শিরোনাম
শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

রাজনীতির দুধসাগরে শ্বাসরুদ্ধকর ৭২ ঘণ্টা!

গোলাম মাওলা রনি

রাজনীতির দুধসাগরে শ্বাসরুদ্ধকর ৭২ ঘণ্টা!

সাম্প্রতিককালে আমার ব্যাপারে অদ্ভুত এক গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। আমি যতই বলি যে, গুজবটির কোনো ভিত্তি নেই, কিন্তু তারা আমার কথায় কান না দিয়ে গুজবের পেছনে ছুটতে গিয়ে পুরো এলাকাকে নির্বাচনী আমেজে উৎসবমুখর করে তুলেছেন। পটুয়াখালীর গলাচিপা ও দশমিনা উপজেলার সর্বত্র কে বা কারা রটিয়ে দিয়েছেন যে, একাদশ সংসদ নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে গোলাম মাওলা রনির মনোনয়ন শতভাগ নিশ্চিত। আমার কাছে এ ব্যাপারে কেউ জিজ্ঞাসা করলে আমি যখন কিঞ্চিৎ মুচকি হেসে এবং কিছুটা অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করি— এটা কোত্থেকে শুনলেন! তখন তারা নিজের মতো বলে উঠলেন— ও আচ্ছা! বুঝেছি বুঝেছি— আর বলতে হবে না! একটি গুজব ও কিছু লোকের আগাম বুঝে ফেলার কারণে আমি যে কত্ত বড় ফেতনা-ফ্যাসাদের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম তা বলার আগে রাজনীতির দুধসাগর সম্পর্কে কিছু বলে নিই।

অনেকেই মনে করেন, রাজনীতি মানেই টেন্ডারবাজি, দখল, মাদক ব্যবসা অথবা অবৈধ প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সন্ত্রাসের গডফাদার হওয়ার অবারিত সুযোগ-সুবিধা। কেউ কেউ হয়তো মনে করেন, কোনোমতে একবার এমপি-মন্ত্রী হতে পারলেই হলো— তাহলে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। দুনিয়া ও আখিরাতে পায়ের ওপর পা তুলে ইচ্ছামতো মধু, মেওয়া ও হুর গেলমান নিয়ে দুধের নহরে গা ভাসিয়ে সময় পার করে দেওয়া যাবে। কিছু মানুষের নেতিবাচক ধারণার বিপরীতে ইতিবাচক রাজনীতির ময়দানে লড়তে গিয়ে রাজনীতিবিদদের পরিবার-পরিজন নিয়ে কতটা বিপর্যয় ও ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয় তা আমি ২০১৮ সালের ১৩, ১৪ ও ১৫ এপ্রিল হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা ও রোমাঞ্চকর কাহিনীতে ভরপুর আমার জীবনের শ্বাসরুদ্ধকর সেই ৭২ ঘণ্টার ইতিকথা নেপোলিয়ন বোনাপার্টের পিরামিডের যুদ্ধের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। সংসদ সদস্য হিসেবে আমি নবম সংসদে বিভিন্ন কারণে আলোচিত ও সমালোচিত ছিলাম। দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং নির্বাচনী এলাকায় নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাওয়ার আত্মতৃপ্তিকে সমন্বয় করার জন্য যে প্রজ্ঞা আমার দরকার ছিল সত্যি বলতে কি তা তখন আমার ছিল না। ফলে অনেক অনাহৃত ঘটনা, দুর্ঘটনা, আলোচনা-সমালোচনা এবং অপ্রয়োজনীয় শত্রু-মিত্র পয়দা হয়ে গিয়েছিল। আমার ব্যক্তিগত জীবনে হজরত ওমর (রা.) ও দানবীর হাজী মুহম্মদ মুহসীনের প্রভাব অপরিসীম। এ দুই মহামানবের অনুকরণে কিছু কাজ করতে গিয়ে এমন কিছু সমস্যার সৃষ্টি করেছিলাম যার সমাধান সম্পর্কে আমার পূর্ব ধারণা ছিল না। আমি যখন গলাচিপা-দশমিনার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলাম তখন সেখানে মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, যৌন হয়রানি, বহুবিবাহ, ধর্ষণ, জুলুম, অত্যাচার, চুরি, ডাকাতি এবং রাহাজানির মতো মারাত্মক অপরাধের মহড়া চলত প্রকাশ্যে। রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনের নীরবতা এবং একশ্রেণির সমাজপতির অপরাধসংশ্লিষ্টতার কারণে সাধারণ নিরীহ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। আমার তরুণ বয়সের দুর্নিবার সাহস, দেশপ্রেম এবং সাধারণ মানুষের প্রতি মমত্ববোধকে পুঁজি করে মাদক, সন্ত্রাস এবং অন্যান্য অপরাধের বিরুদ্ধে দুর্বার সংগ্রাম শুরু করে দিয়েছিলাম সেই ২০০৯ সালেই। সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থন, প্রশাসনের সহযোগিতা এবং দলীয় হাইকমান্ডের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমার নির্বাচনী এলাকার পুরো পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন নীতি বাস্তবায়ন করতে আমার খুব বেশি সময় লাগেনি। মাদকসেবীদের দৌরাত্ম্য, সন্ত্রাস, ভূমি দখল, চাঁদাবাজিসহ অন্যান্য অপরাধ উল্লেখযোগ্যহারে হ্রাস পায় এবং অপরাধীরা সব গা-ঢাকা দেয়। মাত্র এক থেকে দেড় বছরের মাথায় পুরো নির্বাচনী এলাকার পরিবেশ শান্তিপূর্ণ হয়ে ওঠে। অপরাধীরা রাজনীতির মাঠে আমার সঙ্গে পরাজিত হয়ে চক্রান্ত, বেইমানি ও মোনাফেকির এমন সব কৌশল অবলম্বন করে যা আমি হজরত ওমর (রা.) বা হাজী মুহম্মদ মুহসীনের জীবনী পাঠ করে জানতে পারিনি। আমার তখন বার বার এ কথাই মনে হয়েছিল যে, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে মানুষের মনমানসিকতা বিবেচনা করেই কাজকর্ম করা উচিত। তা না হলে ভালো কাজের ফল যেমন মন্দ হতে পারে তেমন মন্দ কাজও সমাজভেদে প্রশংসিত হতে পারে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আমি দলীয় মনোনয়ন চাইনি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণে। ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবার ও মনের মধ্যে এমন কতগুলো সমস্যা দানা বেঁধে ছিল যার জন্য রাজনীতিতে ক্ষণিকের বিরতি নেওয়া আমার জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। আমি গত প্রায় সাড়ে চারটি বছর কাগজে-কলমে সংসদ সদস্য না হয়েও আমাকে এলাকার সর্বস্তরের জনগণকে হাতে-কলমে সংসদ সদস্যের সেবা দিয়ে যেতে হচ্ছে। সরকারি দফতরসমূহে নানা তদবির, গরিব মানুষের চিকিৎসা, বিয়েশাদি, অন্ন-বস্ত্রের জোগানসহ তাদের প্রাত্যহিক নানাবিধ সমস্যা সমাধানে বুদ্ধি-পরামর্শ-শক্তি-সাহস দিতে গিয়ে নিত্যকার কর্মঘণ্টার বিরাট একটি অংশ আমাকে হররোজ ব্যয় করতে হয়। ফলে বিগত দিনে আমার কাছে একবারও মনে হয়নি যে, আমি এখন সংসদ সদস্য নই। অন্যদিকে আমার এলাকার বেশির ভাগ মানুষ তাদের স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা, অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা দ্বারা এক অভূতপূর্ব মায়ার বন্ধনে আমাকে এমনভাবে বেঁধে ফেলেছেন যার টানে আমি বার বার তৃণমূলে ফিরে যেতে বাধ্য হই। নির্বাচনী এলাকায় আমার উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয় তা দেখে আমার প্রতিপক্ষ, প্রতিদ্বন্দ্বী ও শত্রুদের মন-মস্তিষ্কে কালবৈশাখীর ঝড় ও চোখ-কানে বজ্রপাতের বিকট শব্দ ও আলোর ঝলকানি আঘাত হানতে থাকে। এমপি প্রার্থী হিসেবে আমার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল ২০০১ সালে ফরিদপুরের সদরপুর ও চরভদ্রাসন নির্বাচনী এলাকায় তৃণমূলে কাজ করার মাধ্যমে। বিগত ১/১১-এর সময় ফরিদপুরে একটি সংসদীয় আসন কমে গেলে দলীয় সিদ্ধান্তে আমি পটুয়াখালী-৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সংসদ সদস্য হই। সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে আমি কমবেশি ৬০-৭০ জন প্রতিদ্বন্দ্বীকে মোকাবিলা করেছি। তার মধ্যে কেউ কেউ ভদ্র, শিক্ষিত, ধার্মিক এবং ভালো মানুষ। অনেকে আছেন বজ্জাত প্রকৃতির চরিত্রহীন, কেউ কেউ ভীরু-কাপুরুষ এবং পেছন থেকে চাকু মারায় ওস্তাদ। অনেকে আবার ছক্কা ছয়ফুর প্রকৃতির লোক হাসানো আদমি। নেশাখোর, মাদক ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী, জেনাকার শরাবি-কাবাবি লোকের সংখ্যাও কম নয়। এত্তসব বাহারি প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকি নেশাখোর, মাদক ব্যবসায়ী ও ভীরু প্রকৃতির লোকজন সম্পর্কে।

এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে আলোচনা করা যাক। আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে ওমরাহ করার নিয়ত করেছি। পবিত্র মক্কা-মদিনা সফরের আগে হঠাৎ মনে হলো নির্বাচনী এলাকায় একটি ঢুঁ মারা দরকার। ফেরার পথে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজার এবং সদরপুরে আব্বার কবর জিয়ারত শেষে গ্রামে বসবাসরত আম্মা ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের দোয়া নিয়ে ঢাকায় ফিরব। আমার ব্যস্ত সময় থেকে কোনোমতে তিনটি দিন বের করলাম এবং ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে নির্ধারিত সময় অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল ভোর ৪টার সময় ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে গলাচিপা-দশমিনার পথে রওনা হলাম। বরিশাল সার্কিট হাউসে মধ্যাহ্নভোজনের সময় জানতে পারলাম, গলাচিপা ফেরিঘাটে আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়েছে এবং প্রায় এক হাজার মোটরসাইকেলে তিন হাজার নেতা-কর্মী ৫০ কিলোমিটার পথ এগিয়ে এসে লেবুখালী ফেরিঘাটে অপেক্ষা করছেন। কোনোরকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া এত্তবড় লোকসমাগম এবং জনসমাবেশের খবর শুনে আমি প্রমাদ গুনতে থাকলাম। কারণ আমার ভীরু প্রতিদ্বন্দ্বী ও নেশাখোররা জনসমাগমের মধ্যে ঢুকে পড়ে যে কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটাতে পারে। আমি পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক, পুলিশ প্রশাসন এবং গলাচিপার প্রশাসনের সঙ্গে কথা বললাম। তারা সবাই আমাকে আশ্বস্ত করলেন। এরই মধ্যে খবর এলো, প্রতিদ্বন্দ্বীরা গলাচিপার ফেরির ইঞ্জিন বিকল করে রেখেছে। আমি পটুয়াখালী ফেরি বিভাগের প্রধানের সঙ্গে কথা বলে সবকিছু ঠিক করে সার্কিট হাউস থেকে আল্লাহর নামে গন্তব্যের দিকে রওনা হলাম।

গলাচিপা ফেরিঘাটে পৌঁছানোর পর যা দেখলাম তা ছিল এক অর্থে অভূতপূর্ব। প্রায় ২৫-৩০ হাজার মানুষের মুহুর্মুহু স্লোগান শুনে এবং তাদের উচ্ছ্বাস দেখে আমার রাজনীতিবিমুখ নবম শ্রেণিপড়ুয়া কিশোর ছেলেটি বলল, বাবা! আমারও এমপি হতে ইচ্ছে করছে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়েটি বার বার সামনে পেছনে তাকিয়ে আনন্দে ইয়াহু ইয়াহু বলা আরম্ভ করল। আমার সহধর্মিণী যিনি কিনা আমার চেয়েও অধিক সাহসী এবং কৌশলী রাজনীতিবিদ, তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে পরম প্রভুকে বার বার ধন্যবাদ জানানোর জন্য আলহামদুলিল্লাহ জপতে থাকলেন। ফেরিঘাটে পৌঁছানোর পর আমি জনসমুদ্রে মিশে গেলাম এবং পরিবার-পরিজনকে ভিন্নপথে গ্রামের বাড়ি উলানিয়া পাঠিয়ে দিলাম। ২৫-৩০ হাজার মানুষের মিছিল গলাচিপার চিপাগলির মধ্যে লম্বায় প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হয়ে পড়ল। আমরা মিছিল করতে করতে ৫-৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে অদূরবর্তী কালিকাপুর মাদ্রাসা মাঠে গিয়ে বাদ মাগরিব সমাবেশ করলাম। এভাবে আমার প্রথম ২৪ ঘণ্টা আনন্দ-উচ্ছ্বাস ও ভালো লাগার মধ্যে কাটল। পরে অবশ্য জেনেছিলাম, দুষ্কৃতকারীরা একটি চিপাগলির মধ্য থেকে নিজেদের আড়ালে রেখে কয়েকটি ঢিল ছোড়ার চেষ্টা করেছিল এবং মিছিলকারীদের ধাওয়া খেয়ে নাস্তানাবুদ হয়ে একটি দূষিত ও ময়লাযুক্ত পানিতে ভরা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মরক্ষা করেছিল।

পরের দিনটি আমি নির্ধারণ করেছিলাম দশমিনা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের বাজারে গণসংযোগ করার জন্য। ৬০০ থেকে ৭০০ মোটরসাইকেলে নেতা-কর্মীরা আমার সঙ্গী হয়ে মনের আনন্দে সারা দিন দশমিনার পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ান এবং বাহারি স্লোগানে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন যাতে মনে হতে থাকে যে, দেশে বোধহয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। পরপর দুই দিনের বিপুল জনসমাগম, রাজনৈতিক মহড়া এবং জনগণের আনন্দ-উচ্ছ্বাস দেখে আমার প্রতিপক্ষদের মনে প্রতিহিংসার আগুন ধরে যায়। তারা সর্বশক্তি নিয়ে আমার তৃতীয় দিনের কর্মসূচিতে বাধা সৃষ্টির জন্য দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রসহকারে মাঠে নেমে পড়ে। আমি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী এবং তাদের চ্যালাম্যালাদের খুব ভালো করে চিনি। অন্যদিকে তারাও আমাকে চেনেন। কাজেই আমাকে নিয়ে তাদের উৎকণ্ঠা থাকলেও আমি তাদের নিয়ে মোটেও চিন্তিত ছিলাম না। তারা গোয়েবলসীয় কায়দায় প্রচার করতে থাকেন যে, ১৫ এপ্রিল আমি জনসংযোগে বের হলে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়া হবে। আমার গ্রামের বাড়িতে আগুন দিয়ে স্ত্রী, কন্যা, পুত্রসহ সবাইকে পুড়িয়ে মারা হবে। তারা আমাকেও প্রাণে বাঁচিয়ে রাখবে না।

