শিরোনাম
শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

পোলট্রিতে নতুন সম্ভাবনা কাদাকনাথ

শাইখ সিরাজ

পোলট্রিতে নতুন সম্ভাবনা কাদাকনাথ

কয়েক মাস আগের কথা। অনলাইনে বেশ সাড়া জাগায় পৃথিবীর সবচেয়ে দামি এক মুরগির খবর। কুচকুচে কালো রঙের মুরগি। যুগে যুগে কালোর কদর না থাকলেও কুচবরণ এই মুরগি এখন গুরুত্বের বিচারে কদর পাচ্ছে বেশি। যার হাড়, মাংস, জিব, মাথার ঝুঁটি এমনকি নাড়িভুঁড়ি— সবই কালো। এই ভিন্ন জাতের মুরগির নাম আয়্যাম কেমানি। এ জাতটির আদি ঠিকানা ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের কেমানি নামক এলাকা। খবর পাওয়া গেল যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার এক ব্রিডার পল ব্র্যাডশ এই কালো মুরগি বিক্রি শুরু করেছেন ২০১৩ সালে। সে সময়ই মিস্টার ব্র্যাডশ একেকটি মুরগির দাম হেঁকেছেন ২ হাজার ৫০০ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সর্বনিম্ন ২ লাখ টাকা। সেখানে এই কালো মুরগির নাম রাখা হয় ‘ল্যাম্বরগিনি পোলট্রি’। বিজ্ঞানীরা বলছেন, কালো টিস্যুর আধিক্যের এই জেনেটিক পরিস্থিতি ‘ফাইব্রেমেলানোসিস’ নামে পরিচিত। এই জাতটির সঙ্গে চীনের সিল্কি জাতের কালো মুরগির মিল রয়েছে। অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও লোভনীয় এই জাতের মোরগের ওজন হয় দুই থেকে আড়াই কেজি। মুরগির ওজন হয় দেড় থেকে দুই কেজি।

ইন্দোনেশিয়ার আয়্যাম কেমানি জাতটিই ভারতের মধ্যপ্রদেশে কাদাকনাথ বা কালা মাসি নামে পাওয়া যায়; যা সমগ্র ভারতবর্ষে বেশ আলোড়ন তৈরি করেছে। বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবীর যে প্রান্তেই যা থাক, তা হাতের কাছে পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগে না। নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার মজলিশপুর গ্রামের কামরুল ইসলাম মাসুদ নামে এক উদ্যোক্তা ঠিকই সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছেন কাদাকনাথ জাতের মুরগি। নিজের মুরগির খামারে ইতিমধ্যে বাণিজ্যিকভাবে পালন শুরু করেছেন।

এক সকালে বের হয়ে পড়লাম নরসিংদীর উদ্দেশে। মজলিশপুর গ্রামে ব্যস্ততা চারদিকে। পোলট্রি খামার এই গ্রামের অন্যতম আয়ের উৎস। আর মাসুদ এখানে বড় একটি ভূমিকা রেখেছেন। হাজির হলাম মাসুদের ব্যতিক্রমী মুরগির খামারে। ব্যতিক্রম বলছি এ কারণে যে, পোলট্রি খামারগুলোয় সাধারণত খাঁচায় মুরগি পালন করা হয়, কিন্তু মাসুদ মুরগি পালেন মাঠে ছেড়ে দিয়ে। এ রকম একটি খামার আমি দেখেছিলাম ইংল্যান্ডে। নানা জাতের মুরগি রয়েছে মাসুদের খামারে। তবে কালো মুরগিই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কুচবরণ মুরগির গুণের কোনো সীমা নেই।  পোলট্রি উদ্যোক্তা মাসুদ কাদাকনাথ জাতের মুরগি নিয়ে দেখছেন অনেক বড় স্বপ্ন। আর তার স্বপ্ন যে বাস্তবতায় মিলবে, তা-ই যেন সত্যি মনে হলো। শুধু মুরগি পালন নয়, এক দিনের বাচ্চা (ডে ওল্ড চিকস/ডিওসি) উৎপাদনও শুরু করেছেন প্রগতিশীল এই উদ্যোক্তা। এখান থেকে প্রতি মাসে উৎপাদন হচ্ছে প্রচুরসংখ্যক ডিওসি। অন্যান্য পোলট্রি মুরগির মতোই ২১ দিনে ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদন করছেন মাসুদ। প্রতি মাসে গড়ে ১৭০০-১৮০০টি ডিওসি। তিনি বলছেন, কাদাকনাথ মুরগির চাহিদা এখন তুঙ্গে। তার কাছ থেকে কেউ বাচ্চা নিতে চাইলে মাসখানেক আগে অর্ডার করতে হয়। বেশ চড়া দামের এই মুরগির বাচ্চা। এক মাস বয়সী একটি বাচ্চার দাম পড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। দেড় মাসের বাচ্চার দাম ১০০০ টাকা। আর দুই মাসের বাচ্চার দাম ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা।

