স্যার রবার্ট ওয়ালপোল ইংল্যান্ডের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন উইগ পার্টি থেকে। বনেদি স্কুল ইটন ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠ গ্রহণ শেষে তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যোগদান করেন মাত্র ২৫ বছর বয়সে। ১০ বছরের মধ্যেই দারুণ পদোন্নতি। একেবারে নৌবাহিনীর কোষাধ্যক্ষ থেকে সমর সচিব। প্রতিপক্ষ টোরি দল তাকে বিশেষ সুনজরে দেখেনি কখনই। ১৭১০ সালে টোরি দল ক্ষমতায় এসেই সংসদ থেকে বহিষ্কার করে স্যার ওয়ালপোলকে। ইতিমধ্যে স্যার ওয়ালপোল বিরোধী দলের একজন আপসহীন নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ওয়ালপোলের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় ক্ষমতাসীন টোরি পার্টি তাকে নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগতে শুরু করে। টোরি দলে যোগদানের জন্য প্রথমে তাকে লোভ এমনকি পরে হুমকিও দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি উইগ দলের প্রতি নিজের আনুগত্য বজায় রাখেন। এসব ঘটনার দুই বছর পর দুর্নীতির এক মামলায় অভিযুক্ত দেখিয়ে তাকে গ্রেফতার করে টাওয়ার অব লন্ডনে বন্দী করে রাখা হয়। তার এই জেলজীবন স্থায়ী হয়েছিল প্রায় মাস ছয়েকের মতো। কারাবাসকালীন সময়টাতেই হু হু করে বাড়তে শুরু করে তার জনপ্রিয়তা। ইংল্যান্ডের জনগণের কাছে তিনি প্রতিভাত হতে থাকেন একজন অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে। ১৭১৩ সালেই আবার পার্লামেন্টে ফেরেন স্যার রবার্ট ওয়ালপোল। ১৭১৪ সালে প্রথম জর্জ ইংল্যান্ডের রাজা ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়ালপোলের রাজনৈতিক পালেও হাওয়া লাগতে শুরু করে। তুখোড় বক্তা ও প্রজ্ঞাবান এই রাজনীতিবিদ ১৭২১ সালে ইংল্যান্ডের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। বাঘা বাঘা রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, ওয়ালপোলের সেই ছয় মাসের কারা নির্যাতনের কারণেই নাকি জনগণের কাছে তার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়। যে কদিন তিনি বন্দী ছিলেন তার প্রায় প্রতিদিনই উইগ পার্টির উপরের সারির নেতাদের মধ্যে কেউ না কেউ তার সাক্ষাত্প্রার্থী হতেন। এমনকি পরবর্তীতে তাকে রাজনৈতিক শহীদ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। ঐতিহাসিকরা বলেন, তার ঈর্ষণীয় রাজনৈতিক জীবনে অন্যতম প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছিল তার এই কারাবন্দীর ঘটনাটি।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেগম জিয়াসহ বিএনপির প্রায় সব নেতার মাথার ওপরে ঝুলছে শতসহস্র মামলা-মোকদ্দমা। আর তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের যে কী অবস্থা তা ভাষায় প্রকাশ করারও অতীত। বেগম জিয়ার মাথায় ঝুলছে ৩৫টির মতো মামলা। সত্তরোর্ধ্ব একজন মানুষকে দিনের পর দিন হাজিরা দিতে হয়েছে কোর্টে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে ৮৫টি এবং বেগম জিয়ার বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, যিনি কোনো দলের সাংগঠনিক কাজকর্মে নিযুক্ত নন। বরং যার কাজ হচ্ছে বেগম জিয়ার নির্দেশে তার রুটিন কাজগুলো সম্পাদন করা। সেই শিমুল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ৯৬টি মামলা! বেগম জিয়ার সঙ্গে তাকেও ঢোকানো হয়েছে গারদে। একটানা ২০ দিন রিমান্ডে রাখা হয় তাকে। অথচ এই মানুষটি কী অপরিসীম জনপ্রিয় সেটা বোঝা যায় যখন তিনি তার এলাকায় যান। লক্ষ্য সহস্র মানুষজনের জমায়েত হয়— শুধুমাত্র তাকে একনজর দেখার জন্য। সরকারদলীয় কর্তাব্যক্তিরা যদি একটু সচেতন হয়ে অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করতেন তবে অবশ্যই দেখতে পেতেন যে, নিপীড়িতদের প্রতি জনমানুষের সহানুভূতি সব সময় কিন্তু বেড়েই চলে। রবার্ট ওয়ালপোল, মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা, চিলির অবিসংবাদিত নেতা আলেন্দে কিংবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রেই শুধু উপরোক্ত বিষয়টি প্রযোজ্য নয়, বরং এটি একটি সর্বজনীন পর্যবেক্ষণ। আমাদের একটি বিষয় ভুলে গেলে চলবে না যে, বিশ্ব চরাচরে প্রকৃতি সর্বদাই একটি ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। দিনের শেষে যেমন রাত হয়। জোয়ারের পরে ভাটা। পৃথিবীতে বিস্তীর্ণ জলরাশি যেমন আছে ঠিক তেমনি আছে অবারিত স্থলভাগ। মানুষ অক্সিজেন গ্রহণ করে বেঁচে থাকে—অন্যদিকে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে। গাছপালা করে ঠিক তার উল্টো— অক্সিজেন ছেড়ে মানুষকে বাঁচতে সাহায্য করে অথচ নিজেরা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে বেঁচে থাকে। দিন ছাড়া শুধু রাত কি কখনো কল্পনা করা যায় কিংবা অমাবস্যা ছাড়া পূর্ণিমা? আমেরিকায় রিপাবলিক দল যেমন আছে ঠিক তেমনি আছে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। ব্রিটেনে যেমন লেবার, কনজারভেটিভ, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ইত্যাদি। পৃথিবী থেকে বর্তমানে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা একেবারে উঠেই যাচ্ছে বলতে হয়— ইদানীংকালে এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ সোভিয়েত ইউনিয়ন। একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনা একটি দুঃসাধ্য কাজ। গণমাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন টকশোতে অনেকেই সিঙ্গাপুরের প্রয়াত রাষ্ট্র প্রধান লি কুয়ান ইউর দৃষ্টান্ত আওড়ান, কিন্তু তারা বোধকরি শুধু লি কুয়ান ইউর নামটাই জানেন। লি কুয়ান ইউ তার প্রণীত দর্শন ‘অল্প গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন’ প্রতিষ্ঠা করার জন্য কী দুর্দান্ত পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সেটা তাদের জানা আছে কিনা এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। তিনি সিঙ্গাপুর থেকে দুর্নীতি সমূলে উৎপাটনের জন্য তার মন্ত্রিপরিষদ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বাড়িতে যেচে পড়ে দাওয়াত নিতেন, এটা দেখার জন্য যে, সেই মন্ত্রী কী পরিমাণ বিত্তবৈভব ও জেল্লা-জৌলুসের মধ্যে বাস করেন। তারপর তাদের রাজনৈতিকভাবে হত্যা করতেন। আর আমাদের দেশে চোখের সামনে এত বড় বড় কেলেঙ্কারির পরও কাউকে সাজা পেতে হয় না। এ জন্যই বলি ‘অল্প গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন’ কথাটি বলা বেশ সহজ কিন্তু এটি বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন। আর সে জন্যই গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প নেই বহু মতের ও দলের, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে সে দেশের সরকারকে সঠিক পথে পরিচালনা সত্যিই বেশ দুরূহ। আর এ জন্যই বোধহয় ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর জওহরলাল নেহেরু যখন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেন তখন তিনি সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলকে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল গড়ে তুলতে অনুরোধ করেছিলেন। প্যাটেলেরও ক্ষমতার প্রতি কোনো মোহ ছিল না বরং তিনি তাই চেয়েছিলেন। কিন্তু বাদ সাধলেন মহাত্মা গান্ধী। গান্ধী ভাবলেন প্যাটেলের মতো এমন একজন জাঁদরেল নেতার ভারতের জন্য নিশ্চয়ই কিছু করার আছে। আর সে জন্যই গান্ধীর ইচ্ছায় প্যাটেলকে উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে হয়েছিল।
বর্তমানে বিরোধীদলীয় লোকজনের দুরবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যেন সরকার তাদের অস্তিত্ব বিনাশে বদ্ধপরিকর। শুধু তর্কের খাতিরে বলছি, বিষয়টি যদি এভাবে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ৮ কোটি আওয়ামী লীগের সমর্থক, বাদবাকি ৮ কোটি বিএনপির সমর্থক। বিএনপির ৮ কোটি সমর্থককে আওয়ামী লীগ যদি বঙ্গোপসাগরেও নিক্ষেপ করে তারপরও কিন্তু এ সমস্যার সহজ সমাধান হবে না। বাংলা ভাষায় ‘চেলা-চামুণ্ডা’ বলে দুটি শব্দ প্রচলিত আছে। সাধারণত মানুষের কুসঙ্গ ও নেতিবাচক অর্থে এই শব্দ দুটো ব্যবহৃত হয়। আদতে এই চামুণ্ডা হলো সনাতন ধর্মে চামুণ্ডা দেবীর অনুসারী ব্যক্তিবর্গ যারা বাড়াবাড়ি রকমের ধার্মিক। দয়াশীল, দানধ্যান, জপতপ ও পুজোআচ্চা করে। বছরের মধ্যে অন্তত একবার ভারতের বিন্ধ্যাচলের বিন্ধ্যেশ্বরী অথবা কালীঘাটের দক্ষিণকালীর পাদপদে গিয়ে আশ্রিত হয় এবং সেই সঙ্গে আয়ের একটি মোটা অংশ খরচ করে পূজা পার্বণে। ফাঁসুড়ে ঠগদের মতো গলায় রুমালের ফাঁস এঁটে মানুষ মারা তাদের আরেকটি পেশা। পেশা বলা আসলে ঠিক হলো না— দেবী চামুণ্ডার নিত্যপূজার ব্রত হিসেবে তারা এ কাজ করে থাকে। মানুষ মেরে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয় বটে, কিন্তু আসল উদ্দেশ্য টাকা নয়— দেবীর সন্তুষ্টি অর্জন করা। এক একটা নরবধে বিস্তর পুণ্য। কাজটা আসলে দেবীরই কিন্তু মাটির তৈরি দেবী তো আর নিজে সেসব কাজ করতে পারে না, তাই তার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে তার অনুসারীরা। মন্ত্র পড়া এরকম গুড় আছে ফাঁস দিয়ে মানুষ হত্যা করার আগে দলের সবাইকে সে গুড় খাইয়ে দেওয়া হয়। মুহূর্তের মধ্যেই সে ভিন্ন একজন হয়ে ওঠে। মানুষের গলায় ফাঁস দেওয়ার জন্য হাত নিসপিস করে। ঠিক সেই মুহূর্তে ফাঁস দেওয়ার জন্য বাইরের মানুষ না পেলে শেষটায় হয়তো হাতের রুমালে নিজেরাই নিজেদের গলায় ফাঁস টেনে আত্মহত্যা করে। সে জন্যই বলছি বিরোধী পক্ষকে রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করে কারও কোনো লাভ হবে না। কারণ ৮ কোটি বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থককে নিপাত করলেও বাকি ৮ কোটির মধ্যেই তৈরি হবে বিভাজন। তখন নিজেরাই নিজেদের শেষ করার জন্য আত্মঘাতী হয়ে ওঠবে। প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে ক্ষমতা হয়তো কিছু দিন দীর্ঘায়িত করা যাবে— তাতে করে ব্যক্তি স্বার্থসিদ্ধি হয় বটে কিন্তু দলের ক্ষতি হয় অপূরণীয়। বর্তমান সময়ের পেক্ষাপটে খালি চোখে হয়তো সেই ক্ষতি ধরা পড়ে না। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে তা প্রতিভাত হবেই। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন তাদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখা। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার— এসব বিষয় রাষ্ট্রযন্ত্রের মূল স্তম্ভ। যে কোনো রাষ্ট্রে এগুলো নিশ্চিত করা গেলে দেশ এগিয়ে যাবেই। কলেজ জীবনে আমি বাম ধারার একটি ছাত্র সংগঠন করতাম, এ ছাড়া আমার কোনো রাজনৈতিক বিশ্বাসও ছিল না। কোনো দিন মনে হয়নি— অমুকে ক্ষমতাচ্যুত হলে এবং সে জায়গায় অমুক এলে সব ঠিক হয়ে যাবে। সর্বদাই আমার মনে হয় রাষ্ট্র ও প্রশাসন মানে একটি অন্ধ কবন্ধ দানব। কিন্তু জীবনের এ পর্যায়ে এসে এ উপলব্ধি হলো যে, সেই অন্ধ কবন্ধ দানব আরও অতিকায় হিংস্র দানবে পরিণত হয়— যখন দেশে গণতন্ত্র ও বিরোধী দলের মত প্রকাশের অধিকার থাকে না। আইনের শাসন ও গণতন্ত্রহীন রাষ্ট্রে তৈরি হয় ভয়ানক অরাজক পরিস্থিতি।রাজনৈতিক অস্থিরতার এই ডামাডোলে মাঠে প্রান্তরে কিংবা রাস্তাঘাটে বাসে আগুনে পুড়ে যেমন নিরীহ মানুষ মারা যায় ঠিক তেমনি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুম, খুন ও নিরুদ্দিষ্ট হয় সংখ্যাহীন নিরীহ জনগণ। কারণ সাধারণত যারা রাস্তাঘাট ও বাসে নাশকতা করার মতো হিম্মত রাখেন তারা বেশ ভালো করেই জানেন কীভাবে নিজেকে আত্মগোপন করে রাখতে হয়। বিএনপি সম্পর্কে অনেকেই মন্তব্য করেন বিএনপি এক সময় মুসলিম লীগের মতো দেউলিয়া ও নিঃস্ব হয়ে যাবে। তাদের এই বিশ্লেষণে আমি বেশ কৌতুক বোধ করি। মনে মনে ভাবী আহ্া— এই মানুষগুলোর ইতিহাসবোধের কতই না অভাব! ইতিহাসের নিরিখে বলা যায়, বিরোধী পক্ষের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণই তাদের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়াবে, কারণ মানুষ যখন তার অস্তিত্ব নিয়ে সংকট ও শঙ্কায় পড়ে তখন সে আরও বেশি করে সংগঠিত হয় ও সুদৃঢ় করে তার অবস্থান। নাইন-ইলেভেনের পরে পশ্চিমা দেশগুলো যখন মুসলমান জনগোষ্ঠীর ওপর বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে তখন আমি বিলেতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র। সে সময়টায় আমি দেখেছি কীভাবে দলে দলে মানুষ মসজিদগামী হয়ে উঠেছে। মুসলিম মেয়েরা মাথায় হিজাব এঁটে ঘুরে বেড়াত শুধু এটা দেখানোর জন্য যে— দেখ আমি একজন মুসলমান। পারলে আমায় কিছু কর। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারানোর পর পুনরায় দলটি ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে। দীর্ঘ ২২ বছর তারা ক্ষমতার বাইরে ছিল, তাতে করে কি দলটি শেষ হয়ে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ শেষ না হলে বিএনপি শেষ হয়ে যাবে কিংবা দেউলিয়া হয়ে যাবে এটি ভাবা বোকামি ছাড়া তো আর কিছু নয়। সবকিছুই হয়তো থাকবে কিন্তু ইতিহাসে এটাই লেখা হবে যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেশে ছিল না পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র। আর ভবিষ্যতে এটা আওয়ামী লীগের জন্য খুব একটা সুখকর হবে না। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে যদি আবার কখনো গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হয় তখন তারা গণতন্ত্রের পক্ষে জোরালো বক্তব্যও রাখতে পারবে না। অনেকে বলে বেড়ান বিএনপি আন্দোলনে ব্যর্থ এবং এ দলটি কখনই আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। বিএনপি ব্যর্থ না কী সফল, এর ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি আছে কি নেই, এসব আলোচনার একটিতেও আমি যাব না। শুধু ইতিহাসের আলোকে এতটুকুই বলব, রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে সব সময় আন্দোলনের প্রয়োজন পড়ে না। ছোট ছোট অনেক ঘটনাও মাঝে-মধ্যে রাতারাতি রাজনীতির দৃশ্যপট পরিবর্তন করে দেয়। সমকালীন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এর নাম দিয়েছেন ‘রাজনীতির বাটারফ্লাই এফেক্ট’। রাজনীতির বাটারফ্লাই এফেক্ট মানে হচ্ছে সরকারের যে কোনো সামান্য ভুল রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে একটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। একটি দৃষ্টান্ত টেনে লেখাটি শেষ করছি। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক নামে আফ্রিকার হতদরিদ্র এক দেশে একবার ক্ষমতায় এলো ক্ষেপাটে এক ডিক্টেটর নাম জেনারেল বোকাসা। সে নিজেকে দাবি করল নেপোলিয়নের ভাবশিষ্য হিসেবে। তার দুর্নীতি ও ভোগবিলাস নিয়ে একটি মহাকাব্য রচনা করা যেতে পারে। বিরোধী মতের লোক হত্যা, খুন, জখম সরকারি অর্থ তছরুপসহ সব রকম কুকর্মে সে ছিল সিদ্ধ হস্ত। তার ক্ষমতালিপ্সা এক সময় আরও চরমে উঠল তখন সে নিজেকে দাবি করল সম্রাট হিসেবে। এ রকম একজন চরম কর্তৃত্ববাদী শাসকের বিরুদ্ধে বিরোধী দল তো দূরের কথা বিশ্ব নেতারাও কিছু করতে পারল না। শেষটায় তার পতন ঘটল স্রেফ একটা খামখেয়ালিপনার কারণে। বোকাসার খুব শখ ছিল ইউনিফর্মের। এই দেশটির মতো এমন একটি গরিব দেশে বোকাসা নিয়ম করে দিল প্রত্যেক বাচ্চাকে স্কুল ড্রেস পরতে হবে। না পরলে ভয়ানক শাস্তি। হতদরিদ্র দেশের জনগণ যেখানে খেতেই পায় না সেখানে এসব কাপড়ের টাকা জোগাড় করবে কোত্থেকে। অবশেষে তীব্রভাবে দেখা দিল জনরোষ। বিশ্ববিবেকের টনক নড়ল। দেশটি এককালে ফ্রান্সের কলোনি ছিল বলে ফ্রান্সই এগিয়ে এলো প্রথমে। তাদের সহযোগিতায় বোকাসাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। কিংবদন্তি আছে যে, স্কুল ড্রেস না পরার কারণে বোকাসা নাকি ১০০ বাচ্চাকে তার রাজপ্রাসাদে বন্দী করে হত্যা করেছিল। উপরোক্ত আলোচনায় এটি স্পষ্ট যে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে গণতন্ত্রের প্রশ্নে এক হতে হবে। ভাবতে হবে একটি দল আরেকটি দলের পরিপূরক। সুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে যে কোনো মূল্যে এই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তা না হলে আগামী দিনগুলোতে আমাদের সামনে শুধুই এক গভীর অন্ধকার সময় অপেক্ষা করছে।
লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।
ই-মেইল : [email protected]