার মতো, না আপনার চেয়ে ফরসা, এক ভদ্রলোক প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি একা যাচ্ছেন? শুনে মাথা জ্বলে গেল। দেখছে একা যাচ্ছি, তবু প্রশ্ন করছে। ন্যাকামো। বলে দিলাম, “এরপর জিজ্ঞাসা করবেন তো, স্বামী নেই কিনা, বাচ্চা আছে কিনা, বাড়ির ফোন নম্বর কী? আমি কীভাবে যাচ্ছি, তা নিয়ে আপনার মাথাব্যথা কেন?” বলতেই লোকটার মুখ চুপসে গেল। সারাটা পথ আমার সঙ্গে কথা বলেননি। আমি আবার কথা না বলে থাকতে পারি না, তবে হঠাৎ হঠাৎ রাগ হয়ে যায়। এই যে একটু আগে আপনি আমায় অফার না করে চা খাচ্ছিলেন তখন আমার খুব রাগ হয়ে গিয়েছিল।’
মাথা নাড়লাম, ‘সরি। তখনো তো আপনার সঙ্গে আলাপ হয়নি।’
‘আলাপ কি এখনো হয়েছে? আমার নাম সুহাসিনী ভট্টাচার্য।’ আমি নিজের নামটুকুই বললাম। উনি আবার পত্রিকায় মন দিলেন। ঘণ্টাখানেক পরে চলন্ত ট্রেনে চেকার দুলতে দুলতে এলেন, ‘কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো স্যার?’
‘না, ঠিক আছে।’
‘একটু আসবেন?’
‘কোথায়?’
‘এই, একটু বাইরে।’
আমি বের হতেই উনি হাঁটা শুরু করলেন। কামরার এক প্রান্তে দেয়ালের ভিতর কন্ডাক্টর গার্ডদের জিনিসপত্র রাখার ব্যবস্থা আছে। সেখানে পৌঁছে চেকার খুব বিনীত ভঙ্গিতে আগেই ঢেলে রাখা এক গ্লাস হুইস্কি এগিয়ে দিলেন, ‘আপনার জিনিস স্যার। ভাগ্যিস এই বোতলটা আমার কাছে ছিল, নইলে বর্ধমান থেকে নিতে হতো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে হবে, এই যা। আপনার কুপেতে ভদ্রমহিলা আছেন, খুব রগচটা মহিলা।’
ফিরে আসার সময় হুইস্কির কথা মনে এলো।
ভিতরে ঢুকে দেখলাম আমার বার্থে চমৎকার বিছানা করা আছে। কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা শুয়ে পড়লাম দেয়ালের দিকে মুখ করে। ভদ্রমহিলার প্রতিবাদ কানে এলো, ‘একি! দরজা বন্ধ করলেন না?’ উত্তর দিলাম না।
‘অসভ্য লোক তো!’ দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হলো।
কিছুক্ষণ চুপচাপ, চাকার আওয়াজে এবং দুলুনিতে ঘুম এসে যাচ্ছে। হঠাৎ প্রশ্ন কানে এলো, ‘কত দিলেন? আমি অবশ্য পাঁচ শর বেশি দিই না। ওদের তো বাঁধা রেট আছে। সেকেন্ড ক্লাসে এক শ, ফার্স্টক্লাসে তিন শ আর এখানে পাঁচ শ। প্রচুর টাকা বেঁচে যায় এবং টিকিট কাটার ঝামেলা থাকে না।’
সর্বনাশ! ঘুম চটকে গেল। তার মানে সকাল হলেই লোকটা আমার কাছে টাকা চাইবে। আমার সেকেন্ড ক্লাসের টিকিটটা কোনো কাজে লাগবে না।
‘আপনার নাক ডাকে?’
কুঁকড়ে গেলাম। সেটা যে একটু-একটু হাঁকাহাঁকি করে না, তাই বা বলি কী করে? ঘুমিয়ে পড়লে আমি অবশ্য টের পাই না। উত্তর দিলাম না।
‘তাজ্জব মানুষ। ড্রিঙ্ক করেন কেন যদি স্ট্যান্ড না করতে পারেন।’
সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যখন ঘুম ভাঙল তখন ট্রেনটা মাঝরাতের নির্জন কোনো মাঠে দাঁড়িয়ে আছে সিগন্যালের অপেক্ষায়। উঠে বসলাম।
আহা, একি দৃশ্য। ভদ্রমহিলা ঘুমিয়ে আছেন রাজেন্দ্রাণীর মতো। এখন উনি সুন্দরভাবে ঘুমাচ্ছেন। মহিলা একদা সুন্দরী ছিলেন, এখন ভারতচন্দ্রের হিরামালিনী। ওঁর স্বামী নিশ্চয়ই আদরটাদর করেন। অবশ্য ইনি বিবাহিতা কিনা বুঝতে পারছি না। এমন মহিলা নির্জন ট্রেনের কুপেতে অচেনা পুরুষকে পাশে রেখে এভাবে ঘুমাতে পারে কী করে, তা নিয়ে তর্ক উঠলেও যা সত্য তা চিরকালই সত্য।
লেখক : কথাসাহিত্যিক।