কামরুল ইসলাম মাসুদ ইতিমধ্যে কাদাকনাথ জাতটি নিয়ে স্বউদ্যোগে অনেক দূর গবেষণা করেছেন। কাদাকনাথের তিনটি জাত সংগ্রহ করেছেন তিনি। একটি জাতের পালক সম্পূর্ণ কালো। দ্বিতীয় জাতটির গলার দিকটায় রুপালি রঙের ছটা লক্ষ্য করা যায়, যা ওয়াইট পেনসিল বা জেড পেনসিল নামে পরিচিত। আর তৃতীয় জাতটির গলায় আছে সোনালি রং; যা গোল্ডেন পেনসিল বলেই খ্যাত। তবে এদের সবারই মাংস-হাড় কালো, উচ্চতা ও ওজন সমান, খাদ্যাভ্যাস একই।

মাসুদের কাছে জানতে চাইলাম কুচকুচে কালো রঙের এই মুরগির এত কদর হওয়ার কারণ কী? তিনি জানালেন, বর্তমানে পোলট্রি ব্যবসায় যে ধস নেমেছে তার মূল কারণগুলোর একটি হচ্ছে খাদ্য খরচ বেশি। কাদাকনাথের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, খাদ্য খরচ একেবারেই কম। অন্য যে কোনো মুরগির চেয়ে এই মুরগির মাংসে পুষ্টি উপাদান রয়েছে বেশি। ফ্যাটের পরিমাণ একেবারেই কম। এমনকি কাঁচা ঘাসও বেশ স্বচ্ছন্দে খেয়ে নেয়। রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি বলে জানালেন মাসুদ। টার্কি পালনের ক্ষেত্রেও ঠিক এ রকম সুবিধার কথা বলতে শুনেছি টার্কি-খামারিদের।

৪৭ বছর বয়সী কামরুল ইসলাম মাসুদ মূলত একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত। আশির দশকে ছাত্রজীবনেই তার আগ্রহ জন্মে কৃষি খামার গড়ার। আগ্রহের পেছনের সূত্র ছিল সে সময়ের বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠান। তারপর দিনে দিনে গুছিয়েছেন তার খামার। এখন তার খামার আয়োজনের সবচেয়ে লাভজনক অংশ কাদাকনাথ মুরগি। একটি মুরগি সাত থেকে থেকে হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারছেন তিনি। বিপুল বাণিজ্যিক সম্ভাবনার চেয়ে এই উদ্যোক্তার কাছে বৈচিত্র্যময় মুরগির জাতটির সম্প্রসারণই বড় লক্ষ্য।

ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদনের জন্য একটি ছোটখাটো ইনকিউবেটরও রয়েছে খামারে। সব মিলিয়ে কালো মুরগি সম্প্রসারণের আয়োজন ও প্রস্তুতি বেশ পাকাপোক্ত। খামারের শ্রমিকরাও নতুন জাতের এই মুরগি দেখে অনেকটাই কৌতূহলী। কৌতূহলী এলাকার মানুষজনও। তারাও আগ্রহী হচ্ছেন এই মুরগি পালনে। ফেসবুক ও ইউটিউবের কল্যাণে মাসুদের কাদাকনাথ মুরগির খবর ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন আসছে মুরগির বাচ্চা ও ডিম সংগ্রহের জন্য। এ বছরের ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ আয়োজনে বিভিন্ন জেলার পোলট্রি ও লেয়ার খামারিদের অভিযোগ ছিল তারা লাভ পাচ্ছেন না, উঠছে না উৎপাদন খরচ। তারা অভিযোগ করেছেন, অনেকের পোলট্রি খামার শূন্য, তারা অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। বড় বড় প্রতিষ্ঠান পোলট্রি ফিড, ডে অল্ড চিকস (ডিওসি) উৎপাদনের কথা থাকলেও তারা বাণিজ্যিক আকারে পোলট্রি ও লেয়ার উৎপাদনে নেমে যাওয়ায় ক্ষুদ্র খামারিরা হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত। আবার বিভিন্ন রোগের প্রকোপে অনেক অঞ্চলের পোলট্রিতে নেমে এসেছে মহামারি। এই যখন দেশের পোলট্রি শিল্পের অবস্থা, তখন খামারিরা আশা খুঁজছেন টার্কি, তিতির, কোয়েল উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের। এবার নতুন করে যুক্ত হলো কাদাকনাথ।

প্রিয় পাঠক! নতুন ও উৎপাদনশীল কোনো কিছুর প্রতি বাংলাদেশের তরুণ উদ্যোক্তা ও শৌখিন খামারিদের আগ্রহ অনেক বেশি। তারা বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেমন আগ্রহী একইভাবে আগ্রহী নতুন নতুন জাত ও বৈচিত্র্য সংগ্রহের ব্যাপারে। কামরুল ইসলাম মাসুদ নিজস্ব আগ্রহ থেকেই তার খামারটি ভরে তুলেছেন দারুণ বৈচিত্র্যে; যা অন্য শৌখিন উদ্যোক্তাদের জন্য অনুসরণীয়। কাদাকনাথ মুরগি নিয়ে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করি। প্রয়োজন পরিকল্পিত উপায়ে দেশের ক্ষুদ্র খামারিদের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সহায়তার আওতায় নিয়ে আসা। বৈচিত্র্যপূর্ণ এসব গৃহপালিত পাখি ও প্রাণি সমৃদ্ধ করতে পারে আমাদের কৃষি খাতকে, মেটাতে পারে আমিষের চাহিদা। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কাদাকনাথ হতে পারে পোলট্রি খামার ও বাণিজ্যের এক নতুন সম্ভাবনা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর