সোমবার, ২৮ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

বেপরোয়া দুই রাষ্ট্র ইসরায়েল ও মিয়ানমার

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

বেপরোয়া দুই রাষ্ট্র ইসরায়েল ও মিয়ানমার

জমিদারি প্রথা ও তাদের কর্মকাণ্ড আমরা স্বচক্ষে দেখিনি। তবে তাদের সীমাহীন ঔদ্ধত্য ও বিভীষিকাময় কর্মকাণ্ডের গল্প বাবা-চাচাদের কাছে শুনেছি। জমিদারের কোপানলে পড়লে ভিটেমাটি ছেড়ে দেশান্তরী হওয়া ছাড়া আর কোনো গতি ছিল না। জমিদারদের দাপট তো ছিলই, তার সঙ্গে জমিদারদের নিয়োগকৃত তালুকদার, বরকন্দাজ ও সিপাহিসালারাও কম যেতেন না। তারাও জমিদারের নামে নিজেদের ভাগ্য গড়ে নিতেন। জমিদারের দালালির জোরে খাজনা না দেওয়ার অজুহাতে গরিব প্রজাদের জমি-জমা নিজেরা দখল করে নিতেন। বাংলার জমিদারদের ক্ষমতার দাপট এবং তার করুণ এক কাহিনীর চিত্র আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ শিরোনামের কবিতার ভিতরে। বিশ্ব ব্যবস্থায় আজ জমিদারির ভূমিকায় অবতীর্ণ এক পরাশক্তির প্রত্যক্ষ আশীর্বাদ ও সমর্থনে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রটি গত ৭০ বছর ধরে নিজেদের নিরাপত্তার অজুহাতে প্যালেস্টাইনিদের ভূমির ওপর ক্রমশ যেভাবে দখলদারিত্ব বৃদ্ধি করে চলেছে তাতে রবীন্দ্রনাথের দুই বিঘা জমি কবিতার সেই দুটি লাইনের প্রতিচ্ছবিই আমাদের সামনে বারবার ভেসে ওঠে। জমিদার বলছেন, ‘বাপু জানো তো হে, করেছি বাগানখানা/পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা/ওটা দিতে হবে।’

১৯৪৮ সাল থেকে ইসরায়েলের দখলদারি বৃদ্ধির একটা হিসাব দিই। বর্তমানের ইসরায়েল ও গাজাসহ প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডের মোট আয়তন প্রায় ২৭৭৯০ বর্গকিলোমিটার। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে রাতের বেলায় ইসরায়েল রাষ্ট্রের উদ্বোধনী ঘোষণার আগ পর্যন্ত ২৭৭৯০ কিলোমিটার সম্পূর্ণটাই ছিল প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র। এই অঞ্চলের ভিতর আলাদা একটা ইহুদি রাষ্ট্র হবে এই মর্মে ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার যখন ঘোষণা দেন (বেলফর ডিক্লারেশন) তখন এখানে সামগ্রিক জনসংখ্যার শতকরা ৮৫ ভাগ ছিল মুসলমান আর মাত্র শতকরা ১৫ ভাগ ছিল ইহুদি। তখন যেহেতু প্যালেস্টাইন ব্রিটিশের অধীনে ছিল, তাই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ইউরোপসহ বিশ্বের নানা জায়গা থেকে ১৯১৭ সাল থেকে ইহুদিরা এসে প্যালেস্টাইনে বসতি স্থাপন করতে থাকে। তারপরও ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র উদ্বোধনীর সময় মুসলমান জনসংখ্যা ছিল শতকরা ৬৭ ভাগ, আর ইহুদি ছিল শতকরা ৩১ ভাগ, বাকি দুই ভাগ ছিল অন্যান্য।

অত্যন্ত অন্যায় ও অন্যায্যভাবে আমেরিকা এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রভাবে ১৯৪৮ সালে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল গঠনের জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১৮১ নম্বর প্রস্তাব পাস হয়। যেখানে বলা হয়, পুরো প্যালেস্টাইন অঞ্চল সমান দুই ভাগ করে তার অর্ধেক এলাকা নিয়ে হবে নতুন ইহুদি রাষ্ট্র, আর বাকি অর্ধেক নিয়ে থাকবে প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র। অর্থাৎ জনসংখ্যার শতকরা ৩১ ভাগ ইহুদিরা শতকরা ৬৭ ভাগ মুসলমানদের সমান এলাকা পেল। এই অন্যায্য সিদ্ধান্ত অনুসারেও প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র থাকার কথা। কিন্তু এখন এই সময়ে গাজাসহ জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দখলদারিত্বের অধীনে প্যালেস্টাইন সীমিত স্বায়ত্তশাসন ভোগ করছে মাত্র ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গার ওপর। এই ছয় হাজার বর্গকিলোমিটারের ভিতরে আবার ইসরায়েল পরিকল্পিতভাবে প্রায় ২৩ লাখ ইহুদিকে পুনর্বাসিত করে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এর অর্থ হলো এই ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গাও পরিপূর্ণভাবে প্যালেস্টাইনি জনগণের দখলে নেই। সব অন্যায় মেনে নিয়ে এখন এই ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়েই প্যালেস্টাইন জনগণ স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চায় এবং তার জন্যই এখান থেকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও ইহুদি বসতির সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু এতেও আমেরিকা ও ইসরায়েল রাজি নয়। এখন তারা পূর্ব জেরুজালেমও সম্পূর্ণভাবে ইসরায়েলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন তাদের দূতাবাস তেলাবিব থেকে গত ১৫ মে পূর্ব জেরুজালেমে স্থানান্তর করেছে। এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করাতেই নিরস্ত্র গাজাবাসীর ওপর ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গজব নেমে আসে। ৬০ জন নিরীহ প্রতিবাদকারী প্যালেস্টাইনিকে ইসরায়েল সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। কিন্তু তাতে ইসরায়েলের কিছু যায় আসে না। কারণ আমেরিকা তাদের আশীর্বাদের হাত গত ৭০ বছর ধরে যেভাবে ইসরায়েলের মাথার ওপর রেখেছে, সেটি এখনো একইভাবে অব্যাহত আছে। আমেরিকার ছত্রছায়ায় ইসরায়েল ৭০ বছর ধরে কীভাবে জাতিসংঘসহ পুরো আন্তর্জাতিক সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আসছে তার কয়েকটি উদাহরণ দিই। স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে আমেরিকা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদান করে। পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিমতীর, গাজা স্ট্রিপ এবং গোলান হাইটস ব্যতীত বাকি সব প্যালেস্টাইন এলাকা নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে ইসরায়েল। পশ্চিমতীর জর্ডান গাজা মিসর এবং গোলান হাইটস সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণে যায়। ইহুদি সন্ত্রাসীদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে প্রায় সাড়ে সাত লাখ প্যালেস্টাইনি সাধারণ মানুষ পার্শ্ববর্তী আরব দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘের ১৮১ নম্বর প্রস্তাবের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ইসরায়েল কর্তৃক প্যালেস্টাইনের তিন-চতুর্থাংশ দখল করে নেওয়া ছিল বিশ্ব শান্তির জন্য এক ভয়াবহ অশনি সংকেত। তাই ইসরায়েলের লাগাম টেনে ধরার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ১৯৪ নম্বর প্রস্তাব পাস করা হয়। তাতে বলা হয়, বিতাড়িত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যারা দেশে ফিরতে চায় তাদের ফিরতে দিতে হবে এবং যারা দেশে ফিরতে অনিচ্ছুক তাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কিন্তু আমেরিকা উল্লিখিত নিরাপত্তা পরিষদের ১৯৪ নম্বর প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেও তার বাস্তবায়নে শুধু অনাগ্রহই নয়, বরং সব অবৈধ কাজকর্মসহ ইসরায়েলকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সব ধরনের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সাহায্য দিতে শুরু করে।

আরব নেতৃত্বের মধ্যে অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে ১৯৬৭ সালে অকস্মাৎ সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়ে ৫ থেকে ১০ জুন পর্যন্ত মাত্র ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল দখল করে নেয় সম্পূর্ণ পশ্চিমতীর, গোলান হাইটস, গাজা স্ট্রিপ এবং মিসরের সম্পূর্ণ সিনাই অঞ্চল। ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে নিরাপত্তা পরিষদে পাস হয় ২৪২ নম্বর প্রস্তাব এবং তাতে বলা হয়, ইসরায়েল আতিসত্বর ছয় দিনের যুদ্ধে যে সব এলাকা দখল করেছে তা ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু বিগত ৫০ বছরে এই প্রস্তাবের প্রতি সামান্যতম কর্ণপাত করেনি ইসরায়েল। ১৯৭৮ সালে মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরের পর জাতিসংঘ পুনরায় রেজুলেশন নম্বর ৪৪৬ পাস করে। এই প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, ১৯৬৭ সালের অধিকৃত এলাকা ইসরায়েল ছেড়ে দিবে এবং ওই সব এলাকায় অতিসত্বর ইহুদি সেটেলমেন্ট বন্ধ করতে হবে। কিন্তু এবারও কিছুই হলো না। অধিকৃত এলাকায় অনবরতভাবে ইহুদি বসতি স্থাপন চলতে থাকলে তা ভবিষ্যতে শান্তি স্থাপনের পথে একটা বড় বাধা হিসেবে কাজ করবে, এই উপলব্ধিতে ১৯৮০ সালে জাতিসংঘ পাস করে রেজুলেশন নম্বর ৪৬৫, যেখানে সব ইহুদি সেটেলমেন্ট ভেঙে ফেলতে বলা হয় এবং এতদসংক্রান্ত সব কাজকর্ম জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ রাখার জন্য ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো আমেরিকার প্রত্যক্ষ ছত্রছায়ায় ইসরায়েল জাতিসংঘের সব আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে চলেছে এবং এখনো পূর্ণ উদ্যমে সেখানে ইহুদি সেটেলমেন্টের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

আমেরিকার আশীর্বাদে ইসরায়েল যেমন বেপরোয়া, ঠিক একইভাবে উদীয়মান পরাশক্তি ও নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতার অধিকারী চীনের আশীর্বাদে মিয়ানমার এখন হাজার বছর ধরে সেখানে বসবাসকারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিজ ভূমি থেকে চিরতরে উত্খাত করার জন্য বদ্ধপরিকর। মিয়ানমার রোহিঙ্গা উত্খাতের জন্য প্রত্যক্ষ সামরিক অভিযান শুরু করে ১৯৭৮ সালে। কিন্তু ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে রোহিঙ্গা নিধন ও উত্খাত নতুন রূপ ধারণ করে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চরম নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের মুখে অভাবনীয় স্বল্প সময়ের মধ্যে গত বছর নতুন করে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ঠিক একইভাবে ১৯৪৮ সালে সাড়ে সাত লাখ প্যালেস্টাইনি নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে পার্শ্ববর্তী আরব দেশসমূহে আশ্রয় নেয়। যারা আজও নিজ ভূমিতে ফেরত যেতে পারেনি। কেন পারেনি তার বর্ণনা একটু আগেই উল্লেখ করেছি। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অবস্থাও আজ একই রকম। কবে নাগাদ তারা নিজ ভূমিতে ফেরত যেতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

মানবিক কারণে বাংলাদেশ এদের সাময়িক আশ্রয় দিয়েছে। তাতে সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু অনির্দিষ্টকালের জন্য এত বড় সংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। যদিও সারা বিশ্ব আজ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমি থেকে উত্খাত করার জন্য জাতিগত নিধন, হত্যাযজ্ঞ এবং গণধর্ষণসহ এমন কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ নেই যা মিয়ানমার সেনাবাহিনী করেনি। মিয়ানমারের এই অপরাধের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ, ইউরোপ, আমেরিকাসহ সব বিশ্ব সম্প্রদায় অত্যন্ত সোচ্চার, যেমন সোচ্চার প্যালেস্টাইনের বেলায়। কিন্তু শুধু চীনের আশীর্বাদের কারণে মিয়ানমার সারা বিশ্বকে আজ বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে, যেমনটি ইসরায়েল দেখিয়ে আসছে আমেরিকার আশীর্বাদে গত ৭০ বছর ধরে।

            লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর