চমৎকার এক ফুটবল বিশ্বকাপের সমাপ্তি হলো। রাশিয়া যে সত্যিই একটি মহান জাতি তারও প্রমাণ হলো তাদের আতিথেয়তা, সেবাযত্ন ও ভালোবাসায়। ফুটবলের পরের বিশ্বকাপ দেখতে পাব কিনা জানি না। আমরা সম্পূর্ণ এক দ্বিধাবিভক্ত জাতি। আমরা বাঙালিরা ইস্পাতকঠিন ঐক্যে একজোট হয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতাযুদ্ধে। আজ আমরা যে যেখানেই থাকি সে জিয়াউর রহমানই বলুন আর কাদের সিদ্দিকীই বলুন, মেনন-ইনু-কর্নেল অলি-মেজর হাফিজ-সফিউল্লাহ-খালেদ মোশাররফ কর্মজীবনে ব্যর্থ-সফল যার কথাই বলুন আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিলে নেতা অন্য কেউ নয়, নেতা বঙ্গবন্ধু। মাঝে মাঝে কেন যেন এখন আবার এক ও অভিন্ন হতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও বাইরে যেমন একতা পাই না, ঘরেও মত-পথের ভিন্নতা লেগেই থাকে। আমার কাছে আম ভালো, স্ত্রীর কাছে কাঁঠাল, ছেলে মাছ খাবে তো মেয়ের পছন্দ মাংস। কেউ কাউকে সমর্থন করলে একজন একদিকে আরেকজন অন্যদিকে। একটা না একটা অমিল লেগেই থাকে। দুই মেয়ের গলায় গলায় খাতির। কিন্তু তবু তাদের নিয়ে দিনে দু-একবার অমিলের কথা ওঠে। বহুদিন পর এই প্রথম বাড়ির সবাই মিলের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলাম। সে ছিল রাশিয়ায় ফুটবলের বিশ্বকাপে। আমরা সবাই ছিলাম ক্রোয়েশিয়ার পক্ষে। সারা দেশে কত আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের পতাকা পতপত করে উড়ছিল। মায়ের জন্য এক বড়ি ওষুধ কেনে না, কিন্তু পাঁচ কিলোমিটার লম্বা পতাকা বানায়। সেই দল আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল কখন বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়েছিল অনেকে বুঝতেই পারেনি। রাশিয়া ভালো করেছিল। তাদের কপালে যেন টাইব্রেকার লেখাই ছিল। এ কদিন টিভিতে আটকে রেখেছিল আমাদের। সবসময় একটা চিন্তা মাথায় লেগেই ছিল, কখন খেলা হবে। সত্যি কথা বলতে কি, আনন্দে একটা মাস চলে গেল। বিশেষ করে ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার সমর্থনে আমাদের পরিবারে ছোট-বড় সবার যে একটা ঐক্য হয়েছিল তা যদি বহাল থাকে তাহলে তা হবে আমার জীবনে এক শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এমন সুন্দর ঐক্য যদি দেশবাসীর মধ্যে আসত তাহলে কতই না গর্ব করার মতো হতো।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে আগাগোড়াই ভালোবাসার চোখে দেখি। তিনিও আমায় অসম্ভব সম্মানের চোখে দেখেন। যখন খুব একটা পারেন না সেটা পরিবেশ-পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা। আওয়ামী লীগের মতো একটা দলে বিশেষ করে এরকম পরিবেশে মাথা ঠিক রেখে সবসময় কথা বলা খুব একটা সহজ কাজ নয়। প্রতিদিনই যখন এটা-ওটা বলতে হয় তখন যেমন কথার ধার, ভার দুটোই কমে, মানুষের অপছন্দও হয়। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়। কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাস্তা করা শেষ হওয়ার আগেই দুই পাশের ৪০ ভাগ বেদখল। কত সুন্দর সুন্দর রাস্তা, কিন্তু যানজট লেগেই আছে। কোথাও পুরো রাস্তা ব্যবহার করা যায় না। অর্ধেক ইট-বালু-সিমেন্ট-কাঠ-বাঁশ-গাড়ি-ঘোড়া দখল করে আছে। অনেক জায়গায় ফোর লেন হচ্ছে। কোনো কোনো জায়গায় আর চার-ছয় ফুট প্রশস্ত হলে অবলীলায় দুই দুই চার গাড়ি দুই পাশে চলাচল করতে পারত। কিন্তু চার-ছয় ফুটের জন্য ফোর লেনেও গাড়ি চলবে দুটি। আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা কোনো পরিকল্পনা করেন না, করতে পারেনও না। বিদেশি টাকায় বড় বড় প্রজেক্ট হলে বাইরের ইঞ্জিনিয়াররা করেন। আইয়ুব খানের আমলে টাঙ্গাইল জেলা সদর হয়েছিল। আমেরিকান ইঞ্জিনিয়াররা নকশা করেছিলেন। আমরা দক্ষিণে খোলা বা বারান্দা দিয়ে ঘরদোর করি। আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার সব করেছেন উত্তরমুখী। ঝড়-বাদলে এখনো ঘরদোর পানিতে একাকার হয়ে যায়। বাংলাদেশের অন্যতম স্থাপত্য লুই কানের সংসদ ভবন। সেটায়ও ঝড়-বৃষ্টিতে পানিপুনি ঢোকায় প্রচুর অসুবিধা হয়। পরিকল্পনাগুলোয় আমাদের দেশের আবহাওয়া বিচার করা হয়নি, মানুষের চলাফেরাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর সময় ঢাকা-টাঙ্গাইল রাস্তা ভালো করা হয়েছিল। আমরা কত ভাবলাম রাস্তায় যে স্পিড বাড়বে তাতে রিকশা-ভ্যান, অন্য গাড়ি মহাসড়কে উঠতে পারবে না। জেলা উন্নয়নের মিটিংয়ে এসব নিয়ে কত আলাপ-আলোচনা হলো, কত জল্পনা-কল্পনা, কত স্বপ্ন। কিন্তু এখন সেই রাস্তা আগের চাইতেও খারাপ। দুই লেনের জায়গায় চার লেন হচ্ছে। কিন্তু তেমন উন্নতি হচ্ছে না। সে সময় কালিয়াকৈর থেকে এলেঙ্গা ১১-১২ জায়গায় ডিভাইডার, গোলচত্বর করা হয়েছিল। যাতে দৈনিকই দুর্ঘটনা ঘটত। সময়টা ছিল বিএনপির। সংসদে অনেক চেঁচামেচি করেছিলাম। রেজাউল হায়াত ছিলেন যোগাযোগ সচিব, নাজমুল হুদা মন্ত্রী। তাদের নিয়ে রাস্তা দেখিয়েছিলাম। ইঞ্জিনিয়াররা বলছিলেন, বিদেশি টাকায় প্রকল্প ডিভাইডার তুলে দেওয়া, গোলচত্বর ভেঙে দেওয়া কেমন হবে। শেষ পর্যন্ত রাবনা আর এলেঙ্গা গোলচত্বর ছাড়া সবকটি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। যার হাতে হাতে ফল পেয়েছিলাম। ধেরুয়া রেল ক্রসিংয়ে দিনে দু-তিনটি দুর্ঘটনা ঘটত। দেওহাটা পোষ্টকামারী-করাতিপাড়া-ক্ষুদিরামপুর সবকটিতে দিনে দু-তিনটি দুর্ঘটনা ঘটত। এখন যেখানে মাসে দু-একটি ঘটে। তাই রাস্তা নির্মাণের কৌশল চিন্তা করতে হবে। দুর্ঘটনাপ্রবণ কৌশল হলে দুর্ঘটনা ঘটবেই। আর নির্মাণকৌশল যদি এমন হয় যে, দুর্ঘটনা ঘটাতেও কষ্ট করতে হবে তাহলে দুর্ঘটনার প্রবণতা অনেক কমে যাবে। আর শুধু সড়ক নির্মাণ করলেই চলবে না, তার রক্ষণাবেক্ষণও করতে হবে। এখন যেখানেই ফোর লেন সেখানেই রাস্তার দুই পাশে আরও ছয় ফিট হার্ড শোল্ডার করলে এবং তা গাড়ি-ঘোড়া-ইটপাটকেল-বাঁশ-কাঠ ফেলে রাখার হাত থেকে মুক্ত রাখতে পারলে রাস্তার গতি অনেকটা বেড়ে যাবে। মাঝে সাঝে এসব বলি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীকে। তিনি হয়তো সাধ্যমতো চেষ্টাও করেন। কিন্তু তেমন সুফল ফলে না। তিনি রাত-দিন রাজনীতি করেন। তাই বহু কথা বলেন এবং অনেক শোনেন। অতিসম্প্রতি ভারত বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবী লর্ড কার্লাইলকে প্রবেশ করতে দেয়নি। এ সম্পর্কে অনেক মানুষ অনেক কথা বলেছেন। মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন, ‘খালেদা জিয়ার আইনজীবী লর্ড কার্লাইলকে ঢুকতে দেওয়া-না দেওয়া তাদের ব্যাপার, আমাদের নয়।’ এটাই যথার্থ। ভারত কাকে ঢুকতে দেবে কাকে দেবে না, কার ভিসার মেয়াদ বাড়াবে কার কমাবে এটা তাদের ব্যাপার। সুসম্পর্ক থাকলে অন্ধকারে আমরা কী বলছি কী করছি তা অন্য কথা। দিবালোকে কী বলছি তা আরেক কথা। একজন আইনবিদের ছেলে হয়েও খালেদা জিয়ার আইনজীবীর ভারতে এসে সংবাদ সম্মেলন করতে হবে— এটা যেমন বুঝিনি, ব্রিটিশ আইনজীবী রাখলে তাকে বাংলাদেশে আসতে দেওয়া হবে না— এরও কোনো অর্থ বুঝিনি। আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুর জন্য ব্রিটিশ আইনজীবী রাখা হয়েছিল। তার ফিসের জন্য আমরা গ্রামগঞ্জের কর্মীরা চাঁদা তুলে কেন্দ্রীয় অফিসে জমা দিয়েছি। সে সময় যদি ব্রিটিশ আইনজীবী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আমাদের আইনজীবী হতে পারেন তাহলে খালেদা জিয়ার মামলায় কেন হতে পারবেন না, আইনি লড়াই করতে পারবেন না— তা আমার মাথায় ধরে না। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক যেমন বলেছেন, ভারত তার দেশে কাকে ঢুকতে দেবে কাকে দেবে না এটা তার ব্যাপার। এটি প্রকৃত রাজনীতিকের মতো কথা। আবার কদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বললেন, ভারত কোনোমতেই বিএনপিকে সমর্থন করবে না। কথাটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের লঙ্ঘন। ভারত যদি বিএনপিকে সমর্থন না করে তাহলে কি আওয়ামী লীগকে করবে? রাষ্ট্র পরিচালনায় এক দেশ আরেক দেশের সঙ্গে নিশ্চয়ই সম্পর্ক রাখবে। সেটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনে ভারতের সমর্থনের কী থাকতে পারে? তারা কি ভোটার? তারা কি এ দেশের নাগরিক? তাই এইচ টি ইমামের মন্তব্য বাংলাদেশের জন্য মোটেই সম্মানের নয়। বরং সম্মানহানি হয়েছে। আওয়ামী লীগের লাভ হয়নি, ক্ষতি হয়েছে বেশুমার। আমরা অনেক কিছু তলিয়ে দেখি না তাই সময় থাকতে বুঝতে পারি না। সময় ফুরিয়ে গেলে সবই চোখে পড়ে। আজ জনাব এইচ টি ইমাম সব ক্ষেত্রেই রান্নার হলুদের মতো। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় তার খুব বেশি সুনাম ছিল না, বঙ্গবন্ধুর সময়ও নয়। শেষমেশ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয় তার শপথ অনুষ্ঠানের সব আয়োজন তিনি করেছিলেন। তাই কেন যে তিনি এত প্রয়োজনীয় বুঝতে পারি না। তবে এটাই স্বাভাবিক, যখন যার জোয়ার আসে তখন তিনি ফুলে-ফেঁপে অনেক বড় হয়ে যান। জনাব ইমামের ব্যাপারটাও অনেকটা সেই রকম।
সত্যিই এ কদিন জনাব ওবায়দুল কাদের অসাধারণ চমৎকার কথা বলছেন। একে তো খালেদা জিয়ার আইনজীবীকে ভারতে প্রবেশ করতে দেওয়া-না দেওয়া নিয়ে অসাধারণ বক্তব্য দিয়েছেন। অন্যদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ধৈর্য ধরতে বলেছেন। তারা তো ধৈর্য ধরেই আছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা যদি ধৈর্য না ধরত তাহলে কে বা কারা ভিসির বাড়ি আক্রমণ করে আগুন জ্বেলে তছনছ করে দিয়েছে তারা কিছু বলেনি। ভিসির বাড়ি গোলমালে প্রশিক্ষিত কারা ওসব করেছে সে তো সবার জানা। ছাত্ররা যদি কিছু করত তাহলে রাস্তাঘাটে গ্রামেগঞ্জে এটা-ওটা ভাঙত, জ্বালাত, শুধু ভিসির বাড়িতে যাবে কেন। কোটা সংস্কারে লাখো-কোটি মানুষের সমর্থন আছে। সে সংস্কার হওয়া চাই যুক্তিসংগত। তাই মাননীয় মন্ত্রী কোটা সংস্কারকারীদের ধৈর্য নয়, যারা আন্দোলন করছে তাদের ওপর অন্যায়ভাবে যারা হাতুড়ি চালাচ্ছে তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। শিক্ষকরা সমর্থন দেওয়ায় তাদের প্রতি যারা খারাপ ব্যবহার করছে তাদের থামানো দরকার। ’৬৯-এ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর জোহাকে হত্যা করে আইয়ুব খান টিকতে পারেননি। তাই শিক্ষকদের সম্মান করা উচিত। কোনোমতেই অপমান-অপদস্থ নয়। আশা করব সরকার এবং যারা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক তারা কথাগুলো মনে রাখবেন। মাননীয় মন্ত্রী আরও একটা যথার্থ প্রণিধানযোগ্য কথা বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশে রক্তের বন্যা বইবে। কথাটা পুরোপুরি মিথ্যা হলে প্রতিবাদ করতাম। কিন্তু কথাটা সত্য। গ্রামেগঞ্জে যে নিপীড়ন-অত্যাচার চলছে মানুষ বিএনপিকে ভোট দিলে তারা ক্ষমতায় এলে বিএনপি নেতৃবৃন্দ মক্কা-মদিনা সামনে নিয়ে ওয়াদা করেও তা পুরোপুরি থামাতে পারবেন না। তাহলে এই রক্তারক্তির হাত থেকে বাঁচার পথ কি তাও তো গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। ছিঁটেফোঁটাভাবে সব সমস্যাই সামনে আসছে। কিন্তু গভীরভাবে কেউ ভেবে দেখছে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এক চমৎকার সত্য কথা বলেছেন, জনগণ ভোট দিলে ক্ষমতায় থাকব, না দিলে থাকব না— এটাই তো যথার্থ কথা। গণতান্ত্রিক নেতার কথা, বঙ্গবন্ধুর কন্যার কথা। অত কাজ অত নাম করে জোর করে ভোট নিতে হবে কেন? কোথায় কি ত্রুটি আছে সেগুলো ভালোভাবে দেখলেই তো হয়ে যায়। চুরি-ডাকাতি করে সম্রাট হওয়ার চাইতে সৎপথে মুদির দোকানি হওয়া অনেক ভালো, অনেক সম্মানের। হাশরের ময়দানে আল্লাহর দরবারে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধানের চাইতে তিনি অনেক বেশি সম্মানি হবেন। নবী করিম (সা.) তাঁর শাফায়াতের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে থাকবেন।
লেখক : রাজনীতিক।
www.ksjleague.com