শনিবার, ৯ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে হবে

লে. জে. মাহবুবুর রহমান (অব.)

দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে হবে

বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে বেশ কয়েকটি দৈনিক খবরের কাগজ (সৌজন্য সংখ্যা) আমি প্রতিদিন সকালে আমার ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থিত বাসার দরজার সামনে রেখে যাওয়া পাই। সুহৃদ সম্পাদকদের আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদ জানাতে কার্পণ্য করেছি বিধায় আজ এ সুযোগে সবাইকে বিনীত সাধুবাদ জানাচ্ছি। গত ০৩ জুন ২০১৮ যুগান্তরের প্রথম পৃষ্ঠায় চোখকাড়া হেডলাইন ছিল  ‘নষ্ট রাজনীতির শিকার ব্যাংকিং খাত—সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে CPD-র মূল্যায়ন’।  রাজধানী ঢাকা নগর ঘিরে সুন্দর দৃষ্টিনন্দন সাইনপোস্টিং শোভিত ব্যাংকগুলোয় ব্যাপক মানি লন্ডারিং হয়েছে। হয়েছে হাজার, নিযুত, লাখ, কোটি টাকার অঙ্কে। লাখ কোটি সংখ্যাটার প্রচণ্ডতা, এর বিস্মৃতি আর বিশালত্ব আমার কল্পনাতীত। কোটি লিখতে কয়টা শূন্য যোগ করতে হয় আমি ঠিক করে বলতে পারি না। মাথা ঘুরে যায়। গুনে গুনে আটটা শূন্য বসালে এক কোটি হয় এটা বাস্তবে বুঝে উঠতে আমি এখনো অক্ষম। আর কয়েক হাজার কোটি টাকা আমি কেমন করে আমার এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ধারণ করব? এ যে আরব্য রজনীর আলীবাবার সম্পদ! কিন্তু হায়, এ সম্পদ ঘরে নাই সব লুণ্ঠন হয়ে গেছে। দেশেও নাই গোটা দুনিয়াজুড়ে লন্ডন, আমেরিকা, কানাডা, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত সব ব্যাংকে গচ্ছিত হয়েছে। ব্যাংকের ক্রেডিট ভলিউম স্ফীত থেকে স্ফীততর করছে।

মাহাথির মোহাম্মদ ৯২ বছর বয়সে দীর্ঘদিন অনুপস্থিতির পরে আবার রাজনীতিতে এসে সংসদ নির্বাচনে বিশাল জয়লাভ করে আবার মালয়েশিয়ার  প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বর্ষীয়ান প্রধানমন্ত্রী। লজ্জাজনকভাবে বিদায় নেওয়া প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাক মালয়েশিয়ার অর্থনীতিকে ইতিমধ্যে ধ্বংস করে দিয়ে গেছেন।

ব্যাংকগুলো থেকে মিলিয়ন, বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। অভিযুক্ত হয়েছেন তার স্ত্রী, পরিবার ও দলীয় সুবিধাভোগী দুর্নীতিচক্র। সমস্ত পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার কড়া আদেশ দিয়েছেন মাহাথির। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি কঠিন অভিযান শুরু করেছেন। মালয়েশিয়ার জনগণ বিশ্বাস করে মাহাথির মালয়েশিয়ার লুপ্ত ইমেজকে, পতিত অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করবেন। হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারে সক্ষম হবেন। সক্ষম হবেন দুর্নীতি রোধে পাচারকৃত সমস্ত অর্থ দেশে ফেরত আনতে। আজ মালয়েশিয়াকে রোল মডেল করে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করার অনেক কিছু আছে। অনেক কিছু আছে মাহাথিরের আদর্শে দীক্ষিত হতে। বেশ কিছুকাল ধরে আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশ একটি মারাত্মক ক্ষয়রোগে আক্রান্ত। আর তার সংক্রমণের ভয়ঙ্কর রূপ জাতীয় জীবনের প্রতিটি অঙ্গে-প্রত্যঙ্গে ভয়ালভাবে প্রতিফলিত। আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে উৎকণ্ঠার জায়গাটি দুর্নীতি। এটি এখন জাতীয় সবচেয়ে বড় সমস্যা। এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত কারও থাকবে বলে আমি মনে করি না। গোটা বিশ্বে আমরা অতীতে সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ দেশ হিসেবে পরিচিত ছিলাম। এখনো এ অবস্থার বড় একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে আমি মনে করি না। শীর্ষে ছিলাম এখনো কয়েকটি দেশের সঙ্গে ব্র্যাকেটবন্দী হয়ে শীর্ষেই অবস্থান করছি।

দেশটা ঢালাওভাবে বিকাও হয়ে গেছে। অতীতেও অনেকবার এমনি হয়েছিল। কখনো উপনিবেশবাদী ব্রিটিশ প্রভুদের হাতে কখনো বা ফ্যাসিস্ট পাকিস্তানের পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর কাছে। আজ বেনিয়া ব্রিটিশ নাই। পাকিস্তানের পোড়া মাটির (Scortch the earth…kill all, loot all, burn all) শাসনও নেই। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো বড় করে আসন দখল করে আছে দেশীয় আধিপত্যবাদীরা, শোষণকারী স্বার্থবাদীরা। এ ভূমি থেকেই তাদের উৎপত্তি, এ জমিতেই তাদের জন্ম। আমার কখনো কখনো মনে হয়েছে এরা আরও ভয়ঙ্কর। এরা অতিদ্রুত গোটা দেশকে, পুরো সমাজকে ধ্বংস করে চলেছে।

Center for policy dialogue বাংলাদেশ অর্থনীতি নিয়ে সুদীর্ঘকাল ধরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনা করে যাচ্ছে। আলোচনাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, চিন্তাপ্রসূত, বাস্তব ভিত্তির ওপর নির্মিত। মূল আলোচক প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি ক্লান্তিহীনভাবে অর্থনীতির অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির বলগাহীন বিস্তারের কথাগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে বলে চলেছেন। সীমাহীন সম্ভাবনার বাংলাদেশ বেনিয়াচক্রের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে তাদের ভালগার ভোগবিলাস আর মুনাফা লাভের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বেশ কয়েক দশক ধরে, বলতে গেলে বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকে বহুবিধ গুরুতর জাতীয় সমস্যার মধ্যে একটি Common denominator দুর্নীতি। স্বাধীনতার মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সমস্যাটির ব্যাপকতা উদ্বিগ্ন করে রেখেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সম্বন্ধে একটি ঔদ্ধত্যপূর্ণ অশালীন উক্তি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, Bangladesh is a bottomless basket. তখন জাতিসংঘসহ পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনৈতিকভাবে বিপন্ন দেশটির সহযোগিতায় উদার হস্তে এগিয়ে আসে। কিন্তু এর একাংশ লুটপাট হয়ে যায়। সেগুলো সাধারণ গণমানুষের কাছে পৌঁছেনি। তাদের ভগ্নদশার কোনো পরিবর্তন আসেনি।

ইতিমধ্যে দীর্ঘ চার দশক সময় অতিবাহিত হয়েছে। সমস্যাটি এতটুকুও লাঘব হয়নি। বরং শাখা-প্রশাখায় ডালপালায় বিস্তারিত হয়েছে। আরও জটিল, ব্যাপক আকার ধারণ করে দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও আঘাত হেনেছে। বাংলাদেশ বিশেষ বিশেষ বিশেষণে বিশেষায়িত হয়েছে। চরম দুর্বৃত্তায়িত, আকণ্ঠ দুর্নীতিগ্রস্ত, আতঙ্ক ছড়ানো জঙ্গি উত্থিত, মাদকাক্রান্ত ও নেশাগ্রস্ত যুবসমাজ অধঃপতিত। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠেই দৃষ্টি কাড়ে সব পত্রিকার আদ্যোপান্ত জুড়ে বীভৎস নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নির্মম লোমহর্ষক সব ছবি আর খবর। হিংসা বিদ্বেষ ঘৃণা জিঘাংসা ও হত্যার খবর প্রতিদিন প্রতিটি পত্রিকায় প্রতিটি টিভি চ্যানেলে মিডিয়ার প্রতিটি অঙ্গনে। একই রকম চিত্র। এর কোনো ব্যত্যয় নেই, কোনো বিচ্যুতি নেই, বিরাম নেই। 

এ বাংলাদেশ আমি চিনি না। চিনতে চাই না। জননী, জন্মভূমি স্বর্গাদপী গরিয়সী। আমার জন্মভূমি সে তো আমার জননী। আজ গরিয়সী মহীয়সীর এ কি করুণ বিষাদভরা মলিন মুখ! রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা। আমি তোমায় ভালোবাসি।... ওমা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি’। রবীন্দ্রনাথ আজকের বাংলাদেশের চিত্র দেখলে অশ্রুসিক্ত না হয়ে হৃদয়ে রুধিরাক্ত হতেন। রূপসী বাংলার কবি, জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ দেখিতে চাহি না আর’।

কে জানে হয়তো বিধাতা এমন একটি আশঙ্কা থেকেই বহু বছর আগে কলকাতার রাস্তায় ট্রামের নিচে ফেলে এমন পরিণতির দিকে ধাবিত করেছিলেন। এই কি আমার সেই বাংলাদেশ, গোটা বিশ্ব যাকে ধন্য ধন্য করেছিল? বার বার সেখানে রেনেসাঁ এসেছিল। আকাশ-বাতাস মথিত করে স্লোগান উঠেছিল ‘শাবাশ বাংলাদেশ। বিশ্ব অবাক তাকিয়ে রয়। জ্বলেপুড়ে মরে ছারখার। তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রই এই কি সেই জাতীয় কবি নজরুলের বাংলাদেশ। যাকে উদ্দেশ করে তিনি গান রচনা করেছিলেন। নমঃ নমঃ নমঃ বাংলাদেশ মম। রচনা করেছিলেন ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি’। এই কি সেই বাংলাদেশ যার জন্য পুরো জাতি, আবালবৃদ্ধবনিতা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিল। লাখ নিযুত মানুষ জীবন দিয়েছিল। মায়ের অপমান, কন্যার লাঞ্ছনা, পুত্র হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছিল। দেশকে স্বাধীন করে গণতন্ত্রের ভিত রচনা করেছিল। ধুলায় লুণ্ঠিত মানবাধিকারকে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল। সর্বজনীন মানবতাকে সমুন্নত করেছিল। প্রতিষ্ঠিত করেছিল সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত, সমতা ও সাম্যের ভিত্তিতে শোষণ ও বঞ্চনাহীন এক সুখী-সমৃদ্ধ সমাজের ভিত্তি।

জাতীয় সংসদ একটি মহান প্রতিষ্ঠান। অত্যন্ত পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ এক জাতীয় পাদপীঠ। জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। সব জাতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। জাতির কল্যাণে নীতিমালা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই জাতীয় সংসদের দায়িত্ব। যারা সংসদে নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাদের সবার কাঁধেই এই দায়িত্ব সমভাবে বর্তায়। অতীবও দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি বর্তমান সংসদ তা পালনে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বর্তমান জাতীয় সংসদ প্রশ্নবিদ্ধ। যুক্তরাজ্য সরকার বৈদেশিক বাণিজ্য ঝুঁকি : বাংলাদেশ (Overseas Business Risks : Bangladesh) শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে বলেছিল, এক সময় বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনায় সবচেয়ে বড় সমস্যা সাংঘর্ষিক রাজনীতি আর ঘুষ ও দুর্নীতি। সাম্প্রতিক বছরে টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে জাতীয় যুব সততা প্রতিবেদনে বলেছে, সততার অভাবকে যুবসমাজ দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নের সবচেয়ে বড় সমস্যা মনে করে। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশ থেকে কিছু দিন আগে এক বছরেই পাচারকৃত অর্থের পরিমাণের তথ্য ছিল বহু সহস্র কোটি সুইস ফ্রাঙ্ক। এ বিশাল অর্থের পাহাড়, বলার অপেক্ষা রাখে না যে এগুলো অবৈধভাবে অর্জিত কালো টাকা। অবৈধপথে ব্যাংকে পাচার করা। ইতিমধ্যে এ কয়েক বছরে এ অঙ্ক বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কোষাগারে ও ব্যাংকে শতগুণে হাজার গুণে ফুলে-ফেঁপে বর্ধিত হয়েছে। এগুলো খেটে খাওয়া মানুষের, সাধারণ জনগণের টাকা। সম্প্রতি কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে পুঁজির এক বিশাল অঙ্কের স্থানান্তর (flight of capital) ঘটেছে। সহস্র কোটির পুঁজিপতিরা, কোটিপতিরা, মিলিনিয়রেরা, বিলিনিয়রেরা বিদেশে পাইকারি হারে সেকেন্ড হোম কিনছে। অবস্থান নিচ্ছে। তারা বিদেশে দীর্ঘস্থায়ী ঠিকানা গড়ছে। দ্বৈত নাগরিকত্বের জাতীয় নীতির অনৈতিক সুবিধায় দেশের সম্পদ বিদেশে স্থানান্তর করছে। তারা ঠাঁই নিচ্ছে মালয়েশিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দুবাই, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মরিশাস, সাইপ্রাস। ছোট এই বিশ্বের কোথায় নয়? শুনেছি কানাডার এক বড় শহরের বড় আবাসিক এলাকার বেগমপাড়া নামকরণ হয়েছে। শেয়ারবাজার, ডেসটিনি, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, জনতা ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ইত্যাদিতে দুর্নীতির এক একটি উপাখ্যান রচিত হয়েছে। শেকসপিয়রের হেমলেট নাটকে পড়েছি, রাজপ্রাসাদের প্রহরারত সশস্ত্র প্রহরী তার পাশের জনকে বলছে, Something is rotten somewhere in the state of Denmark. সুনীতির বিপরীতে যে শব্দটি তা-ই তো দুর্নীতি। দুর্নীতিপরায়ণ প্রতিটি মানুষ অন্তঃসারশূন্য, অসাধু, অনৈতিক এবং মানসিক অসুস্থ। সে উদগ্র লোভে উন্মত্ত। সে অর্থগৃধ্নু। আজ বাংলাদেশের সব অবক্ষয়, অপরাধ, সব অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা, সহিংসতা, উদগ্র লালসার মূলে যে বিষয়টি রাহুর মতো সব সুবৃত্তিকে গ্রাস করছে তা হলো দুর্নীতি। ইতিহাসে আমরা দেখেছি সভ্যতার উত্থান ঘটেছে, শিখরে আরোহণ করেছে একমাত্র তখনই, যখন জাতীয় নেতৃত্বে ন্যায়পরায়ণ ও দুর্নীতিমুক্ত নেতার আবির্ভাব ঘটেছে। নেতৃত্ব ভোগবাদী, ভোগবিলাসী ও দুর্নীতিপরায়ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবধারিতভাবে সভ্যতার পতন শুরু হয়েছে

(beginning of the end)। বাংলাদেশের দুর্নীতির চিত্র আজ জাতিকে এক বিপজ্জনক ঝুঁকিতে ঠেলে দিয়েছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি) অতীতে বাংলাদেশকে পুনঃপৌনিকভাবে পাঁচবার বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল।

কী দুর্ভাগা এ জাতি। প্রশ্ন হচ্ছে, ১৬ কোটি মানুষের এ দেশের কৃষক শ্রমিক জেলে তাঁতি, সব পেশাজীবী সব শ্রমজীবী আপামর জনগণ দুর্নীতির সঙ্গে কতটুকু জড়িত? তারা তো উদয়াস্ত পরিশ্রম করে চলেছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে। তারা কেন এ অভিযোগের ভাগিদার হবে। তারা তো দুর্নীতি করে না। তারা তো অস্ত্র ও মাদকের ব্যবসায় জড়িত হয় না। নারী ও শিশু পাচার করে না। হুন্ডি ও মানি লন্ডারিং করে না। এমএলএমের ব্যবসার ফাঁদে ফেলে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে অর্থের পাহাড় গড়ে না। দুর্নীতির সংজ্ঞায় বলা যায়, abuse of public position for private benefit সরকারি অবস্থানের অপব্যবহারই দুর্নীতি। দুর্নীতির মধ্যে স্বভাবতই জড়িত জ্যেষ্ঠ আমলারা, বড় বড় মুনাফাখোর, অসাধু ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি, কর প্রতারক, ব্যাংক ঋণখেলাপিরা। মাছের পচন যেমন শুরু হয় মাথা থেকে দুর্নীতির সংক্রমণও শুরু হয় তেমনি উঁচু মহল থেকে। পানি যেমন ওপর থেকে নিচে গড়ায়, দুর্নীতিও তেমনি সব সময় অধঃগামী।

দুর্নীতি দমনের জন্য দায়িত্বপূর্ণ জাতীয় প্রতিষ্ঠান দুদক। আমরা দুদককে ভয়ানক কিছু দেখতে চাই। রবীন্দ্রনাথের বাণী, ‘ক্ষমা যেথা হীন দুর্বলতা, হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা’-এর প্রতিফলন দেখতে চাই। গণমানুষের অসীম আস্থায় দুদককে দেখতে চাই।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার অনেক জাতীয় অর্জন এনেছে। স্বল্পোন্নত অর্থনীতির দেশ থেকে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের অবস্থানে উত্তরণ ঘটিয়েছে। বিশ্ব শান্তি স্থাপনে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী বিশ্বজুড়ে দৃপ্ত পদচারণা রাখছে। জাতিসংঘের করিডোরে বাংলাদেশ একটি আলোচিত নাম। সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন হচ্ছে। দেশে অবকাঠামো গড়ে উঠছে। উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু দেশের দুর্নীতির সামগ্রিক চিত্র বিপজ্জনকভাবে ভয়াবহ। দুর্নীতির সুদূর বিরূপ প্রভাব শুধু রাজনীতি নয় গোটা সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতীয় জীবনে প্রকটভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। মানুষ হিংস্র হচ্ছে। মনুষ্যত্ব হারাচ্ছে। পৈশাচিক উন্মাদনা, লালসা তাকে পশুত্বের নিচে ঠেলে দিচ্ছে। হিংসা-বিদ্বেষে ও ভ্রষ্টাচারে গোটা সমাজ আইয়ামে জাহেলিয়াতের বর্বর যুগে ফিরে যাচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে অরাজকতা, অস্থিরতা, সহিংসতা, জিঘাংসা, হানাহানি আর রক্তপাত। গোটা বাংলাদেশ যেন আজ দুর্বৃত্তায়নের এক অভয়ারণ্য। এ যেন দেড় হাজার বছর আগের বাংলার ইতিহাসের পালবংশপূর্ব মাত্স্যন্যায়ের পুনঃআবির্ভাব। সমাজে আজ সীমাহীন অশান্তি, অস্বস্তি, শঠতা, প্রতারণা, নীতিহীনতা, মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় আর ধস। মানুষ আজ দিশাহারা। আমি এর সবকিছুর জন্য মূলত দায়ী করি দুর্নীতির অভিশাপকে। সমাজ ও রাষ্ট্রকে এ সংক্রামক দুরারোগ্য মহাব্যাধি অবধারিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গ্রিক পুরাণের ট্রোজান যুদ্ধের অপ্রতিরোধ্য অজয় চির অক্ষত বীর একিলি। কিন্তু তিনিও পরাজিত হন, যুদ্ধে হত্যার শিকার হন। বীর একিলির পায়ের গোড়ালি ছিল দেহের সবচেয়ে দুর্বল সবচেয়ে ভঙ্গুর অংশ। অমরত্ব লাভের বাসনায় সদ্যপ্রসূত শিশু একিলির পায়ের গোড়ালি ধরে পিতা স্বর্গলোকের অমৃত সাগরে ডুবিয়ে নেয়। কিন্তু একিলির পায়ের গোড়ালিতে তার হাত থাকায় অমৃত বারি সেখানে স্পর্শিত হয়নি। আজ বাংলাদেশ জাতীয় একিলির পায়ের গোড়ালি, দুর্নীতি। ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছে। একিলিও বাঁচেনি। পায়ের গোড়ালিতে তীরবিদ্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।

সংসদের বাজেট অধিবেশন ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বাজেট উপস্থাপন করেছেন। শোনা গিয়েছিল কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা অতীতের মতো এ বছরের বাজেটেও বিদ্যমান থাকবে। বাজেটের বিস্তারিত বিশ্লেষণে এখনই যেতে চাই না। বাজেট ন্যায়ভিত্তিক হবে, অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা ও সমতা আনার দিকনির্দেশনা দেবে। কালো টাকাকে উৎসাহিত করবে না আশা করি। কালো টাকা দুর্নীতির বাম্পার ফসল, অনৈতিকভাবে উপার্জিত, অবৈধভাবে গুপ্ত ও অঘোষিত এবং যক্ষের মতো রক্ষিত।

লাখ লাখ শহীদের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে মহান স্বাধীনতা। এক সুখী সমৃদ্ধ ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন কখনো চূর্ণ হতে দেওয়া যাবে না। নজরুলের চেতনায় এ জাতি জাগ্রত হোক। শাণিত হোক। বিশ্বসভায় হিমালয়ের উচ্চতায় বাংলাদেশ দৃশ্যমান হোক। এই হোক আজ জাতির ইস্পাতকঠিন আপসহীন সংকল্প। হীন স্বার্থবাদিতা, হিংসায় উন্মত্ততা আর ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংকীর্ণ মানসিকতা হোক অনাগত বাংলাদেশ থেকে অপসৃত।  দূরীভূত হোক সব অন্যায়, অনৈতিকতা, অসাধুতা, অকল্যাণ, অমঙ্গল, অশুভ, অশুচি যা কিছু। অবসান হোক সব সংঘাত রক্তপাত আর হানাহানি।

পবিত্র রমজান মাস বিদায় নিতে চলেছে। সামনে ঈদ। কৃচ্ছ্র সাধনের অনেক দিন নিষ্ঠায় কাটিয়ে আনন্দে মেতে ওঠার ঈদ। পাঠকদের ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে প্রথমে দুঃখ প্রকাশ করছি আমার নিবন্ধটি অনেকের হয়তো বিরক্তির উদ্রেক করেছে। লেখাটি হয়তো ঈদের এই মৌসুমে সময়োপযোগী হয়নি।  ছন্দপতন ঘটিয়েছে। লেখার পরতে পরতে প্রাপ্তিহীনতার দীর্ঘশ্বাস অন্যায়-অবিচারের অব্যক্ত বেদনা আর সমষ্টিগত অভিযোগ আর অভিমান উঠে এসেছে। ক্ষমাশীল পাঠক আমাকে ভুল বুঝবেন না আশা করি।  আমার এই মুহূর্তের বিচিত্র অনুভূতিগুলো শেয়ার করার সুযোগ দানের জন্য জানাই অশেষ ধন্যবাদ।

 

লেখক : সাবেক সেনাপ্রধান।

সর্বশেষ খবর