শনিবার, ২৬ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

ট্রাফিক জ্যাম ট্রাফিকেই

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

ট্রাফিক জ্যাম ট্রাফিকেই

ট্রাফিক জ্যাম কমবেশি সব দেশেই আছে। ট্রাফিক জ্যাম ব্যবস্থাপনায় একটা দেশের অর্থনীতিতে সাধিত ক্ষতির পরিমাণ হু হু করে বেড়ে হিসাব-নিকাশের বাইরে চলে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে উপনীত হলে তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। একে নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগগুলোও ট্রাফিক জ্যামে আটকে গেলে পরস্পর প্রযুক্ত সমস্যার ডালপালা বিস্তার করতে থাকলে সে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার দারুণ দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়ে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সড়ক বেহাল অবস্থায় বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়। অনেক ভালো সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের থেকে আস্তে আস্তে ওপরে ওঠার সংবাদে আমরা পুলকিত হতে থাকি। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে থাকি। কিন্তু সড়ক বেহাল হওয়ার মেরিট লিস্টে দ্বিতীয় অবস্থান আমাদের রীতিমতো অতীব দুঃখজনক আখ্যায় বেদনার্ত হতে হয়। সেদিন আরও খবর বেরিয়েছে, খোদ ঢাকায় ট্রাফিক জ্যামে প্রতিদিন গড়ে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা খেয়ে ফেলছে, বেশি ভিড়ের সময় গাড়ির গতি ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাবমতে, ট্রাফিক জ্যাম বার্ষিক প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি করেও ক্ষান্ত হচ্ছে না। দিন দিন ক্ষতির প্রবৃদ্ধি জিডিপি বৃদ্ধির ব্যারোমিটারকে পরিহাস করে চলেছে।

সড়ক বেহাল থাকার সঙ্গে ট্রাফিক জ্যামের নাড়ির সম্পর্ক। সদ্য স্বাধীন দেশে নদীমাতৃক যোগাযোগ-ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে, কৃষিভিত্তিক দেশে জমি নষ্ট করে ও পানিপ্রবাহের পথ বন্ধ করে সড়ক ও সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় আশির দশক থেকে। সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ বাড়ে বাড়তি ব্যয় বৃদ্ধির জন্য। যার অর্থায়ন করে সেসব দেশ যাদের লক্ষ্য থাকে গাড়ি বিক্রির। সেই গাড়ি দামি জ্বালানি খরচ করে, যাতায়াতব্যবস্থায় ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যায় দৈনিক গড়ে ২০-২৫ জন। তাতে বাতাসে সিসার পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। বিদেশি দাতা ও সংস্থা সড়ক নির্মাণের টাকা দেয় কিন্তু সড়ক মেরামতের টাকা দেয় না। দেশে এতসব সড়ক ও পাতি সেতু নির্মিত হয়েছে তার মেরামত করার মতো অর্থ জোগান দেওয়া জাতীয় বাজেট থেকে সম্ভব হয় না। রোড রক্ষণাবেক্ষণ ফান্ড নামে একটি তহবিল গঠনের উদ্যোগটিই প্রায় দেড় দশক ধরে বাস্তবায়িত হয়নি। আর সড়ক নির্মাণে, গুণগতমান বজায় নিশ্চিতকরণে এত অপারগতা, এন্তার দুর্নীতি, দেখভালের দুর্বলতায় সড়ক নির্মাণের পর ইদানীং স্বল্পতম সময়ে তারা মেরামতযোগ্য হয়ে ওঠে। বর্তমান ট্রাফিক জ্যামের মুরব্বিস্থানীয়রা ‘গোল্ডেন এ’ পাওয়ার মতো কারণ সড়কের বেহাল অবস্থা।

ট্রাফিক জ্যামের দ্বিতীয় কারণ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটাল সিগন্যাল বাতিকে সাক্ষী ও কার্যকর রেখেও অ্যানালগ অর্থাৎ ট্রাফিক পুলিশের স্বেচ্ছাসিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়া। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা বুদ্ধিমত্তা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্বতা, নিয়মশৃঙ্খলা ও আইন-কানুন মেনে চলার ওপর নির্ভরশীল। ট্রাফিক পুলিশের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতার অভাব ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টির সহযোগী ভূমিকায় দেখা যায়। তার ওপর উপর থেকে ফোন এসেছে ভিভিআইপি ছাড়াও অমুক এই পথ দিয়ে যাবেন তাদের পথ করে দেওয়ার যুক্তিতে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য সড়কে যানবাহন চলাচল কিংবা আরও অনেকের জন্য শুধু সেই লাইন ক্লিয়ার রাখতে গিয়ে বিবেচনাহীনভাবে অন্য রাস্তা বন্ধ রাখা এসব তো হামেশা চলছে। এগুলো খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা না থাকায় ট্রাফিক পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার সম্পর্কে সন্দেহ দানা বাঁধছে।

যে দেশে বা মহানগরে ট্রাফিক লাইট ডিজিটাল আনন্দের সঙ্গে জ্বলতে থাকে, সে মাইন্ড করে না তাকে কেউ অনুসরণ করছে না দেখে, সে দেশে বাচ্চারাও বিস্মিত হচ্ছে রেডলাইট চললেও গাড়ি যাচ্ছে, গ্রিন লাইটেও গাড়ি থেমে থাকছে। দামি ডিজিটাল ট্রাফিক সিগন্যাল ক্রয়, সংস্থাপন ও চালু রাখায় যে অর্থ ব্যয় অব্যাহত রয়েছে অন্তত সে টাকাটাও যে প্রচণ্ড অপচয় এটা কারও মাথায় ঢুকেও ঢুকছে না। কারণ এখানেও কারও কিছু লাভ-লোকসানের সুযোগ আছে বলে নিন্দুকেরা মাঝেমধ্যে টিপ্পনি কাটেন। বিচার-বুদ্ধিতে অতিশয় হীনবল অথচ সংখ্যায় ভারী ট্রাফিক পুলিশ তখন এক বিরাট বার্গেনিং এজেন্টে পরিণত হয় একবার যখন ঢাকার দুই মেয়র মহোদয় ডিজিটাল পদ্ধতি অনুসরণে উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। কিন্তু এক দিনেই পরিস্থিতি এমন তৈরি হয়ে গেল, মনে হলো যেন সরকার পতনের পরিস্থিতি হয়ে যাবে। মেয়র মহোদয়গণ পিছিয়ে এসেছিলেন। এই ট্রাফিক পুলিশদের চটানো যাবে না। কেননা তারা ঢেউ গুনে পথে ভালো আয়-রোজগার করতে পারেন এবং সে আয়ের ভাগ যে পর্যায় পর্যন্ত যায় তাদের কাছেই এসব নিয়ন্ত্রণের ভার কিনা এ সন্দেহ দানা বাঁধছে। সার্ক ফোয়ারার মোড়ে কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জনরা প্রতিদিন নাকি যে আয়-উপার্জন করেন তার কোনো তথ্য প্রতিবেদন দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা না জানালেও নিন্দুকেরা, অসহায় পথচারীরা জানে। এই জানাজানিটা দেশের অর্থনীতির জন্য শুভপ্রদ নয়।

ট্রাফিক জ্যামের আরেক কারণ জনবহুল শহরে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের অভাব। বিশালকায় দ্বিতল প্রকৃতির বাসে যত যাত্রী বহন করা সম্ভব সীমিতসংখ্যক সিটের গেটলক ছোট ছোট বাসে তা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। এই ছোট ছোট বাস রাস্তা দখল করে বেশি এবং তারা ‘সিটিং’ যাত্রী পরিবহন করার জন্য ক্ষমতাবান। বড় ট্রান্সপোর্টের পরিবর্তে এই ছোট ছোট পরিবহন কেন ও কবে থেকে চালু হয়ে সড়ক পরিবহনব্যবস্থায় জগদ্দল পাথরের মতো চেপে আছে তার শুমার বা পর্যালোচনা করা কি কঠিন? হ্যাঁ, শোনা যায়, কঠিন হতে পারে কেননা যারা এটা করবেন তারা নিজেরাই তো নামে-বেনামে ওইসব বেশুমার বাসের মালিক। একটা জনবহুল দেশে, মাথাপিছু মহাসড়ক ও রাজধানীর রাস্তা জবরদখলের এই প্রয়াস-প্রচেষ্টায় হাজার হাজার ছোট ছোট বাস-টেম্পোকে কত ধারায় আটকানো যাবে, তা দেখভালে দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠছে। ইদানীং মোটরসাইকেল আরোহণ বিকল্প গণপরিবহনের বহরে যুক্ত হচ্ছে। পথ না থাকলেও পথ তো পেতেই হবে। আয়বৈষম্যের মেদবহুল অর্থনীতিতে এক এক পরিবারের তিন-চারটা করে গাড়ি ব্যবহারের আবদার ও অধিকার বজায় রাখতে গিয়ে গাড়ি চালানোর জন্য রাস্তা তৈরি না হলেও, সেদিকে নজর না রেখেও গাড়ি আমদানির অবাধ অব্যাহত ব্যবস্থা রাস্তাতেই অচলায়তন তৈরি হচ্ছে।

সাম্প্রতিককালে ট্রাফিক আইন প্রয়োগকে শক্তিশালীকরণের জন্য ট্রাফিক পুলিশকে যত্রতত্র ফাইন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এমনকি সিসি ক্যামেরায় ছবি তুলে আইন অমান্যের নোটিস দেওয়ার বিধান করা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য উদ্যোগ বলে মনে হবে। কিন্তু মামলা করার ডিসক্রিশনারি পাওয়ারটা অপব্যবহার হয়ে প্রয়োগকারীর বাড়তি আয়-ব্যয়ের (এই ফাইনকৃত অর্থের ৪০% প্রয়োগকারী পাবেন এমন বিধান থাকায়) পথ প্রশস্ত হচ্ছে কিনা তা দেখার দরকার অনুভূত হচ্ছে। হোমরা-চোমরা সংস্থার যাত্রীবিহীন বড় বড় গাড়ি রাস্তা দখল বদল করে বসে আছে তাকে কিছু না বলে সাধারণ মালিকের ব্যক্তিগত গাড়িকে অনেকটা মনগড়াভাবে ফাইন করা হয় বলে অভিযোগ উঠছে। এ নিয়ে একজন সচেতন নাগরিক পুলিশের আইজির কাছে বিষয়টি দেখার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। আইজি মহোদয় ট্রাফিকের ডিআইজিকে বিষয়টি তদন্ত করতে বলায় সাক্ষী-প্রমাণাদি নিয়ে পুলিশ দফতরে দৌড়াদৌড়ির জন্য ডাক বাড়ছে তার। ভদ্রলোক বলছেন, আমি তো কোনো অভিযোগ করিনি। আমি এ-জাতীয় বিষয়গুলোর প্রতি পুলিশপ্রধানের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি মাত্র। এখন দেখি আমার নিজেরই ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। যে ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য সুপারিশ বা পরামর্শ, সেই ব্যবস্থা নিজেই বাদী সেজে সুপারিশ বা পরামর্শকারীকে বিবাদী সাব্যস্ত করছে। তাহলে সংস্কার হবে কীভাবে? হাতিরঝিল প্রকল্প প্রণয়ন ও অনুমোদন কার্যক্রমের সঙ্গে একসময় জড়িত ছিলাম।

প্রকল্পটির একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সংশ্লিষ্ট এলাকায় ট্রাফিক জ্যাম উপশমের এবং নগরবাসীর হাঁফ ছাড়ার ও বেড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি। হচ্ছেও তাই। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে হাতিরঝিলের পাড়ে যত্রতত্র খাবারের দোকান বসিয়ে সেসব দোকানির খরিদ্দারদের গাড়ি রাখার জন্য মহার্ঘ্য সড়কে পার্কিং প্লেস বানাতে দেওয়া হয়েছে। ফলে নীরব ও নয়নাভিরাম হাতিরঝিল এখন হাট-বাজার ও রাস্তা দখল করে ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টির হেতুতে পরিণত হয়েছে। কে কোন ব্যবস্থাপনায় প্রকল্পের মৌল বৈশিষ্ট্য ও সুযোগসমূহে ব্যাঘাত ও ব্যত্যয় ঘটাতে পারছে, তা বোঝা যায় না।

লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান এবং পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর