শিরোনাম
শনিবার, ৯ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা
ইতিহাস

অটমানের কুপ্রিলি উজিরবর্গ

সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে অটোমান সাম্রাজ্যের দ্রুত  অবনতি হতে থাকে। বহিঃশত্রুর আক্রমণ, গৃহযুদ্ধ, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সুলতানদের অযোগ্যতা, সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ, দুর্নীতিপূর্ণ প্রশাসন, হেরেমের প্রভাব প্রভৃতি কারণে তুর্কি সাম্রাজ্যের পতন যখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে তখন চতুর্থ মুহম্মদের রাজত্বকালে কুপ্রিলি উজিরবর্গের অভ্যুদয়ে এই পতন সাময়িকভাবে রোধ হয়। ১৬৫৬ থেকে ১৭০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছিচল্লিশ বছর আলবেনীয় কুপ্রিলি পরিবারের চারজন প্রভাবশালী সদস্য অটোমান সাম্রাজ্যে অসামান্য অবদান রাখেন। এই পরিবারের সর্বাপেক্ষা খ্যাতনামা সদস্য ছিলেন মুহম্মদ কুপ্রিলি। তিনি আলবেনিয়ার অধিবাসী ছিলেন এবং পরবর্তীকালে এশিয়া মাইনরের আমাসিয়া অঞ্চলের কুপ্রিলি শহরে বসতি স্থাপন করেন। অতি সামান্য অবস্থা থেকে মুহম্মদ কুপ্রিলি স্বীয় মেধা ও যোগ্যতাবলে দামেস্কে, ত্রিপলি এবং জেরুজালেমের শাসনকর্তার পদ লাভ করেন। সত্তর বছর বয়সে সুলতানা ভালিদের পরামর্শমতো ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে তাকে প্রধান উজিরের পদে বহাল করা হয়। চতুর্থ মুহম্মদের রাজত্বকালে মুহম্মদ কুপ্রিলি অসামান্য ক্ষমতা ও প্রভাবের অধিকারী ছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম প্রশাসনকে কলুষমুক্ত করার মানসে দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারী, অসৎ বিচারপতি, অযোগ্য সেনাধ্যক্ষ এবং বিদ্রোহী সৈন্যদের হত্যার আদেশ দেন। যারা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল তারাও এই হত্যালীলা থেকে বাদ পড়ে নাই। এরূপ কঠোর নীতি অবলম্বনের ফলে রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা স্থাপিত হয় এবং সেনাবাহিনী পুনরায় সুশৃঙ্খল ও কর্তব্যপরায়ণ হয়ে ওঠে। তিনি বলিষ্ঠ হস্তে এশিয়া মাইনর ও অপরাপর স্থানের বিদ্রোহ দমন করেন। তুর্কি নৌবাহিনীকে পুনর্গঠিত ও পুনরুজ্জীবিত করা হয়। মুহম্মদ কুপ্রিলির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পুনরায় তুর্কি নৌবহর এজিয়ান সাগরে প্রাধান্য বিস্তারে সমর্থ হয়। ভেনিসের সঙ্গে যুদ্ধে তুর্কিগণ সাফল্য অর্জন করে। লেমনস এবং ট্রেনেডস দ্বীপদ্বয় তুরস্ক পুনরায় উদ্ধার করে। ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পাঁচ বছর তিনি অসীম দক্ষতা ও অসামান্য মেধার সঙ্গে রাজ্য শাসন করেন। মুহম্মদ কুপ্রিলির মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য পুত্র আহম্মদ কুপ্রিলি রাজমাতা সুলতানা ভালিদের অনুকম্পায় সর্বময় প্রশাসনিক ক্ষমতা লাভ করেন। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে আহম্মদ কুপ্রিলি পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। তুর্কি ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি ‘অটোমান সাম্রাজ্যের রাজনীতিবিদের দীর্ঘ তালিকায় সুকোল্লী সর্বাপেক্ষা খ্যাতনামা ছিলেন।’ প্রধান উজিরের পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার আগে তিনি প্রাদেশিক শাসনকর্তা হিসেবে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন এবং এ কারণে তার দীর্ঘ পনেরো বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় ছিল। তিনি ইসলামের আইনকানুন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করতেন। কিন্তু অমুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর কোনোরূপ অত্যাচার করতেন না। পক্ষান্তরে তার শাসনামলে সর্বজাতির পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতা বজায় ছিল। তিনি খ্রিস্টান প্রজাদের গির্জা নির্মাণ ও সংস্কারের প্রতি নিষেধাজ্ঞা বিলোপ করেন, রায়তদের আর্থিক উন্নতি বিধান করে করের হার লাঘব করেন। ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত তার শাসন ছিল খুব উদার ও জনপ্রিয়।

আহম্মদ কুপ্রিলি খ্রিস্টান ইউরোপের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানের উদ্দেশ্যে ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে এক লাখ বিশ হাজার সৈন্য এবং তেইশটি কামানসহ অস্ট্রিয়ার দিকে অগ্রসর হন। দানিউব অতিক্রম করে নেউহাউসেল অধিকার করেন। কিন্তু পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেন্ট গথহার্ডের সন্নিকটে অস্ট্রো-হাঙ্গেরির সম্মিলিত বাহিনীর নিকট পরাজিত হন। এই যুদ্ধে প্রায় দশ হাজার তুর্কি সৈন্য নিহত হয়। এই যুদ্ধের তাৎপর্য ছিল অপরিসীম। কারণ এর ফলে খ্রিস্টান ইউরোপ শুধু ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে মোহাকের যুদ্ধে তুর্কিদের হাতে পরাজয়ের গ্লানি মোচনই করল না, বরং তাদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বও প্রমাণিত হলো। তুরস্ক ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে ভাস্কারের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় এবং এটা ছিল মোটামুটি সিলভাটোরোকের চুক্তির পুনরাবৃত্তি। এই সন্ধির শর্তানুযায়ী ট্রানসিলভানিয়া থেকে তুর্কি অস্ট্রীয় সৈন্য অপহৃত হলো এবং সেরিভাম ও নেউহাউসেল ব্যতীত অস্ট্রিয়ার সমগ্র  অঞ্চল তুরস্ককে ছেড়ে দিতে হয়।

সর্বশেষ খবর