সোমবার, ৪ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

সবাই উটপাখি হলে সমাজ ধসে যাবে

খায়রুল কবীর খোকন

সবাই উটপাখি হলে সমাজ ধসে যাবে

আমাদের দেশের তরুণরাই একদিন ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শক্তিকে পরাজিত করেছিল রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামের শক্তি দিয়ে, তাড়িয়েছিল ব্রিটিশ-শাসক-শোষকদের, দেশমাতাকে মুক্ত করেছিল। আবার তারাই একদিন পাকিস্তানি নয়া-উপনিবেশবাদী শাসক-শোষকচক্রকে পরাভূত করেছিল চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট দশকের রাজপথের লড়াইয়ে, শেষাবধি একাত্তরে তারা লড়েছিল  একটি সশস্ত্র যুদ্ধ প্রবল শক্তিধর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে। এবং জিতেছিল সশস্ত্র-সেই মুক্তিযুদ্ধ, হানাদার-দানববাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছিল এ দেশের মাটি থেকে, স্বাধীন করেছিল নিজ-মাতৃভূমি। তাদেরই আবারও লড়তে হয়েছিল দুঃশাসন থেকে মুক্তিলাভের জন্য স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে গণতন্ত্রহীনতার অবসান আর সুশাসন কায়েমের লক্ষ্যে। শেষ পর্যন্ত ভয়ঙ্কর-সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তারা লড়াই করেছিল পুরো নয়টি বছর। এবং এবারও হটিয়ে দিয়েছিল এরশাদ-স্বৈরাচারকে, আর মুক্ত করেছিল গণতন্ত্রকে।

সেই তারুণ্য এখন কোথায়! তারা এখন মোটরবাইক নিয়ে রাস্তায় বিশৃঙ্খলায় মেতে ওঠে, নিজেরা রাস্তা-চলার-অনাচারে মানুষ মারে যখন-তখন, হাত-পা-মাথা ভাঙে কত-শত, তার হিসাব কে রাখে! আবার নিজেরাও মরে প্রতিদিন, সড়কে-মহাসড়কে। তারা সংখ্যায় কম নয় মোটেই (প্রায় ১৬ লাখ মোটরবাইক চলছে দেশে, তরুণদের হাতেই তার নব্বই শতাংশ)। আমাদের তরুণদের বিশাল অংশই ধূমপানের নেশায় বুঁদ, তাদের সংখ্যা লাখের ঘরে নয়, কোটি কোটি। বিদেশি ও দেশি বর্বর-তামাক-ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার কোটি টাকা কালো-ব্যবসা করে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের তরুণ-যুবাদের এ মরণনেশা ধরিয়ে দিয়ে। তারও চেয়ে ভয়ঙ্কর, মাদকের কবলে ধ্বংস হচ্ছে বাংলাদেশের প্রায় ৮০ লাখ তরুণ-যুবা। আমাদের দেশের মাদকাসক্ত লোকদের মধ্যে পঁচানব্বই শতাংশই তরুণ-যুবা। ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকে যেখানে মাদকাসক্ত ছিল এক লাখ থেকে ১১ লাখের মধ্যে (জাতিসংঘ সংস্থা/ ইউএনডিসিপির হিসাব অনুসারে) সেখানে এখন ৮০ লাখ কমপক্ষে। কী-হারে বেড়েছে মাদকাসক্তি এ দেশে ভাবা যায়! আর তার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তরুণ-যুবা-সমাজ কীভাবে নিজেদের ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে, কীভাবে দেশ-সমাজটাকে ধ্বংস করে চলেছে কল্পনাও তো করা মুশকিল।

এ দেশে কৈশোর থেকে নৈতিকতার ধ্বসের শুরু। পুরো পরিস্থিতি অবলোকন করলেই বোঝা যায়, আমাদের পরিবারগুলোর অভিভাবকগণ, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ এবং সর্বোপরি সমাজ-নেতারা কিশোর-তরুণদের জীবনযাপন প্রক্রিয়া নিয়ে মোটেই উদ্বিগ্ন নন। তারা পরিবারের গণ্ডির ভিতরে, ক্লাসরুমে এবং সামাজিক-প্রতিষ্ঠানের আওতায় কিশোর-তরুণ, যুবাদের যেটুকু অনুশাসন শেখাতে ও মানাতে পারতেন তা কি তারা আদৌ করছেন! নিশ্চয়ই নয়। যদি তা করতেন তারা তাহলে কীভাবে কোটি কোটি তরুণ-যুবা এমনকি কিশোরেরা ধূমপানে আসক্ত হয়, কীভাবে ৮০ লাখ কিশোর-তরুণ-যুবা মাদকাসক্ত হয়! আমাদের কিশোর-তরুণ-যুবাদের বিশাল অংশই সুস্থ সংস্কৃতির চর্চায় অভ্যস্ত নন, তারা নানা ধরনের বিকৃতির শিকার, ইভ-টিজিং, নারী-ধর্ষণ, অন্যসব নারী নির্যাতন কারা করে? তাদের ৯০ শতাংশই তো কিশোর-তরুণ-যুবা। ভারতীয় ও অন্যসব দেশের টিভি-চ্যানেলগুলোর অশালীন সব প্রোগ্রাম যৌন-বিকারগ্রস্ত করে চলেছে আমাদের কিশোর-তরুণ আর যুবাদের। আমাদের কিশোর-কিশোরীদের, তরুণ-তরুণীদের, যুবক-যুব-মহিলাদের বড়-অংশই মুম্বাই-মার্কা যৌন বিকারের চলচ্চিত্র আর টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখে নিজেরাই নিজেদের সভ্য-সংস্কৃতির কবর রচনা করে ছেড়েছে। ইভ-টিজিং এ দেশে এতটা বেড়ে যাওয়ার কারণ কী? প্রথমত আমাদের দেশীয় ছায়াছবির নোংরা দৃশ্যগুলোর ভূমিকা তো রয়েছেই। যাত্রাশিল্প নাম দিয়ে একশ্রেণির লোক অশ্লীল নাচ-গানের আসর বসাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে চলেছে মুম্বাই-চলচ্চিত্রের অশ্লীল নাচ-দৃশ্য (যা কোনো শিল্পসম্মত নৃত্যকলার সংজ্ঞায়ই পড়ে না), আর বিভিন্ন যৌন-বিকারের দৃশ্যগুলো। একই কাজ করে চলেছে ভারতীয় ও হংকংয়ের টিভি-চ্যানেলগুলোর যৌন-বিকারের দৃশ্যগুলো। ওইসব দৃশ্য সারাক্ষণ আমাদের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবা-মহিলাদের চোখের সামনে। এরপরে আরও যোগ হচ্ছে ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফিক ছবি আর ফিল্মের অবাধ প্রচার। এসব প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা রাষ্ট্র করছে না। মাদকের অপব্যবহার যেভাবে বেড়ে চলেছে, একইভাবে পর্নোগ্রাফিক ছবি আর ফিল্ম এবং যৌন-বিকারের অন্যসব উপাদান যেভাবে প্রচার পাচ্ছে তার প্রতিরোধের কোনো উদ্যোগ কি সেভাবে আছে? না, নেই। মনে হয়, সরকার আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর চাপে কিছুটা মাদক নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টার ‘প্রদর্শনী’ করে চলেছে যেটুকু না করলে বিশ্ব সভ্যতার সমাজে মুখ রক্ষা হয় না, সবার নিন্দা কুড়াতে হয়। রাষ্ট্র-প্রশাসন পর্নোগ্রাফির অবাধ প্রদর্শনী রোধে তো মাথাই ঘামাতে রাজি নয়। রাষ্ট্রের পুলিশের এ ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথাই নেই যেন। তারা কিছু তৎপরতার ‘প্রদর্শনী’ করে চলেছে যেটুকু করলে এ কার্যক্রম-উপলক্ষ করে দেশ-বিদেশ সফর আর কিছু নগদ অর্থলাভ ঘটে বিভিন্ন প্রকল্পের নামে।

যেহেতু রাষ্ট্র-প্রশাসন দায়দায়িত্ব গ্রহণ করছে না এসব বিষয়ে, তাই অভিভাবক-সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে। এখন অভিভাবক (মানে বাবা-মা, তাদের অনুপস্থিতিতে চাচা-চাচি বা বড়-ভাই-ভাবি, বড়-বোন, তার স্বামী বা খালা-খালু) পরিবারের পক্ষ থেকে নিজ নিজ কর্তব্য পালন করছে কী? না, তারা করছে না। তারা সবাই ব্যস্ত, জীবন-জীবিকার কাজে (কেউ কেউ ঘুষ-চোরাকারবার, আর অসাধু সব-উপার্জনের নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন, সময় পান না নিজের কিশোর-তরুণ-যুবা স্বজনটিকে ভালোভাবে দেখাশোনা করার), তাদের হাতে সময় কই? সময় থাকত যদি তারা যথার্থ সচেতন হতেন ভবিষ্যৎ বংশধরদের মানুষ করার দায়বোধ থেকে। পরিবারের বাইরে বড়-অভিভাবক স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। তাদের হাতেও সময় নেই, তারা ক্লাসরুমে তোতা পাখি পড়ানোর বিদ্যেটাই রপ্ত করেছেন সবাই, আসল শিক্ষাটা দেওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না। তাছাড়া তাদেরও আরও ব্যস্ততা রয়েছে— ব্যস্ততা অধিক উপার্জন, আরও আয়-বাড়ানো প্রতিনিয়ত, তাই তাদের মনোযোগ পাওয়াও দুষ্কর এক্ষেত্রে। এরপরে থাকে রাষ্ট্রব্যবস্থা, যা চালায় রাজনীতিকরা, আর আমলাগোষ্ঠী, তাদের মনোযোগও এক্ষেত্রে খুবই অপ্রতুল।

