শনিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিলুপ্তির পথে বাংলার প্রিয় তাঁত লুঙ্গি

শাইখ সিরাজ

বিলুপ্তির পথে বাংলার প্রিয় তাঁত লুঙ্গি

জাতি হিসেবে আমাদের সংস্কৃতির ঐশ্বর্যের কারণে সব সময় গর্ববোধ করি। সব জাতিরই আছে নিজস্ব স্বর, নিজস্ব রীতিনীতি; যা চলনে-বলনে, পোশাকে, চিন্তায় অন্য জাতি থেকে স্বাতন্ত্র্য মর্যাদার। বাঙালির এই নিজস্বতার সর্বজনীন উৎসবই হচ্ছে বাংলা বর্ষবরণ। আবহমানকাল ধরে বাংলা বর্ষবরণ বাঙালি জীবনের সবচেয়ে বড় উৎসব। এর সঙ্গে আনন্দ-উচ্ছ্বাস, বাণিজ্য, গ্রামীণ সংস্কৃতি,  আবহমান বাংলার খেলাধুলা সবই উঠে আসে। বাঙালি যা ধারণ করে যার চর্চা করে সবই উঠে আসে পয়লা বৈশাখে। পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে নতুনকে বরণের এই উৎসব বাঙালিকে নতুনভাবে শেকড়মুখী করে।

বৈশাখ মূলত গ্রামীণ সংস্কৃতির ধারক। একসময় বাংলাদেশ ছিল সম্পূর্ণরূপে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। আর কৃষি মানেই ছিল গ্রাম।  গ্রামের কৃষকের যাপিত জীবনের উৎসবের বারতা নিয়ে আসত বৈশাখ। এর দুটি কারণ ছিল। এক. বৈশাখ মানেই নতুন বছর। উৎসবে আয়োজনে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো, যেন সারাটি বছর কৃষকের উৎসবে আনন্দে কাটে। দুই. শেষ হলো অভাবের চৈত্র। আগে চৈত্র মাস ছিল অভাবের মাস। খরা শুধু প্রকৃতিতেই না, নেমে আসত কৃষকের খাদ্য ভাণ্ডার তথা আর্থিক অবস্থাতেও। চৈত্র শেষ হওয়া মানে বৈশাখে নতুন ধান। আর নতুন ধান মানেই হাতে টাকা। ছেলে মেয়ের বিয়ে, নতুন পরিধেয়। শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা।

বাংলাদেশে গ্রামের মানুষের প্রিয় পরিধেয় বস্ত্র লুঙ্গি। যদিও এই লুঙ্গি ব্যবহারের ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয়। তারপরও বলা যায় গ্রামীণ আদি আভিজাত্য ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে লুঙ্গি। ঝালকাঠির গণি মিয়ার গামছা, সিরাজগঞ্জের বেলকুচির তাঁতের শাড়ি, নারায়ণগঞ্জের জামদানির মতোই এক ঐতিহ্য নিয়ে টিকে আছে দোহারের রায়পাড়ার লুঙ্গি। সেখানকার লুঙ্গির বহুমুখী বিশেষত্ব রয়েছে। বিশেষ করে একটি লুঙ্গি তৈরির পেছনে যে শ্রম, যে রীতিনীতি অনুসরণের রেওয়াজ রয়েছে তা এক বিরল দৃষ্টান্ত। 

দোহারের রায়পাড়ার তাঁতিদের জীবনযাপন, কর্মকাণ্ড দেখার জন্য এক ভোরে উপস্থিত হলাম সেখানে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যেমন হয়ে উঠছে যন্ত্রনির্ভর, তেমন উৎপাদনেও শিল্প-কারখানার প্রসারে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে হাতেবোনা কাপড়ের ঐতিহ্য। রায়পাড়ার তাঁতযন্ত্রের শব্দের তীব্রতা দিনে দিনে কমে আসছে, তবে শেষ হয়ে যায়নি। রায়পাড়ায় তাঁতের লুঙ্গি তৈরি মানে রীতিমতো অন্য এক সংস্কৃতি। গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে ইছামতির শাখা নদী শাপখালী। সেখানে ঘাটে ব্যস্ত একদল তাঁতকর্মী। লুঙ্গি তৈরির শুরুর কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে চলছে সুতা ধোয়ার কর্মযজ্ঞ। মিল থেকে সুতা এনে তা মধ্যরাত থেকে প্রায় আট-দশ ঘণ্টা কস্টিক (এক ধরনের কেমিক্যাল) দিয়ে সেদ্ধ করার পর ধোয়ার জন্য নিয়ে আসা হয় নদীতে। এই দৃশ্য রায়পাড়া গ্রামের প্রতি ভোরের। এরপর তাঁতি বাড়ির উঠোনে নিয়ে যাওয়া হয় দীর্ঘক্ষণ ধরে ধোয়া ধবধবে সাদা সুতা। বিশেষ কায়দায় সেগুলো থেকে পানি নিঙড়ে চাহিদা মতো রং করা হয় সুতা। রঙিন সুতাকে রোদে শুকিয়ে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা হয়। বর্ণিল হয়ে ওঠে তাঁতি বাড়ির উঠোনগুলো। এ কাজগুলো মোটেই সহজ নয়, সময়সাপেক্ষও। একটু এদিক সেদিক হলেই যেমন রঙের কার্যকারিতা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তেমন নষ্ট হয়ে যেতে পারে সুতার গুণগতমান। কাজ শুরু করতে হয় কাকডাকা ভোরে। শেষ হয় সন্ধ্যা ৭টা-৮টায়। যারা এই কাজগুলো করেন তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। তারা জানান, সপ্তাহ হিসেবে তারা তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পান। এ দিয়েই সংসার চালাতে হয়। দীর্ঘ সময় এ কাজে থাকতে হয় বিধায় আর কোনো কাজ করারও সুযোগ মেলে না। প্রশ্ন করেছিলাম, এই শ্রম অন্য কোথাও দিলে লাভটা কি বেশি হতো? উত্তরে জানালেন, এই কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পরম্পরা। এ ছাড়া অন্য কোনো কাজের কথা কোনো দিন ভাবেনি, জানেও না। তবে তারা চান না পরবর্তী প্রজন্ম এ কাজে সম্পৃক্ত হোক।

ততক্ষণে মেঘের ফাঁক গলে বেরিয়ে এসেছে সকালের সূর্য। যাই হোক, সুতা শুকানোর পরবর্তী কাজটা করে গৃহিণীরা। চরকাকাটায় সুতা জড়ানো হয় গুটিতে। ভিন্ন ভিন্ন রঙের গুটি। কী অদ্ভুত লাগে দেখতে! হাজারো রঙের এক বর্ণিল খেলা। শুধু গুটিতে সুতা জড়ানোয় নয়, লুঙ্গি তৈরির জন্য একটা একটা করে সুতা বাঁশের ফ্রেমে জড়ানোর কাজটাও নারীরাই করেন। তাঁতপল্লীর নারীদের অবস্থা আরও শোচনীয়। তারা তাদের শ্রম অপেক্ষা খুব কম পারিশ্রমিক পান। ফ্রেমে সুতাগুলো সাজানো হয়ে গেলে পরের দায়িত্বটুকু আবার পুরুষের। তারা আবার একটা একটা করে সুতা সমান করে সাজান। এটাকে বলে ‘তান গিতালী’। ‘তান গিতালী’ শেষ হওয়ার পর অতিরিক্ত সুতা কেটে ফেলা হয়। অতঃপর টান টান অবস্থায় সমান করে বাঁধা হয়। এমন করে ৬০টি সুতা বাঁধাকে বলে ঘুন্না।

এমন ৭৪টি ঘুন্না দিয়ে তৈরি হয় একটি লুঙ্গি। ঘুন্নাতে মাড় দিতে হয়। তাঁতশিল্প পরিচালনার পেছনের রহস্য সব প্রাকৃতিক উপাদান আর সনাতনী দক্ষতা। মাড় দেওয়ার কাজটি করা হয় শনের ঝাড়ু দিয়ে। এতে করে প্রতিটি সুতার গায়ে মাড় লেগে যায়। ঘুন্নার ওপর মাজন দিতে হয়। মাজন বিশেষ ধরনের প্রাকৃতিক তন্তু দিয়ে তৈরি। মাজন দেওয়ার আগে বাঁশের ফ্রেমটাকে টান টান করে বাঁধতে হয়। মাজনের কাজটা খুব পরিশ্রমের। সকাল ৯টা হবে তখন। কয়েকজন তাঁত শ্রমিক এ কাজে ব্যস্ত। সকাল থেকে আকাশে মেঘ। গুমোট হয়ে আসছে। যে কোনো সময়ই বৃষ্টি নামবে। ভ্যাপসা গরম। কর্মরত শ্রমিকের পিঠে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মনে হচ্ছিল এত শ্রম দিয়েও প্রাপ্তি খুবই কম। অথচ এরাই ধরে রাখছে আমাদের ঐতিহ্য। মাজন সুতাকে মসৃণ করে। এ কাজে রোদ বৃষ্টির পূর্বাভাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি বৃষ্টি হয় তাহলে এতক্ষণের সব শ্রম বৃথা যাবে।

লুঙ্গি তৈরির পরবর্তী ধাপটি হচ্ছে সুতা শান দেওয়া। তাঁতে তোলার আগে এটিই শেষ ধাপ। কথা হয় তাঁতি নুরুল ইসলামের সঙ্গে তিনি তার সুনিপুণ হাতে সুতা শানছিলেন। তিনি জানালেন, কাজটি অত্যন্ত জটিল। প্রতিটি সুতাকে সূক্ষ্ম তারের ভিতর প্রবেশ করাতে প্রয়োজন হাত ও চোখের সমান দক্ষতা। একটা সুতা বাদ গেলে লুঙ্গির টেকসইত্ব নষ্ট হবে। এই কঠিন কাজটি করেও তার সাপ্তাহিক আয় দুই হাজার সাতশ টাকা। শান দেওয়ার পর লুঙ্গি তাঁতে ওঠে। তাঁতযন্ত্র থেকে বের হয়ে আসে পরিপূর্ণ লুঙ্গি। না, এখানেই শেষ না। লুঙ্গি তৈরির পর সেটাতে আবার মাড় দেওয়া হয়। সঠিক মাড় প্রয়োগের ওপর নির্ভর করে রঙ ও সুতার স্থায়িত্ব । দিনে দিনে লুঙ্গি আমাদের আদি ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলেও বিশ্বায়নের ধাক্কায় অনেক পরিবর্তনের সঙ্গে লুঙ্গির ব্যবহারও কমতে শুরু করেছে। এর প্রভাব পড়েছে তাঁতিদের ওপরও। তাই বদলে যাচ্ছে এই তাঁতি পাড়ার অর্থনীতি ও সামাজিক চিত্রও।

হাতে বোনা এই লুঙ্গির বেশ কদর রয়েছে দেশব্যাপী। তারপরও পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় এই শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন। যান্ত্রিক তাঁতের যুগে দিন দিন হারিয়েই যাচ্ছে তাঁতের দক্ষ কারিগর। এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে তাঁতশিল্প উদ্যোক্তাদের রয়েছে বহুমুখী চেষ্টা।

শতভাগ হাতে তৈরি এই লুঙ্গির সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁতশিল্পের প্রাচীন ঐতিহ্য। যে হাতে বাঙালিই একদিন বিশ্বখ্যাত মসলিন তৈরি করেছে। রায়পাড়া কিংবা রুহিতপুরের এই লুঙ্গিই এখন পৃথিবীর সেরা লুঙ্গি বলে দাবি স্থানীয়দের। এ লুঙ্গি দেশের বাইরে রপ্তানি করা হয়। রপ্তানিকে আরও সম্প্রসারণ করতে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের কাছে ঢাকার একটি হোটেলে আনুষ্ঠানিকভাবে হাতে বুননে লুঙ্গির পরিচিতি করে দেওয়া হয়। এখনো ঐতিহ্য আর আরামের এক পরিধেয় হিসেবে অনেকের কাছেই প্রিয় হয়ে আছে লুঙ্গি। কিন্তু সংস্কৃতির পালাবাদলে লুঙ্গির চাহিদা কমছে। অন্যদিকে যান্ত্রিক তাঁতের সঙ্গে লড়াইয়ে আর টিকতে পারছে না সনাতনী হস্তচালিত তাঁতশিল্প। এ কথাও সত্য, একটি লুঙ্গি হাতে বুনতে যে সময় লাগে তার মূল্য পড়ে যায় অনেক বেশি। তারপরও আমাদের সংস্কৃতি রক্ষার প্রয়োজনেই এই হস্তচালিত তাঁত আর রুহিতপুরি লুঙ্গির মতো ঐতিহ্যগুলো টিকে রাখার প্রয়োজন আছে।  কারণ এগুলোই আমাদের নিজস্বতা। আমাদের গ্রাম, কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও জীবন-যাপনে ব্যবহৃত প্রতিটি উপাদানের মূল্যই আমাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন। প্রয়োজন নতুন প্রজন্মেরও উপলব্ধিতে আনা। সবাইকে আবারও বাংলা নববর্ষের উষ্ণ শুভেচ্ছা। ষড়ঋতুর বাংলাদেশ ভালো থাক। ভালো থাকুন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া প্রতিটি বাঙালি।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর