রবিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

সর্বগ্রাসী দুর্নীতি থেকে দেশকে রক্ষা করুন

নূরে আলম সিদ্দিকী

সর্বগ্রাসী দুর্নীতি থেকে দেশকে রক্ষা করুন

অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ পর্যন্ত শাসনতান্ত্রিক বিধানমতে একাদশতম সংসদ নির্বাচন হতে হবে। শুধু সাংবিধানিক বিধানের কারণেই নয়, এটি দেশের প্রান্তিক জনতার প্রত্যাশাও বটে। সেই ১৯৩৫ সাল থেকে যত নির্বাচন হয়েছে, সব নির্বাচনেই এ উপমহাদেশ, বিশেষ করে বাংলার মানুষের উৎসাহ উদ্দীপনা উল্লেখ করার মতো। আমাকে বলতেই হয়, এটা বিভাগ-পূর্ব সমগ্র বাংলার জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের রায়ের প্রেক্ষাপটে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা অর্জিত হয়। যদিও তদানীন্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলির প্রতিনিধি লর্ড মাউন্টব্যাটেন তার অন্তর্নিহিত ক্ষোভের কারণে রেডক্লিফের মাধ্যমে বাংলার বিভক্তিতে প্রচণ্ড হেরফের করান। নইলে মালদহ বিভক্ত হতো না, মুর্শিদাবাদও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গেই থাকত। এমনকি কলকাতাও পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে পড়ারই সম্ভাবনা ছিল। অবশ্য ইতিহাসের বিশ্লেষকরা বলেন, স্বয়ং জিন্নাহ সাহেব কলকাতাকে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত করতে আগ্রহী ছিলেন না। কেননা, তাহলে তার পক্ষে করাচিকে পাকিস্তানের রাজধানী করা সম্ভব হতো না।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের জাতির জনক। মুসলিম লীগ তার অঙ্গুলি হেলনে চলত। যদিও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বংশীয় আভিজাত্য এবং প্রতিভাপ্রদীপ্ত জ্ঞানের আলোকে অবিভক্ত ভারতের মুসলমানদের কাছে এতটাই উচ্চমাত্রায় অধিষ্ঠিত ছিলেন যে, তিনি আপন প্রতিভায় তখনকার রাজনীতিতে মরুভূমির নিষ্কলুষ সূর্যরশ্মির মতো আলো ছড়াতেন। তবুও জিন্নাহ সাহেব তাকে বিশ্বাসের আবর্তে নেননি এবং স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতিভা এবং জনপ্রিয়তাকেও ব্যবহার করেননি। এমনকি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানের সংসদে আস্থাভোট গ্রহণের কৌশলে তাকে মুখ্যমন্ত্রী থেকে সরিয়ে খাজা নাজিমউদ্দীন সাহেবকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়। কথাটির অবতারণার কারণ হচ্ছে, এদেশের মানুষ, প্রান্তিক জনতা আগাগোড়াই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। বিরল হলেও সত্য— কোনো সাধারণ নির্বাচনেই বাংলার মানুষের রায় ভুল ছিল না। এদেশের মানুষ পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রের মতো শিক্ষাদীক্ষায় অতখানি অগ্রসর না হলেও গণতান্ত্রিক চেতনায় উজ্জীবিত বাঙালির পরিশীলিত ও পরিমার্জিত মননশীলতা, মৌলিক অধিকার রক্ষায় তাদের প্রতীতি ও প্রত্যয় বিশ্বের কাছে বিস্ময়কর। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জনে এ বঙ্গসন্তানদেরই বুকনিঃসৃত রক্ত দান করতে হয়েছে।

৪৭ থেকে ৫৪; মাত্র সাতটি বছর। এ সাত বছরে ষড়যন্ত্রের পর ষড়যন্ত্র। আমাদের ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ওপর আঘাতের পর আঘাত। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানকে কলোনি বা বড়জোর অঙ্গরাজ্য বানানোর কূটকৌশলের বিরামহীন খেলা। কিন্তু বাঙালি অবলীলাক্রমে সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করেছে। কী অদ্ভুত, অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত! তারা বাহান্নর বুলেটের প্রতিশোধ নিয়েছে ৫৪র নির্বাচনের ব্যালটে। দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তানে সাত বছরের মাথায় বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ একটি প্রত্যয়দৃপ্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারায় সোপান উত্তরণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির উন্মেষ বিকাশ ব্যাপ্তি ও সফলতার ফসল ১৯৭০-এর নির্বাচনের নিরঙ্কুশ রায়। যার স্রোতধারায় নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনা।

অতীতের এ ঘটনার পুনরুল্লেখ করা এ জন্যই যে, বর্তমান শাসকমহলকে বিনম্রচিত্তে স্মরণ করিয়ে দেওয়া— মৌলিক অধিকার ও স্বকীয় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কোনো ত্যাগ স্বীকারেই বাংলার উদ্বেলিত জনতা কখনো দ্বিধাগ্রস্ত ছিল না। প্রত্যয়দৃঢ় ছিল তাদের পদক্ষেপ, অকুতোভয় ছিল তাদের চিত্ত এবং নির্ভুল ছিল তাদের ধারাবাহিক আন্দোলন। অকস্মাৎ বিস্ফোরিত কোনো গণবিচ্ছিন্ন আন্দোলন নয়, বরং সুপরিকল্পিত ও সুচিন্তিত, প্রতীতি ও প্রত্যয়ে আন্দোলনের একেকটি সোপান উত্তরণের মধ্য দিয়ে বাঙালি ভাষা আন্দোলন থেকে স্বায়ত্তশাসন, স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে বিজয়ী হয়েছে। মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে বাঙালি কখনোই দ্বিধাগ্রস্ত বা আপসকামী ছিল না। থাকলে মৌলিক অধিকার-বিবর্জিত সামরিক শাসক আইয়ুব খানের তথাকথিত উন্নয়নকে বাঙালি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করত না, গণসমুদ্রের ফেনিল চূড়ায় ভিসুভিয়াসের মতো জ্বলে উঠত না।

মৌলিক অধিকার-বিবর্জিত আজকের রাজনৈতিক অঙ্গনে যেসব অভিজ্ঞতা-বিবর্জিত অর্বাচীন রাজনীতিক উন্নয়নের ঢাকঢোল পেটাচ্ছেন. তাদের অভিজ্ঞতার অভাব বাঙালির আবহমান রাজনৈতিক ঐতিহ্যে মৌলিক অধিকার-বিবর্জিত সমাজ ব্যবস্থাকে তারা কখনোই প্রসন্নচিত্তে রাজনৈতিক সমাধান হিসেবে মেনে নেয়নি। 

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও উন্নয়ন কাজে প্রণোদনা প্রদানের লক্ষ্যে ব্যাংক মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ১৬৭ কোটি টাকার বিরাট অঙ্কের অনুদান দেওয়ার অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠে একটি উচ্চারণ করেছেন। বিনিয়োগ খাত ক্রমশ নিরুৎসাহিত হচ্ছে। কোনো শিল্প-কারখানা নতুনভাবে গড়ে তো উঠছেই না, বরং চালু থাকা শিল্প-কারখানাগুলো ধুঁকে ধুঁকে চলছে। এগুলো সম্প্রসারণ তো দূরে থাক, শিল্প-কারখানাগুলো প্রায় অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। এটি দেশের শিল্প খাতের বাস্তব চিত্র। এ বাস্তব চিত্রটি বক্ষে লালন করে তাদেরই একটা বিরাট প্রণোদনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক ডিজিটে, অর্থাৎ— সর্বোচ্চ ৯% এর মধ্যে নামিয়ে আনতে হবে। উচ্চারণটি অত্যন্ত দৃঢ় এবং বাস্তবায়িত করার অঙ্গীকারমুখী ছিল বলেই পরিলক্ষিত হয়েছে। এর আগেও অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে তিনি একই কথা উচ্চারণ করেছিলেন। কিন্তু এবারের আঙ্গিক, প্রেক্ষাপট এবং উচ্চারণের প্রত্যয়দৃঢ়তা ছিল ভিন্নমাত্রিক। শুধু শিল্প খাতই নয়, সমগ্র বাণিজ্যিক খাতই সরকারপ্রধানের এ প্রত্যয়দৃঢ় উচ্চারণে অনুপ্রাণিত হয়েছে। অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষক, বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা সুদৃঢ় ইতিবাচক মন্তব্যও করেছেন। আমি ব্যবসায়িক মহলের মহাজন না হলেও একটি সাধারণ অংশ। তা সত্ত্বেও দেশি-বিদেশি অনুন্নত-উন্নত ও সর্বোন্নত দেশগুলোর শিল্পোন্নয়নের কারণসমূহ জানার চেষ্টা করি। আমার অন্বেষণে কোনোভাবেই দৃষ্টিগোচর হয়নি, শিল্প ও বাণিজ্য খাতে পৃথিবীর কোথাও ১৫% থেকে ১৮% পর্যন্ত ব্যাংকের সুদ হতে পারে। যে দেশ আজ শিল্পে সর্বোন্নত, তারা আমাদের সুদের হার দেখে শুধু ভূত দেখার মতো চমকেই উঠেন না, মনে করেন, হয় আমরা অর্থনৈতিকভাবে কাণ্ডজ্ঞানহীন অথবা বদ্ধ উন্মাদ। যে কোনো ব্যবসায় সুদের এ বোঝা দুঃসহনীয় এবং ব্যবসা সম্প্রসারিত করা তো দূরে থাক, কোনোরকমে লোকসান গুনে গুনে টিকে থাকাই আজকে দুঃসাধ্য। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, এত লোকসান ও ঘাটতির পরও ব্যবসায়ীরা কেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো চালু রাখছেন? প্রশ্নটির উত্তর সহজ এবং সংক্ষিপ্ত। সৎ ব্যবসায়ীরা গ্যাঁড়াকলে আটকে গেছেন। তাদের অবস্থা যত দুর্বিষহই হোক না কেন, তারা এ দুঃসহ ও দুর্বিষহ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পাচ্ছেন না ব্যাংকের দায়দেনার কারণে ও শ্রমিক বিক্ষোভের ভয়ে।

শুধু প্রধানমন্ত্রীর উক্তি ও আশ্বাসই যথেষ্ট নয়, শিল্প-বাণিজ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে এর আশু সমাধানের উপায় বের করতে হবে। না হলে শিল্প খাতে যে প্রচণ্ড ধস নামবে তা সিডর ও সুনামির চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। যারা পোশাক শিল্পে আছেন, তারা আজ মর্মে মর্মে টের পাচ্ছেন, কত ধানে কত চাল। ব্যাংকের চাপ, শ্রমিক আন্দোলনের আতঙ্কে তারা অনেকটাই চোখ-বাঁধা কলুর বলদের মতো ঘুরছেন। আজকের উন্নত বিশ্বে শিল্প খাতে শূন্য থেকে ৩% বা ৪% এর ওপর বিনিয়োগের কোনো সুদ নেই, এটা শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বোন্নত দেশ জাপান। সেখানে শিল্প-কারখানা বিনির্মাণে সুদ তো নেই-ই, বরং উত্পাদিত যে কোনো পণ্যের রপ্তানিতে ৫% অবধারিত ইনসেনটিভ রয়েছে। উত্পাদিত মূল্য এবং রপ্তানি মূল্য সমান হলেও এ ৫% প্রণোদনা শিল্প-কারখানার উত্তরোত্তর উন্নয়নে সেখানে যথেষ্ট অবদান রাখছে। শিল্পপতিদেরও হালহকিকত সুস্বাস্থ্যকর।

এমনিতেই জাপানের সাধারণ মানুষ এবং শ্রমিকেরা অত্যন্ত পরিশ্রমী ও সুশৃঙ্খল। পরিবারের প্রায় সবাই নিজ শিল্প-কারখানায় বিভিন্ন দায়িত্বে কাজ করে থাকেন। জাপানে আরেকটি অদ্ভুত ও আশ্চর্যজনক পরিবেশ আবহমান কাল থেকে চলে আসছে। শ্রমিকরা মালিকপক্ষের কোনো সিদ্ধান্ত বা কর্মকাণ্ডে বিক্ষুব্ধ হলে তাদের প্রাপ্য ছুটি বাতিল করে বা উপভোগ না করে প্রতিবাদ করেন। জ্বালাও-পোড়াও ধরনের কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জাপানি শ্রমিকদের কোনো পরিচয় ছিল না, আজও নেই। মালিক-শ্রমিক কেউ মিথ্যা বলেন না, কোনো মিথ্যা আশ্বাস দেন না। কারচুপির তো প্রশ্নই ওঠে না। রাষ্ট্রীয় খাতে বিশাল বিশাল প্রকল্পের কথা আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারব না। কিন্তু মোটামুটিভাবে শিল্পক্ষেত্র, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও সমাজ সম্পূর্ণ দুর্নীতি-বিমুক্ত। আর দুর্নীতি নেই বলেই মূল্যবোধের অবক্ষয় সৃষ্টি করারও কোনো প্রেক্ষাপট তৈরি হয় না। জাপানের প্রশংসাপত্র লেখার জন্য আমার এ নিবন্ধ নয়। আজকের লেখাটির মূল উদ্দেশ্য হলো, যে কোনো উপায়েই হোক, দুর্নীতিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা না গেলেও অনতিবিলম্বে তার রেশ টেনে ধরতে হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশে দুর্নীতিবাজরা রাজনীতি ও প্রশাসনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তাদের সবার না হোক, বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করলে এ দুর্বিষহ দুঃশাসন থেকে কিছুটা মুক্তি পাওয়া যাবে। যেটা শিল্পায়নের পক্ষে অত্যাবশ্যক।

আজকে ব্যাংকের যে তারল্য-সংকট, এটাও সৃষ্টি করেছেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কয়েকটি সৌভাগ্যবান প্রতিষ্ঠান এতটাই প্রভাবশালী যে, তাদের কাছে ব্যাংক কর্মকর্তারা তো কোনো ছাড়! অনেক জাঁদরেল মন্ত্রীও এমনভাবে তাদের সমীহ করে চলেন যে মনে হবে, তারা প্রজাতন্ত্রের মন্ত্রী নন, তাদের অফিসের দাফতরিক। ব্যাংক ঋণে সুদের হার এক ডিজিটে কেন, ৫% থেকে ৬% এর মধ্যেও নামিয়ে আনা সম্ভব, তারল্য সংকটও কাটতে পারে। দুর্নীতি বন্ধ করে সৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর পথচলাকে সুগম করতে হবে। নিরুৎসাহিত রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন করে চলার বাস্তবমুখী সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা করে তাদের মেরুদণ্ড সোজা করে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

বর্তমান সরকার ভোটারবিহীন নির্বাচনে এবং ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য পেয়ে সরকার গঠন করলেও কোনোরকমের রাজনৈতিক চাপ, হরতাল-ধর্মঘট বা বিক্ষোভের সংকট-বিমুক্ত অবস্থায় বলতে গেলে নির্বিঘ্নে বিরোধী দলের অস্তিত্ব ছাড়াই আশ্চর্যজনক নীরবতায় রাষ্ট্র পরিচালনা করার বিরল সুযোগ পেয়েছে। ছোটখাটো দুয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর এমন নির্বিঘ্নে সরকার পরিচালনার সৌভাগ্য আর কারও হয়নি। সরকারি দল ও জোটের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে দিয়ে নর্তন-কুর্দন করছেন। গণতন্ত্রের পক্ষে তারা যতই তার স্বরে চিৎকার করুন না কেন, দেশে মৌলিক অধিকার নেই, জানমালের নিরাপত্তাও প্রায় শূন্যের কোটায়। আইয়ুব খানের আমলে আমরা আন্দোলনের পথ-পরিক্রমণ করেছি। তখনকার বিরোধী দলের কর্মী হিসেবে মিছিলে লাঠিপেটা খেয়েছি, টিয়ারগ্যাস আমাদের মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করেছে, অনেকবার মিছিলে গুলি হয়েছে। আন্দোলনকারীর বুকের রক্তে পিচঢালা পথ লাল হয়ে গেছে। তবুও আন্দোলন করার অধিকারবোধ আমাদের চিত্তকে সমুন্নত রাখত, অস্তিত্বকে গৌরবান্বিত করত, প্রত্যয় ও প্রতীতিকে ভূলুণ্ঠিত হতে দিত না।

আজকে মিছিলই হয় না; লাঠিচার্জ বা টিয়ারগ্যাস ছোড়া হবে কোথায়? তবুও মানুষ আজ মৌলিক অধিকার-বিবর্জিত এ কারণে যে, র‌্যাব-পুলিশের নামে গ্রেফতার হলে ঘরে ফেরার নিশ্চয়তা নেই বললেই চলে। আগে আমরা কারারুদ্ধ হয়েছি, রাজবন্দী হয়েছি। কিন্তু কেউ কখনো গুম হয়নি। যারা সন্ত্রাস দমনের দায়িত্বে, প্রশাসনের বিভিন্ন অধিদফতরে, তারাই আজ শ্বেত-সন্ত্রাসের প্রতীক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অর্থ আহরণের আহ্বানের প্রবল চাপে মানুষ আজ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের অবস্থা ত্রাহি মধুসূদন। আগে গণবাহিনী ও রাত্রিবাহিনীর উপদ্রব ছিল, কিন্তু নিত্যনৈমিত্তিক নয়। আজকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্বে নিয়োজিত অধিদফতরসমূহের কর্মকর্তাদের সর্বব্যাপী দাপটে মানুষ দিশাহারা। র‌্যাব-পুলিশের নামে একবার ঘর থেকে উঠিয়ে আনলে তার ফিরে যাওয়াটা অনেকটা স্বপ্নের মতো। যারা ফিরে গেছেন, তাদেরও চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। সামনে নির্বাচন; তাই ক্ষমতাসীন দলকে এসব বিশ্লেষণ নিখুঁত ও নিরপেক্ষভাবে করতে হবে। দেশটা অনেকটা বিরোধী দলশূন্য বলা চলে। আমাদের সময়ে নেতারা তো বটেই, আমাদের মতো কর্মীরাও গ্রেফতার হলে, সারা দেশ বিক্ষোভে বিস্ফোরিত হতো। আজ বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়া জামিন না পেয়ে কারারুদ্ধ হলেও তার দলীয় নেতারা স্বাক্ষর সংগ্রহ অথবা বড়জোর চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে রুটিন বক্তব্যের মধ্যেই আন্দোলন বিক্ষোভ সবকিছুকেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন। মজা রে মজা! শেখ হাসিনার জন্য সময়টা যেন কেবলই মজার। খালেদা জিয়ার জামিন নাকচ হলে আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় নেতাদের স্ব স্ব জেলা ও উপজেলায় অবস্থান নিয়ে সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু আফসোস, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কোনো স্লোগান আওয়ামী লীগের কোনো নেতা-কর্মী বা জনতা শুনতে পাননি। তবে এটা শোনা গেছে, জেলায় উপজেলায় বিএনপি নেতৃবৃন্দকে ডেকে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কড়া শাসিয়ে দিয়েছেন যে, কোনোরকম আন্দোলনের পদক্ষেপ নিলে গ্রেফতার করে নির্মম নির্যাতন করা হবে। ভাবতে অবাক লাগে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলে এবং তারও আগে ৬২ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হলে রাজনৈতিক ও ছাত্র নেতৃবৃন্দকে ডেকে তদানীন্তন রাজপ্রতিনিধিরা কি বলেছিলেন যে, আপনারা আন্দোলন করুন, আপনাদের মণ্ডা-মিঠাই দিয়ে সাদরে আপ্যায়ন করা হবে? আমাদের ওপর নির্যাতন-নিগ্রহ হয়েছে, লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস হয়েছে কিন্তু আন্দোলন নিস্তব্ধ হয়ে যায়নি। কারণ রাজনৈতিক কর্মীরা আদর্শে উজ্জীবিত ছিল, মূল্যবোধের অবক্ষয়ে নিমজ্জিত ছিল না। রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরে বিদ্যমান দুর্নীতি ও দুরাচার দূরীভূত করার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা না নিলে যে কোনো সময় পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে। কাজেই শেখ হাসিনার আত্মতৃপ্তির কোনো অবকাশ নেই।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

 

 

সর্বশেষ খবর