বরং বলা চলে, আমাদের রাজনীতিকরা, বিশেষভাবে ক্ষমতাসীনরা আমাদের তরুণ-যুবাদের বিভ্রান্ত করেই বেশ ভালো সুবিধা আদায় করে নিতে ব্যস্ত। সবচেয়ে বড় প্রমাণ আমাদের বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের হর্তাকর্তাদের অনুসারী ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ এখন কী করছে? ষাট দশকে মোনেম খাঁর এনএসএফ (ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন) বাহিনী একটি দস্যু বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল, তারা ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস করেছে অবাধে, সরকারি কর্তাদের পরিচালিত-পুলিশের তত্ত্বাবধানে। এখন ছাত্রলীগ কি একই কাজ করছে না?  তারা বিরোধী সংগঠনসমূহের বিভিন্ন আন্দোলনের যৌক্তিক-তৎপরতায় বাধা দিয়ে চলেছে সন্ত্রাসী বাহিনী ও দস্যুবাহিনীর কায়দায়। একই কথা যুবলীগের বেলায়ও প্রযোজ্য— বিভিন্ন স্থানে বিরোধী দলের কর্মীদের ওপর হামলা করছে তারা। বস্তুত, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মকাণ্ডে দেশের মানুষ এখন দিশাহারা। বিরোধী দলের কর্মীরা তো রাস্তায় নামতেই পারছে না তাদের কারণে। এর ফলে আমাদের কিশোর-তরুণ-যুবা সমাজের সংকট চরমে পৌঁছে গেছে। তাদের সুপথে আনার বিষয়টি এখন এক দুঃসাধ্য বিষয় হয়ে পড়েছে।

যেখানে তরুণ সমাজের লালন-পালন দরকার, আমাদের রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ হিসেবে সুনাগরিক রূপে গড়ে তোলাই যেখানে এখনকার রাষ্ট্র-নেতাদের প্রধান কাজ, সেখানে উল্টোটাই হচ্ছে। আমরা সমাজের দায়িত্বশীল নাগরিকরা তো এ অবস্থা দেখতে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। রাষ্ট্র যখন অগণতান্ত্রিক শক্তির দাপটের কবলে পড়ে হাবুডুবু খায়, বিশৃঙ্খল-রাষ্ট্রব্যবস্থা যখন পাকাপোক্ত, দায়িত্বহীন-রাষ্ট্রব্যবস্থা যখন এসবের প্রতিকারে এগিয়ে আসে না, তখন নাগরিক সমাজের ওপর দায় বর্তায়—কিছু একটা করার জন্য। আমাদের কিশোর, তরুণ ও যুবাদের (তিন গোষ্ঠীরই নারী সদস্যদেরসহ) সঠিক পথে মানুষ করতে হবে— ভবিষ্যতে এ রাষ্ট্র যাতে বসবাসযোগ্য থাকে। সেই লক্ষ্যে একটি সামাজিক আন্দোলন চাই। সেটি করতে এগিয়ে আসতে হবে এ সমাজের কিছু দেশপ্রেমিক মানুষকে।  সবাই যদি উটপাখি স্বভাবের হয় তাহলে তো সমাজ ধসে যাবেই।

আমরা অবশ্যই সেই দশা চাইতে পারি না। আমরা পারি না সেটা কামনা করতে।  তাই আমাদের উদ্যোগ নিয়ে এগোতে হবে। উদ্যোগ নিলেই ইতিবাচক কিছু বেরিয়ে আসবে, আসতেই হবে। একটি সামাজিক আন্দোলনই রাষ্ট্র-প্রশাসনকে বাধ্য করতে পারে কিশোর-তরুণ-যুবাদের  সুপথে আনার সব ব্যবস্থা গ্রহণে।

 

            লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর