শনিবার, ৯ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

মাহে রমজানে সাদকায়ে ফিতরের বিধিবিধান ও গুরুত্ব

মুফতি মুহিবুল্লাহিল বাকী
পেশ ইমাম, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহতায়ালার নিমিত্তে যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, যিনি আমাদের ইমানদারদের দলে শামিল করে রমজান মাসে রোজা পালনের তৌফিক দিয়েছেন, সেই মহাপ্রভু পরওয়ারদেগারের লাখো শুকরিয়া আদায়ের পর হাজারো সালাত ও সালাম পেশ করছি সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে। যার আনীত জীবনাদর্শই হলো আমাদের চলার পথের একমাত্র পাথেয়।

আলোচনার শুরুতেই জানিয়ে দিচ্ছি যে, গত ৩০/০৫/২০১৮ইং তারিখে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বায়তুল মোকাররম সভাকক্ষে জাতীয় ফিতরা নির্ধারণ কমিটির এক সভায় এ বছর সাদকাতুল ফিতরের হার জনপ্রতি সর্বোচ্চ ২ হাজার ৩১০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

সাদকাতুল ফিতরের বিধিবিধান ও তার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনার শুরুতে আমরা পরিষ্কার করতে চাই যে, সাদকাতুল ফিতর বলতে কী বোঝায়? ফিতর শব্দটি আরবি। এর অর্থ হলো রোজা ভঙ্গকরণ। ফলে সাদকাতুল ফিতর হলো রোজা খোলার সাদকা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় সাদকায়ে ফিতর বলতে সেই ওয়াজে সাদকাকে বোঝায়, যা রমজান মাসের রোজা শেষ করার কারণে ধার্য হয়। রমজান মাস শেষ হওয়ার পরদিন অর্থাৎ শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে রোজা খোলার পর প্রত্যেক মুসলমান স্বেচ্ছাকৃতভাবে দরিদ্র, অভাবী ও মিশকিনদের মধ্যে যে খাদ্যদ্রব্য বা অর্থ বণ্টন করে থাকেন, তাকে ফেকাবিদ ও মুহাদ্দেসিনগণ সাদকাতুল ফিতর নামে অবিহিত করেন। অন্যকথায় রমজান মাসের রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতির ক্ষতি পূরণার্থে এবং সমাজের অভাবগ্রস্তদের খাদ্যসামগ্রী প্রদানের উদ্দেশ্যে ঈদের নামাজের আগে নির্ধারিত পরিমাপের যে খাদ্যসামগ্রী বা তার সমমূল্য পরিমাণ অর্থ দান করা হয় তাকে শরিয়তের পরিভাষায় বলা হয় সাদকাতুল ফিতর। হিজরি দ্বিতীয় সনে যে বছর মুসলমানদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছিল সে বছরই ঈদুল ফিতরের দুই দিন আগে সাদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়। যে ব্যক্তি ঈদের দিন পারিবারিক খরচাদি ছাড়াও নেসাব পরিমাণ মালিক থাকেন তার ওপর সাদকাতুল ফিতর ওয়াজিব।

এ বর্ধিষ্ণু মালের বছর ঘুরে আসাও শর্ত নয়। বরং যার কাছে ওই সময় একদিন ও এক রাতের খাবার থাকবে তাকেই এই ফিতরা আদায় করতে হবে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) প্রত্যেক আজাদ, গোলাম, পুরুষ, নারী, প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিমদের ওপর সাদকাতুল ফিতর হিসেবে খেজুর অথবা জব এক সা’ পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন। (বোখারি শরিফ হা-১৫০৩)।

অপর এক হাদিসে বলা হয়, অর্থাৎ হজরত আবু হোবায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, সাদকাতুল ফিতর নির্ধারণ করা হয়েছে, প্রত্যেক স্বাধীন-ক্রীতদাস, পুরুষ, নারী, ছোট-বড়, গরিব ও ধনীর ওপর এক সা’ খেজুর দ্বারা। (মুসনাদে আহমাদ হা-৭২) কেন এ সাদকাতুল ফিতর? এর জবাবে বলা যায়, রমজান মাসে রোজাদারগণ তাদের সাধ্যানুযায়ী রোজার মর্যাদা রক্ষার চেষ্টা করে যান। কিন্তু তারপরও তাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে অনেক ভুলত্রুটি হয়ে যায়, এসবের কাফফারা হিসেবে ফিতরার বিধান ইসলামে বিদিত। সাদকায়ে ফিতরের অরেকটি তাৎপর্য হলো মানুষ আল্লাহতালার রাস্তায় আগ্রহসহকারে তার অর্জিত মাল ব্যয় ব্যবহার করবে, যাতে করে সমাজের গরিব অভাবী দুস্থ লোকজন নিশ্চিন্তে এবং ভালোভাবে তাদের অভাব দূর করতে পারে এবং সাময়িকভাবে হলেও তাদের অন্ন-বস্ত্রের প্রয়োজন পূরণ হয় এবং তারাও স্বাচ্ছন্দ্যে অপরাপর মুসলমানদের সঙ্গে ঈদগাহে হাজির হতে পারে।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রসুলে করিম হজরত মুহাম্মদ (সা.) সাদকায়ে ফিতর এ জন্য নির্ধারণ করেছেন, এ ফিতরা রোজাদারদের অসার কথাবার্তা এবং অশ্লীলতার ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে পবিত্র করে এবং পাশাপাশি অভাবগ্রস্তদের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। অতএব, যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের পূর্বে সদকায়ে ফিতর পরিশোধ করবে তার সে সাদকা কবুল হবে এবং যে নামাজের পর পরিশোধ করবে তা সাধারণ দান খয়রাতের মতো একটি সাদকা হবে (আবু দাউদ শরিফ হা-১৬১১)।

অপর এক হাদিসে বলা হয়, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) রোজা পালনকারীদের বেহুদা কথাবার্তা ও অশ্লীলতা থেকে পবিত্রতা অর্জন এবং ঈদের দিন মিশকিনদের আহার হিসেবে সাদকাতুল ফিতরকে অপরিহার্য করেছেন (আবু দাউদ, ইবনে খাজা)।

ইসলামী ফাউন্ডেশন বায়তুল মোকাররমের সভাকক্ষে জাতীয় ফেতরা নির্ধারণ কমিটি এ ফিতরার বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নেন, তার নির্যাস হলো ইসলামী শরিয়া মতে আটা-খেজুর, কিশমিশ, পনির ও যব ইত্যাদি পণ্যের একটি দিয়ে অথবা তার নির্ধারিত মূল্য দিয়ে ফিতরা আদায় করা যাবে। আটা দিয়ে ফিতরা আদায় করলে এক কেজি ৬৫০ গ্রাম বা এর মূল্যমান ৭০ টাকা প্রদান করতে হবে। যব দিয়ে দিলে দিতে হবে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা তার মূল্যমান ৫০০ টাকা। কিশমিশ দিয়ে আদায় করলে দিতে হবে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা মূল্যমান ১ হাজার ৯৮০ টাকা। পনির দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম যার মূল্যমান দু হাজার ৩১০ টাকা হারে ফিতরা আদায় করতে হবে। দেশের বিভিন্ন বিভাগ হতে সংগৃহীত আটা, যব, খেজুর, কিশমিশ ও পনির এর সর্বোচ্চ বাজার মূল্যে ভিত্তিতে এ ফিতরা নির্ধারণ  করা হয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন।

আল্লাহতায়ালা আমাদের তাঁর নির্দেশ পালনের তৌফিক দিন। 

সর্বশেষ খবর