শনিবার, ৯ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

পেঁপেতে সাফল্যের সুঘ্রাণ

শাইখ সিরাজ

পেঁপেতে সাফল্যের সুঘ্রাণ

কৃষিতে শুধু অর্থ বিনিয়োগ নয়, মনন এবং সাধনাও বিনিয়োগ করতে হয়। তা না হলে সাফল্য পাওয়া কঠিন। এ কথা অবশ্য শুধু কৃষির ক্ষেত্রে নয়। পৃথিবীতে যারা সফল হয়েছেন তারা মূলত বিনিয়োগ করেছেন সময়, একাগ্রতা ও নিষ্ঠা। আর কৃষিও তাই দাবি করে। কৃষি মানে প্রাণের লালন-পালন। গাজীপুরের জিয়াউল হক রিপন বলছিলেন ঠিক এ কথাটাই, কৃষিকে লালন করতে হয় প্রাণ দিয়ে। তিনি তার পেঁপে  বাগানের পেঁপে গাছগুলোকে সন্তানের মতো মনে করেন।  তাদের সেভাবেই সেবাযত্ন করেন। বলছিলেন, ‘এ গাছগুলোর তো প্রাণ আছে। আমি এ প্রাণগুলো থেকে ফল নেব, তাই তাদের সেভাবেই মায়া করি।’

বলছিলাম গাজীপুর সদরের বি কে বাড়ি ছিটপাড়ার জিয়াউল হক রিপনের কথা। ১৫ বছর ধরে এই তরুণ পেঁপে চাষ করে আসছেন। বিএ পাস করে ভাগ্যান্বেষণে একদিন ইটভাটায় চাকরি নিয়েছিলেন। কিন্তু সংসারের চাহিদা মেটাতে পারছিলেন না। শৈশব থেকে কৃষির প্রতি ছিল অনুরাগ। চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর বিভিন্ন প্রতিবেদন দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে একদিন বেছে নেন কৃষিকাজ। কৃষি মূলত চ্যালেঞ্জিং একটা পেশা। আর সেই চ্যালেঞ্জটাকেই তিনি গ্রহণ করলেন। ১০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে শুরু করেন পেঁপে চাষ। তারপর শ্রমে, একাগ্রতায় ও নিষ্ঠায় তিনি দেখেছেন সাফল্যের মুখ। এখন তার ৪২ বিঘা জমিতে পেঁপের বাগান। যেখানে রয়েছে সাড়ে বারো হাজার পেঁপে গাছ। বছরে পেঁপের উৎপাদন আসে সাড়ে ৩শ থেকে প্রায় ৪শ টন।

জিয়াউল হক রিপন শোনালেন তার জীবনের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। প্রত্যয়ী এ তরুণ জানালেন, ১০ বিঘা জমি লিজ নেওয়ার আগে অনেক হিসাব-নিকাশ করে নিয়েছেন। ঘুরে দেখেছেন বেশ কিছু কৃষি খামার। পড়াশোনা করে নিয়েছেন পেঁপে চাষের নানা বিষয়াদি সম্পর্কে। বিশাল এক পেঁপে বাগান। সারি সারি পেঁপে গাছ। আর গাছভর্তি সতেজ পেঁপে। সারা বছরই পেঁপে চাষ করেন রিপন। শুধু পেঁপেই না। পেঁপে তার মূল ফসল। সাথী ফসল হিসেবে চাষ করেন ডাঁটা, টমেটো, কাঁচা মরিচসহ নানা রকম শাক-সবজি। পেঁপে গাছের সঙ্গে খেতের আলে বুনে দেন ডাঁটা আর দুই সারির মাঝখানে চাষ করেন ফুলকপি। ফুলকপি উঠে গেলেই শুরু করেন কাঁচামরিচের চাষ। এভাবেই পেঁপের পাশাপাশি একই সময়ে তিনি চাষ করছেন মৌসুমি শাক-সবজি। বছরব্যাপী পেঁপে উৎপাদনের খরচ হয় তার প্রায় ১৫ লাখ টাকা। সাথী ফসল থেকে এ খরচের ৫০ ভাগ উঠে আসে। রিপন জানালেন, পেঁপে চাষের বৈশিষ্ট্য হলো লগ্নির টাকা এককালীন ব্যয় করতে হয় না। পেঁপে কাঁচা অবস্থা থেকেই বিক্রি শুরু হয়। এ জন্য ব্যয়ের অনেকাংশই পূরণ হয়ে যায় উৎপাদনকালীন। 

রিপনের পেঁপে চাষের মূল উদ্দেশ্য পাকা ফল। সবজি হিসেবে যে পরিমাণ পেঁপে বিক্রি করেন সেগুলো মূলত উদ্বৃত্ত। হিসাবটাও সুন্দর করে কষে দেখালেন তিনি। তার খেতে গাছ আছে ১২ হাজারের অধিক। প্রতি গাছে ফল আসে ৭০-৮০টি করে। এত ফল গাছে থাকলে ফলের আকার বড় হবে না। তাই ছোট ফলগুলো আস্তে আস্তে তুলে নিয়ে কাঁচা বিক্রি করে ফেলেন। প্রতি গাছে রাখা হয় ২৫-৩০টি করে পেঁপে। গড়ে প্রতি গাছ থেকে ২০টি করে পাকা পেঁপে পেলেও মোট পেঁপে হয় ২ লাখ ৪০ হাজারটি, যার ওজন দাঁড়ায় ৩৬০ টন। ৪ থেকে ৫ মাসের পেঁপে ফলনে এই উদ্যোক্তা সব খরচ বাদে বছরে আট থেকে ১০ লাখ টাকা লাভ করেন। রিপন জানালেন, সঠিক নিয়ম মেনে তিন থেকে চার বিঘা জমিতে পেঁপে চাষ করে খুব ভালোভাবে সংসার চালানো সম্ভব। যা এখন এই এলাকায় অনেকেই করছেন। এমন উদ্যোগী দু-একজন তরুণের সঙ্গেও কথা হলো। রিপন তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। দেখিয়েছি স্বাবলম্বী হওয়ার অন্যরকম এক গন্তব্য। এক সময় হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজেছেন। বাধ্য হয়ে কম বেতনে ছোট চাকরিও করেছেন জিয়াউল হক রিপন। এখন পেঁপে চাষই তাকে করেছে স্বাবলম্বী। তার এই খামারে কাজ করেন ১০ জন নিয়মিত শ্রমিক। এ ছাড়াও মৌসুমি শ্রমিক তো রয়েছেই। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম তারাও এখানে কাজ করে খুশি। শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্টের ভরসা রিপন।

১৫ বছর ধরে পেঁপে চাষের সঙ্গে যুক্ত রিপন কৃষিকাজে খুব হিসাবি। পেঁপের চারা তিনি এখন আর বাজার থেকে কিনেন না। প্রতিবার ১৫-২০টা গাছ তিনি বীজের জন্য আলাদা করে রাখেন। সেগুলো থেকে ফল নিজে খান, পরিবারের লোকজনদের দেন, পাড়া-প্রতিবেশীরাও বাদ পড়ে না। পরে তাদের কাছ থেকে সংগৃহীত বীজগুলো রেখে দেন। এ থেকেই চারা তৈরি করেন। রিপন বললেন, একই জমিতে এক ফসল চাষ করছেন ১৫ বছর ধরে। কখনো ফলন কম আসেনি। কারণ ফল কেটে নেওয়ার পর গাছগুলো জমির সঙ্গে চাষ দিয়ে মিশিয়ে ফেলেন। যা থেকে হয় জৈব সার। আর এ কারণে ফলনও হয় বেশি।

রিপনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এই যে এত এত পেঁপে উৎপাদন হচ্ছে, বাজারজাত করতে সমস্যা হয় না? তিনি বললেন, ঢাকার প্রায় সব কাঁচা বাজারের আড়ত মালিকদের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। ফল কাটার পর সরাসরি চলে যায় আড়তে। বাজারজাতকরণে কোনো সমস্যাই হয় না। যে ফলগুলো বেশি পেকে যায়, সেগুলো চলে যায় স্থানীয় বাজারে। মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য থেকে অনেকটাই নিজেকে বাঁচিয়ে চলছেন বলা যায়।

পেঁপের জন্য টানা বৃষ্টিপাত খুব ক্ষতিকর। গত মৌসুমে টানা বৃষ্টিপাতে অনেক সবজি খেত ও পেঁপে বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রিপনের বাগানটি ব্যতিক্রম। তার আন্তরিক প্রচেষ্টায় পেঁপের কোনো ক্ষতি হয়নি। মেধাবী এই কৃষকের শ্রম আর নিষ্ঠা দেখে অভিভূত হতে হয়। গাছের সঙ্গে কী নিবিড় সম্পর্ক থাকলে এমন সফল কৃষি উদ্যোক্তা হওয়া যায় রিপন তা বোঝালেন।

জিয়াউল হক রিপন কৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রমাণ করেছেন জীবিকার অফুরন্ত সম্ভাবনা এখনো কৃষিতেই। কৃষিই আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শক্তি। এ শক্তির পরিধি ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। এখনো যারা গ্রামের আবাদি জমি ও চাষের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তাদের জানাতে চাই, আজকের দিনে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সুন্দর ক্ষেত্র কৃষি। এখানে যেমন চ্যালেঞ্জ রয়েছে, রয়েছে লাভও।  মাটি আর ফসলের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশতে পারলে ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কৃষিতে আত্মনিয়োগ করুন, নিজে আর্থ-সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হন।  আর ভূমিকা রাখুন দেশের খাদ্য নিরাপত্তায়।

 

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর