শনিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

ইসলামে প্রতিবন্ধীদের অধিকার

মাওলানা মুহাম্মদ মিজানুর রহমান, সিনিয়র পেশ ইমাম

সকল প্রশংসা আল্লাহ রব্বুল আলামিনের। দরুদ ও সালাম প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি।

অস্বাভাবিক সৃষ্টি আল্লাহর সৃষ্টি রহস্যের নিগূঢ় তত্ত্ব : মহান আল্লাহ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তাঁর সৃষ্টিকুলের মধ্যে কিছু সৃষ্টিকে আমরা কখনো অস্বাভাবিক দেখতে পাই। এতে তাঁর বিশেষ উদ্দেশ্য ও মহান রহস্য বিদ্যমান। কোরআন ও হাদিসের আলোকে এ সৃষ্টি রহস্য হলো প্রথমত. বান্দা যেন তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারে, তিনি যেমন স্বাভাবিক সুন্দর সৃষ্টি করতে সক্ষম, তেমন এর ব্যতিক্রমও করতে সক্ষম। দ্বিতীয়ত. আল্লাহ যাকে বিপদাপদ থেকে নিরাপদ রেখেছেন; সে যেন নিজের ওপর আল্লাহর দয়া ও অনুকম্পাকে স্মরণ করে তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। কারণ আল্লাহ চাইলে তার ক্ষেত্রেও সে রকম করতে পারতেন। তৃতীয়ত. প্রতিবন্ধীকে আল্লাহতায়ালা এ সমস্যার বিনিময়ে তাঁর সন্তুষ্টি, দয়া, ক্ষমা ও জান্নাত দিতে চান। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, ‘আমি যার প্রিয় চোখ নিয়ে নিই, অতঃপর সে ধৈর্য ধারণ করে ও নেকির আশা করে; আমি তার জন্য এর বিনিময়ে জান্নাত ছাড়া অন্য কিছুতে সন্তুষ্ট হই না।’ (তিরমিজি)।

প্রতিবন্ধীর করণীয় : প্রথমত. ধৈর্যধারণ করবে এবং সন্তুষ্ট থাকবে কারণ এটি ভাগ্যের লিখন। আল্লাহ আল কোরআনে বলেন, ‘পৃথিবীতে এবং তোমাদের ওপর কোনো বিপদ আসে না; কিন্তু তা জগৎ সৃষ্টির আগেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। এটা এজন্য, যাতে তোমরা যা হারাও তাতে দুঃখিত না হও এবং তিনি তোমাদের যা দিয়েছেন তাতে উল্লসিত না হও। আল্লাহ উদ্ধত ও অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা হাদিদ : ২২)। দ্বিতীয়ত. বিশ্বাস রাখবে, আল্লাহ যখন কোনো মুমিনকে পরীক্ষায় ফেলেন, তখন তিনি তাকে ভালোবাসেন এবং অন্যদের থেকে তাকে অগ্রাধিকার দেন। তাই তিনি নবীদের সবচেয়ে বেশি বিপদাপদের মাধ্যমে পরীক্ষা করেছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নবীরা সবচেয়ে বেশি পরীক্ষিত হন, অতঃপর তাদের থেকে যারা কাছের স্তরের। মানুষকে তার বিশ্বাস অনুযায়ী পরীক্ষা নেওয়া হয়, যদি তার ইমান শক্তিশালী হয় তাহলে তার পরীক্ষাও কঠিন হয়। আর যদি তার ইমান দুর্বল হয়, তাহলে তার পরীক্ষাও সে অনুপাতে হয়। বিপদ বান্দার পিছু ছাড়ে না, পরিশেষে তার অবস্থা এমন হয় যে, সে পাপমুক্ত হয়ে জমিনে চলাফেরা করে।’ (তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ)। তৃতীয়ত. মনে রাখবে যে, দয়ালু আল্লাহ মুমিনকে তার প্রত্যেক কষ্টের বিনিময় দেন, যদিও সেই কষ্ট নগণ্য হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মুসলিম ব্যক্তিকে কষ্ট, ক্লান্তি, দুঃখ, চিন্তা, আঘাত, দুশ্চিন্তা গ্রাস করলে এমনকি কাঁটা বিঁধলেও আল্লাহতায়ালা তা তার পাপের কাফফারা করে দেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)। চতুর্থত. মুমিন যেন তার নির্দিষ্ট প্রতিবন্ধিতাকে ভুলে গিয়ে শরীরের বাকি অঙ্গগুলোকে কাজে লাগায়। কারণ কোনো এক অঙ্গের অচলতা জীবনের শেষ নয়। দেখা গেছে, যার কোনো একটি ইন্দ্রিয় বা অঙ্গ অচল তার বাকি ইন্দ্রিয় বা অঙ্গগুলো বেশি সক্রিয় ও সচল।

প্রতিবন্ধীদের জন্য আমাদের করণীয় : নিজের সুস্থতা ও পূর্ণতার জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং প্রতিবন্ধী ভাই-বোনদের জন্য দোয়া করা। প্রতিবন্ধীদের যথাসম্ভব সাহায্য-সহযোগিতা করা। প্রতিবন্ধীর দেখাশোনা করা তার অভিভাবকের কর্তব্য হলেও সমষ্টিগতভাবে তা সমাজের সবারই দায়িত্ব।

ইসলামে প্রতিবন্ধীর গুরুত্ব ও মর্যাদা : ইসলামের দৃষ্টিতে সব মানুষ সমান। ইমান ও তাকওয়া হচ্ছে মানুষের মর্যাদার মানদণ্ড। যে যত বেশি মুত্তাকি আল্লাহ তাকে তত বেশি ভালোবাসেন। আল্লাহ আল কোরআনে ঘোষণা করেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে অধিক মুত্তাকি।’ (সূরা হুজুরাত : ১৩)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের শরীর ও আকৃতির দিকে দেখেন না; বরং তিনি তোমাদের অন্তরের দিকে দেখেন।’ (মুসলিম)।  আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! কোনো পুরুষ যেন অন্য কোনো পুরুষকে উপহাস না করে; কেননা, যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারী যেন অন্য কোনো নারীকে উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে।’ (সূরা হুজুরাত : ১১)।

প্রতিবন্ধীদের সামাজিক স্বীকৃতি : প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিকবার তাঁর অনুপস্থিতির সময় মসজিদে নববীতে ইমামতির দায়িত্ব এক প্রতিবন্ধী সাহাবিকে অর্পণ করে তাদের সমাজের সর্বোচ্চ সম্মানে অধিষ্ঠিত করার নজির তৈরি করেন। তিনি সেই প্রতিবন্ধী সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)-কে আজান দেওয়ার কাজেও নিযুক্ত করেছিলেন। (বুখারি)।

শরিয়তের বিধান পালনে প্রতিবন্ধীদের জন্য ছাড় : ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ বিধানে প্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে সহজতা ও সহনশীলতা। তাই এমন প্রতিবন্ধী যে ইসলামের বিধান পালনে একেবারে অক্ষম, যেমন পাগল ও জ্ঞানশূন্য ব্যক্তি, তার ওপর ইসলাম কোনো বিধান জরুরি করে না। আর আংশিক প্রতিবন্ধী যে কিছুটা করতে সক্ষম তার প্রতি অতটুকুই পালনের আদেশ দেয়। ফরজ বিধান যা আল্লাহ মানুষের জন্য নির্ধারণ করেছেন, যদি মানুষ তা পালনে সক্ষম হয়, তাহলে তার প্রতি তা আবশ্যিক হবে। আর যদি সে তাতে অক্ষম হয়, তাহলে তা থেকে সে মুক্তি পাবে। অর্থাৎ যে পরিমাণ পালন করতে সক্ষম হবে, সে পরিমাণ তাকে পালন করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনো কাজের ভার দেন না।’ (সূরা বাকারা : ২৮৬)।

সর্বশেষ খবর