চক্রান্তকারীরা তাদের চক্রান্তের অংশ হিসেবে এমন কয়েকজন ভীরু ও দুর্বলচিত্তের লোককে বেছে নেয় যারা আমার পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এবং আপনজনদের কাছে বিশ্বস্ত। আমার কর্মী-সমর্থকদের মাঝে ভীতিকর অবস্থা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তারা তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদের গল্প বহুগুণে বাড়িয়ে প্রচার করতে থাকে। ফলে আমার পক্ষের ভীতু লোকজন সত্যিকার অর্থে মারাত্মকভাবে ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু তারা কেউই সাহস করে আমার কাছে এসে নিজেদের দুর্বলতার কথা প্রকাশ করে না। ১৪ এপ্রিল রাত ১০টার সময় আমি যখন রাতের খাবার খাচ্ছিলাম তখনো আমার বাসার সামনে হাজারখানেক লোক গিজগিজ করছিল। আমি মনে করলাম তারা হয়তো আগামীকালের কর্মসূচি সফল করার জন্য লম্বা পরামর্শ করছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো সবাই জটলা করছিল আগামীকালের কর্মসূচি স্থগিত করার লক্ষ্যে আমার কাছে অনুরোধ জানানোর জন্য। আমি যখন বিষয়টি বুঝতে পারলাম তখন নেতা গোছের কয়েকজনকে ডেকে বললাম তোমরা না চাইলে আগামীকাল বের হব না। তোমরা সারা রাত চিন্তা কর এবং সকাল ৯টায় আমাকে তোমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিও। এ কথা বলে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে গেলাম।

সকালবেলা প্রাতঃকর্মাদি সেরে নাশতা করলাম। তারপর পোশাক পরে দুই রাকাত সালাতুল হাজত পড়ে প্রার্থনা শেষে দোতলা থেকে নিচে নামলাম। সকাল ঠিক ৯টায় কাউকে কিছু না বলে একটি মোটরসাইকেলে চেপে গণসংযোগে বের হলাম। পেছনে কে এলো কিংবা এলো না তা চিন্তা না করে গন্তব্যের পথে এগোতে থাকলাম। কিছুদূর এগোনোর পর লক্ষ্য করলাম যে ২০০ মোটরসাইকেলে আমার নেতা-কর্মীরা আমাকে অনুসরণ করছেন। ঘণ্টাখানেক চলার পর শুনলাম যে, প্রতিপক্ষের লোকজন অসংখ্য মোটরসাইকেলে চেপে প্রকাশ্যে রামদা, লাঠি, টেঁটা, বল্লম এবং আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে গলাচিপা শহর প্রদক্ষিণ করে আমাদের আক্রমণ করার জন্য ধেয়ে আসছে। আমি পেছনে ফিরে দেখলাম, নেতা-কর্মীরা উৎকণ্ঠায় ঠিকমতো মোটরসাইকেল চালাতে পারছেন না। আমি মাঝপথে যাত্রা থামিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বললাম। বেশির ভাগ লোক ভিন্নপথে পালিয়ে নীরবে বাসায় পৌঁছেন। পরদিন চুপিসারে ঢাকা ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। আমার হঠাৎ করেই নেপোলিয়নের পিরামিডের যুদ্ধের কথা মনে পড়ল। আমি কারও কথা না শুনে উল্টোপথে মোটরসাইকেল ঘোরালাম প্রতিপক্ষের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য। নেতা-কর্মীদের সংক্ষিপ্ত ভাষণ ও নানা উপদেশ দিয়ে তাদের মধ্যে উদ্দীপনা বাড়িয়ে দিলাম। তারা সবাই প্রতিদ্বন্দ্বীদের মুখোমুখি হয়ে জীবন দেওয়ার জন্য প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন।

আমরা কিছুদূর এগোনোর পর পুলিশি বাধায় থামলাম। পুলিশ জানাল, প্রতিপক্ষের লোকজনকে একটি স্থানে ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। আমার কর্মী-সমর্থকরা চারদিক থেকে প্রতিপক্ষের লোকজনকে আক্রমণ করার জন্য গেরিলা কায়দায় ওত পেতে বসে ছিল। আর পুলিশ সংঘাত এড়ানোর জন্য প্রতিপক্ষের লোকজনকে নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে ঘিরে রাখছিল। এ অবস্থায় আমি কৌশল করে পুনরায় পিছু হটলাম এবং প্রতিপক্ষকে পুলিশের জিম্মায় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে রেখে পুরো নির্বাচনী এলাকা নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়িয়ে সন্ধ্যানাগাদ বাড়ি ফিরলাম। সেখানে ফিরে দেখি কিয়ামত হওয়ার উপক্রম। শত শত মহিলা বাসায় গিজগিজ করছেন। আমি পৌঁছামাত্র অনেকে কান্না শুরু করলেন। পরে জানলাম দুর্বৃত্তরা আমার বাড়ি আক্রমণের হুমকি দিয়ে বহু লোককে ফোন করেছে। আমার স্ত্রী সবাইকে ম্যানেজ করেছেন। উপস্থিত ভীতু মহিলারা কেঁদে কেটে একাকার করেছেন। সাহসী নারীরা ইট, পাথর, মরিচের গুঁড়া সংগ্রহ করে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিলেন। লোকজনকে সাহস দেওয়ার জন্য আমার স্ত্রী জোরে জোরে চিৎকার করে বলছিলেন যে, আক্রমণকারীরা এলে একজনকেও আস্ত ফিরে যেতে দেওয়া হবে না— গুলি করা হবে। আমার সরল সোজা কিশোর ছেলেটি বলে উঠল, আম্মু! গুলি কীভাবে করবা— এবার তো বন্দুক আননি। বাবাও পিস্তল আনেনি। ছেলের মুখে এই কথা শুনে কান্নারত মহিলারা তাদের কান্নার গতি আরও বাড়িয়ে দিলেন। অনেকের হাত-পায়ে কাঁপন ধরল। আমার স্ত্রী এসব মহিলাকে একটি কামরায় ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে রাখলেন যেন তাদের ভয়ের ভাইরাস অন্য কাউকে আক্রান্ত না করে।

আলোচনার এ পর্যায়ে একটি কৌতুককর ঘটনা বলে আজকের নিবন্ধ শেষ করব। শত দুঃখ, বেদনা ও বাধাবিঘ্নের মধ্যেও রাজনীতির ময়দানে এমন সব ঘটনা ঘটে যা দেখে না হেসে পারা যায় না। আমরা যখন প্রচারণার মিছিল করি তখন নেতা-কর্মীরা সমস্বরে অদ্ভুত স্লোগান তুলে থাকেন। এর একজন স্লোগান ধরেন বাকিরা তা টানতে থাকেন। যেমন একজন বলেন— নেতা আছে! সবাই বলেন— আছে! কোন সে নেতা— অন্যরা বলেন রনি ভাই। তারপর স্লোগানকারী ইচ্ছামতো নানান কথা যেমন, এবার ভোটে, ইলেকশনে, হয়ে যাবে। আমার নেতা-তোমার নেতা যোগ্য নেতা— ইত্যাদি বলতে থাকেন এবং বাকিরা সমস্বরে রনি ভাই, রনি ভাই বলে উত্তর দিতে থাকেন। ঘটনার দিন আমরা দশমিনা উপজেলা সদরে কয়েক হাজার লোক নিয়ে মিছিল করছিলাম। একজন ভবঘুরে অর্ধপাগল ভিক্ষুক মিছিলের সামনে সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে স্লোগানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রনি ভাই রনি ভাই বলে যাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে স্লোগানকারী একটু বিরতি নিলে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভবঘুরে অর্ধপাগল স্লোগান দেওয়া শুরু করেন। তিনি যথারীতি বলতে থাকেন, ‘নেতা আছে?’ সবাই সমস্বরে উত্তর করেন ‘আছে’। পাগল বলেন, ‘কোন সে নেতা?’ সবাই বলেন ‘রনি ভাই’। এভাবে চলতে চলতে পাগল ও জনতার সম্মিলিত স্লোগানের ভাষা কোন পর্যায়ে গিয়েছিল তা শুনলে আপনার মন কিছুটা হলেও পুলকিত হতে বাধ্য।

পাগল বলেন, ‘তোমার নেতা’ জনগণ বলেন ‘রনি ভাই’, ‘যোগ্য নেতা’ ‘রনি ভাই।’ ‘ভালো নেতা’ ‘রনি ভাই’, ‘কানালুলা’ ‘রনি ভাই’, ‘ওরে বাবা’ ‘রনি ভাই’, ‘ওরে মাগো ‘রনি ভাই’, ‘বেশি কইরা’ ‘রনি ভাই’। ‘ভিক্ষা দ্যান গো’ ‘রনি ভাই’...।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর