শনিবার, ২৬ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিল ও হাওর এলাকার অর্থনীতিতে হাঁসের ভূমিকা অগ্রগণ্য

শাইখ সিরাজ

বিল ও হাওর এলাকার অর্থনীতিতে হাঁসের ভূমিকা অগ্রগণ্য

সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার খুটিগাছা। বিলের পাশে অবিরত সবুজ ধান খেত। ছোট্ট একটা গ্রাম। এবারের ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’-এর খেলাধুলার মূল অংশ ও প্রামাণ্যচিত্রের বেশকিছু দৃশ্য ধারণ করা হয় চলনবিলের এই এলাকায়।  শুকনো মৌসুমে যে রূপ দেখা যায়, বর্ষায় ঠিক তার উল্টো। বিলের পানিতে চারপাশ হয়ে ওঠে ডুবুডুবু। সেও এক মনোহর প্রাকৃতিক রূপ। কাজের সুবিধার জন্য শুকনো মৌসুমেই ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’-এর ধারণকাজ শুরু করি। গ্রামের চারপাশ ঘুরে দেখা গেল, এখানে ধান ও মাছের পাশাপাশি আর এক অর্থকরী খাত হচ্ছে হাঁস। গ্রামের তরুণরা তো বটেই, গৃহিণীরাও যুক্ত হয়েছেন হাঁস পালনে। শুধু খুটিগাছা নয়, চলনবিলের আশপাশের অন্যসব গ্রামের অর্থনৈতিক চিত্রও পাল্টে দিয়েছে হাঁস।

কথা হলো খুটিগাছার জাহানারা খাতুনের সঙ্গে। তিনি দিনমজুর স্বামীর বউ হয়ে এসেছিলেন এই গ্রামে। স্বামীর কোনো কৃষিজমি নেই। পরের জমিতে কাজ করে যে আয় তাতে সংসার চালানো কঠিন। কোনো দিন দুই বেলা, কোনো দিন এক বেলা, আবার কোনো দিন চেয়েচিন্তে খেয়ে, না খেয়েও দিন পার করেছেন। স্বামীর পাশাপাশি কিছু একটা করে সংসারের আয় বাড়ানোর চিন্তা ছিল তার সব সময়। কিন্তু কী করবেন, নেই লেখাপড়া, গ্রামে নেই বিকল্প কর্মসংস্থানের কোনো উপায়। একদিন গ্রামের আবদুল আলিমের হাঁসের খামার দেখে মনে হলো তিনিও তো হাঁস পালতে পারেন। ৫-৬টা হাঁসের বাচ্চা দিয়ে শুরু করলেন। এখন তার হাঁসের সংখ্যা ১ হাজারের বেশি। কয়েক দিন আগে বিক্রি করে দিয়েছেন পরিণত হাঁসগুলো। খালে যে ৪০০-৫০০ হাঁস রয়েছে তাও বিক্রি হয়ে যাবে সামনের মাসে। চার বছরে পাল্টে গেছে তার আর্থ-সামাজিক অবস্থা। কৃষিজমি কিনেছেন ১০ কাঠা। বড় ছেলেটা স্কুলে যায়। হিসাব করে দেখালেন মাসে আয় থাকে ১৫ হাজার টাকারও বেশি। গ্রামের একজন নারী ঘরে বসেই পাল্টে নিয়েছেন নিজেকে। পাল্টে দিয়েছেন সমাজ ও পরিবারকে। তিনি এখন পরিবারের একমাত্র ভরসার জায়গা।

খুটিগাছা গ্রামের শুধু জাহানারাই নন, কথা হলো সাজু আক্তার নামের আরও এক নারীর সঙ্গে। তিনিও জানালেন তার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। অনেকটা জাহানারার মতোই। হাঁস পাল্টে দিয়েছে তাদের জীবন। সাজু আক্তারের আগ্রহ বেশি রাজহাঁস পালনে। জানালেন রাজহাঁস পালনে লাভটা বেশি। সবচেয়ে বড় কথা রাজহাঁসের রোগবালাই কম হয়। এলাকাটির সঙ্গে হাওরাঞ্চলের তেমন তফাত নেই। গ্রামের ভিতর দিয়ে আশপাশের ডোবা রাস্তায় হাঁসের ঝাঁকের দেখা মেলে। ছোট-বড় অসংখ্য খামার গড়ে উঠেছে এখানে। স্থানীয়দের দাবি, শুধু তাড়াশ উপজেলাতেই হাঁসের খামার রয়েছে ৮০০-এর মতো। হাঁস পালন করে জাহানারা ও সাজুর মতো বহু অভাবী পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে। এখন অনেকেই বছরের পুরোটা সময় হাঁস পালন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। হাঁসের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর কাজেও নিয়োজিত রয়েছেন কেউ কেউ। আবার অনেকেই হাঁস পালন করতে ছুটে বেড়ান দূরদূরান্তে। সব মিলিয়ে স্থানীয় মানুষের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনে বড় একটি ভূমিকা রাখছে হাঁস।

একই  গ্রামের আবদুল আলিমের ৩০ বছর ধরে হাঁসের খামার। এর আগে ছিলেন কৃষিশ্রমিক। হাঁস পালনের আয় দিয়েই কিনেছেন ৭ বিঘা জমি। ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছেন। অন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ১৫০ জন খামারিও তৈরি করেছেন তিনি।

এ এলাকার শত শত হাঁসের খামারে ভালোমানের বাচ্চা পাওয়া একসময় অনিশ্চিত ছিল। সেই অনিশ্চয়তা ঘোচাতে স্থানীয়ভাবে এখন বেশ কয়েকটি হ্যাচারি গড়ে উঠেছে। যেখান থেকে মানসম্মত হাঁসের বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে। একেবারেই স্থানীয় টেকসই প্রযুক্তি হারিকেন পদ্ধতিতে হাঁসের বাচ্চা ফোটাচ্ছেন আমির হোসেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে নব্বই দশকেই আপনাদের সামনে প্রতিবেদন তুলে ধরেছিলাম তুষ পদ্ধতিতে হাঁসের বাচ্চা উৎপাদনের কার্যক্রম নিয়ে। সেই একই পদ্ধতি ব্যবহার করে এখনো সাফল্যের মুখ দেখছেন অনেকেই। আমির হোসেন তাদেরই একজন। এখন ৩০ হাজার ডিমের বাচ্চা ফোটাচ্ছেন। তার শুরুটাও শূন্য থেকে। এখন সফল একজন খামারি।

আর এক শিক্ষিত তরুণ রবিউল ইসলাম। বর্ষা মৌসুমে তিন মাস হাঁস পালেন। তিনি জানালেন প্রতি বছর এই তিন মাসে ৫০০ হাঁস পালন করে তার লাভ থাকে কম করে হলেও ১ লাখ টাকা।

একই গ্রামের এই মানুষগুলোর সাফল্যের গল্প জড়িয়ে আছে একটির সঙ্গে অন্যটি। ডাক ভ্যালু চেইন তথা হাঁস পাল্টে দিয়েছে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা। মনে আছে ২০১২ সালে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে হাওরাঞ্চলের হাঁস পালন নিয়ে একটা প্রতিবেদন তৈরি করেছিলাম। বোরো মৌসুমের ধান আবাদ শুরু হওয়ার পর থেকে হাওরাঞ্চলের সম্পদের তালিকায় ধান আর মাছের পর পরই আসে হাঁস। যদিও আগে হাঁস পালন বাণিজ্যিক ছিল না। এমনিতেই ঘরে ঘরে পালন হতো। হাওরের পানিতে চরে বেড়াত হাঁস। প্রাকৃতিকভাবেই নিশ্চিত হতো খাদ্য। যখন বাণিজ্যিক হাঁস পালনের ধারণা এলো তখন দেশে হাঁস পালনের এক অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে উঠে এলো হাওরাঞ্চল। বলা যায়, গত নব্বই দশকে বাণিজ্যিকভাবে দেশের হাওরবেষ্টিত ছয় জেলায় কমবেশি হাঁস পালন শুরু হয়। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে হাওরকে কেন্দ্র করে রয়েছে কয়েক হাজার হাঁসের খামার। গত বছর হাওরের অকালবন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দেখতে গিয়ে দেখেছি হাঁসের খামারের সংখ্যা আরও বেড়েছে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হাঁসের খামার গড়ে তোলার জন্য প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তাও দিচ্ছে।

আমাদের দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পালন হচ্ছে মূলত তিন প্রজাতির হাঁস। এর মধ্যে বেশির ভাগই চীনের ডিংডিং জাতের। অন্য দুটি জাত হচ্ছে ইংল্যান্ডের খাকি ক্যামবেল ও স্থানীয় পুরনো জাত নাগেশ্বরী।

প্রতিটি সম্ভাবনার পাশাপাশি থাকে ঝুঁকি। হাঁস পালনের বিশাল একটি ঝুঁকি হচ্ছে এর রোগবালাই। রোগে আক্রান্ত হয়ে হাঁস যখন মারা যায় তখন খামারির কিছুই করার থাকে না। সচেতন হলে সব ঝুঁকিই কমবেশি এড়ানো সম্ভব। হাঁসের রোগবালাইয়ের ক্ষেত্রেও তাই। খামারিরা যদি সচেতন থাকেন, রোগবালাই থেকে রক্ষা পেতে ও প্রয়োজনীয় বিষয়ে জানতে স্থানীয় সরকারি প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ রাখতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের দফতরগুলোরও এগিয়ে আসা উচিত। মাংস ও ডিম উপযোগী পৃথক হাঁসের জাত উন্নয়নের জন্য প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারে। স্থানীয় পর্যায়ে যারা এক দিনের বাচ্চা ফোটান তাদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে এ উদ্যোগকে বেগবান করা যেতে পারে। হাঁস ভ্যালু চেইন সংশ্লিষ্ট বাজারব্যবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে একটি টেকসই খাত হিসেবে একে গড়ে তুলতে পারলে কৃষক লাভবান হবে।

বিল ও হাওরাঞ্চলে হাঁস পালন অনেক পুরনো একটি অনুশীলন। এটি স্থানীয়দের একটি বিকল্প জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা। অনেক ভূমিহীন দরিদ্র কৃষকও কিছু হাঁস পালন করে সংসার চালাচ্ছেন। এসব অঞ্চলে একজনের সাফল্য আরেকজনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। দেশের সব বিল ও হাওরাঞ্চলে হাঁস পালনের ক্ষেত্রে যদি প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যেত, তাহলে উদ্যোক্তারা অনেক বেশি উপকৃত হতেন। এর মধ্য দিয়ে হাঁস পালনে যেমন নতুন এক বিপ্লব সূচিত হতো, একইভাবে পুষ্টি উন্নয়নেও ঘটত নতুন এক সাফল্যের সূচনা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

            [email protected]

সর্বশেষ খবর