সোমবার, ৪ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

সুন্নাহর আলোকে তারাবির নামাজ

মুফতি মাওলানা মুহাম্মাদ এহছানুল হক মুজাদ্দেদী

সুন্নাহর আলোকে তারাবির নামাজ

পবিত্র মাহে রমজানে এশার নামাজের চার রাকাত ফরজ ও দুই রাকাত সুন্নতের পর এবং বেতের নামাজের আগে দুই রাকাত  করে ১০ সালামে যে ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা হয়, একে ‘তারাবি নামাজ’ বলা হয়। এ নামাজ সুন্নতে মুয়াক্কাদা। আরবি ‘তারাবি’ শব্দটির মূল ধাতু ‘তারবিহাতুন’ অর্থ আরাম বা ক্ষণিক বিশ্রাম করা। তারাবি নামাজ পড়াকালে প্রতি দুই রাকাত বা চার রাকাত পরপর বিশ্রাম করার জন্য একটু বসার নামই ‘তারাবি’। দীর্ঘ নামাজের কঠোর পরিশ্রম লাঘবের জন্য প্রতি দুই রাকাত, বিশেষ করে প্রতি চার রাকাত পর একটু বসে বিশ্রাম করে দোয়া ও তসবি পাঠ করতে হয় বলে এ নামাজকে ‘সালাতুত তারাবি’ বা তারাবি নামাজ বলা হয়। এ নামাজ উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য রমজানের একটি বড় উপহার। তারাবি নামাজ সম্পর্কে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় তারাবির নামাজ আদায় করবে, আল্লাহপাক তার পূর্ববর্তী গোনাহসমূহ মাফ করে দেবেন। (নাসাঈ খ. ১, পৃ. ২৩৮)। দিনের রোজা, রাতের তারাবি, মাগরিবে ইফতার আর শেষ রাতে সাহরি রোজাদারের জীবনধারাকে পরিবর্তন করে দেয়। রসুল (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহপাক তোমাদের ওপর রমজানের রোজা ফরজ করে দিয়েছেন আর আমি তোমাদের জন্য রমজানের তারাবিকে সুন্নত ঘোষণা করলাম। (ইবনে মাজাহ হাদিস নং-১৩২৮)। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, একদিন গভীর রাতে মহানবী (সা.) মসজিদে গেলেন এবং নামাজ পড়লেন, কিছু লোকও তাঁর পেছনে নামাজ পড়লেন। ভোর হওয়ার পর লোকজন পরস্পরের সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করায় দ্বিতীয় রাতে লোকসংখ্যা আরও বেড়ে গেল এবং তারা মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে নামাজ পড়ল। এ দিন ভোর হওয়ার পর লোকদের মাঝে আরও বেশি আলোচনা হলো এবং তৃতীয় রাতে মসজিদের লোকসমাগম আরও বেশি হলো, মহানবী (সা.) বাইরে বের হয়ে নামাজ পড়লেন আর তারাও তার (সা.) সঙ্গে নামাজ পড়লেন। যখন চতুর্থ রাত এলো তখন এত লোকসমাগম হলো যে, মসজিদে স্থান সংকুলান হলো না। কিন্তু তিনি এ রাতে তারাবি নামাজের জন্য বের হলেন না, ভোর হলে ফজরের নামাজের জন্য বের হলেন এবং ফজরের নামাজ শেষে লোকদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, তোমাদের বিষয়টি আমার কাছে গোপন ছিল না। কিন্তু আমি আশঙ্কা করছিলাম, এ নামাজ না আবার তোমাদের ওপর ফরজ করে দেওয়া হয় আর তোমরা তা পালনে ব্যর্থ হও। মহানবী (সা.) ওফাত করলেন এবং এ নামাজের বিষয়টি আমাদের ওপর তেমনই রইল। (সহিহ বোখারি খ.১ পৃ. ১৯৯)। হজরত আবদুর রহমান বিন আবদিল কারী (রা.) বর্ণনা করেছেন, রমজানের এক রাতে আমি হজরত উমর বিন খাত্তাব (রা.)-এর সঙ্গে মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হলাম এবং দেখলাম, লোকেরা পৃথক পৃথক দলে বিভক্ত হয়ে আছে। কেউ একা একা নামাজ পড়ছিল, আবার কেউ কেউ এভাবে নামাজ পড়ছিল যে, তার পেছনে কিছু লোক নামাজ পড়ছিল। এ অবস্থা দেখে হজরত উমর (রা.) বললেন, আমার মনে হয় সবাইকে একজন কারির পেছনে একত্রিত করে দিলে ভালো হয়। অতঃপর তিনি (রা.) দৃঢ় প্রত্যয় করলেন এবং হজরত উবাই বিন কাবের পেছনে তাদের সবাইকে মুক্তাদি হিসেবে একত্রিত করে দিলেন। (সহিহ বোখারি খ. ১ পৃ. ২৬৯)।

মহানবী (সা.) নিজেই ২০ রাকাত তারাবি নামাজ পড়েছেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে পড়ার জন্য আদেশ দিয়েছেন। তারাবি নামাজের ফজিলত সম্পর্কে হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে ও সওয়াবের আশায় রমজানে তারাবি নামাজ আদায় করে তার পূর্ববর্তী সব গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়’  (বোখারি ও মুসলিম)।

তারাবি নামাজ কত রাকাত? উত্তর তারাবি নামাজ ২০ রাকাত। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করার সুযোগ নেই। সহিহ হাদিসে রসুলে করিম (সা.) নিজ সুন্নতের পাশাপাশি খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে অনুসরণ করার এবং তা মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) রমজানে বেতের ছাড়া ২০ রাকাত তারাবি নামাজ আদায় করতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা খ. ৫ পৃ. ১৯৪)। হজরত উমর (রা.) লোকজনকে হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)-এর পেছনে একত্রিত করলে হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.) তাদের নিয়ে ২০ রাকাত তারাবি পড়েছিলেন। (আবু দাউদ খ. ২ পৃ. ৬৫)।

হজরত উমরের (রা.) যুগ এজিদ (রা.) বলেন, হজরত সায়েব ইবনে এজিদ (রা.) বলেছেন, অর্থাৎ ‘তাঁরা (সাহাবা ও তাবেয়িন) হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)’-এর যুগে রমজান মাসে ২০ রাকাত তারাবি পড়তেন।’ (আস্-সুনানুল কুবরা, বায়হাকি শরিফ ২/৪৯৬)। তাবেঈ এজিদ ইবনে রূমান (রা.)’-এর ভাষ্য : ‘হজরত উমর (রা.)’র যুগে মানুষ (সাহাবা ও তাবেঈন) রমজান মাসে ২৩ রাকাত নামাজ পড়তেন।’ (মুয়াত্তা মালিক : ৪০, বায়হাকি ২/৪৯৬)।

অনেকেই তারাবির নামাজকে কমাতে চান এটা সঠিক নয়। কারণ, পবিত্র কাবা শরিফ সোনার মদিনা শরিফসহ বিশ্বের প্রায় সব মসজিদ, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ বাংলাদেশে সহিহ হাদিসের আমল ২০ রাকাত তারাবি নামাজ পবিত্র রমজানে আদায় করা হচ্ছে।  একটাই আশা, মহান আল্লাহ যেন নূর নবীজীর উসিলায় আমাদের রোজা, ২০ রাকাত তারাবি, কোরআন তেলাওয়াত, নফল সব ইবাদত, দান সদকা, সবাইকে বার বার মাহে রমজান কবুল করে নবীজীর সঙ্গে জান্নাতের মেহমান করুন,  আমিন!

লেখক : বেতার টিভির ইসলামী উপস্থাপক। খতিব, মনিপুর বাইতুর রওশন (মাইকওয়ালা) জামে মসজিদ মিরপুর, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর