বৃহস্পতিবার, ২৬ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

হাতি দিয়ে সন্ত্রাস

সাইফুর রহমান

হাতি দিয়ে সন্ত্রাস

সম্রাট জাহাঙ্গীর তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন— ইথিওপিয়া থেকে জাহাজে চড়িয়ে সভাসদ মুকাবর খাঁ তাকে একটি হাতি উপহার দেন, যদিও হাতির প্রতি জাহাঙ্গীরের খুব যে একটা অনুরাগ ছিল তা বলা যায় না। তার পরও তার আত্মকথায় কম করে হলেও হাতি প্রসঙ্গ এসেছে পঞ্চাশবার। হাতির প্রতি বরং দুর্বার আকর্ষণ ছিল তার পিতা সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের মধ্যম ভ্রাতা শাহজাদা দানিয়েলের। এসব কথা আমরা জানতে পারি আবুল ফজল ও তুজুক্-ই-জাহাঙ্গীরি অর্থাৎ সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী থেকে। আকবরের হাতিশালায় সর্বসাকল্যে হাতি ছিল ৩৫ হাজারের মতো। সে সময় অর্থাৎ সেই ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে শুধু হাতির খাওয়া বাবদ প্রতিদিন ব্যয় হতো ৪ লাখ টাকা। বর্তমান হিসাবে হয়তো তা শত কোটি টাকাও ছাড়িয়ে যাবে। সম্রাট জাহাঙ্গীর তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন— ‘পিতার হস্তীশালা ছিল অতুলনীয়। পৃথিবীর কোনো সম্রাটই এত হাতি সংগ্রহ করতে পারে নাই এবং পারবেও না। কিন্তু আমি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর যুদ্ধ এবং আমোদ-প্রমোদের জন্য কয়েকটি হাতি রেখে অবশিষ্ট সব হাতি বনে ছেড়ে দিই।’ সম্রাট আকবর যে শুধু হাতি পছন্দ করতেন তা নয়। তিনি যে কোনো হাতিকে সম্মোহিত করতেও পারতেন। অনেক সময় এক হাতির পিঠ থেকে অন্য এক ভয়ঙ্কর ও অতিশয় দুর্দান্ত হাতির ওপর লাফিয়ে পড়তেন নির্দ্বিধায়।

এটি ছিল এমন এক হাতি যা ইতিপূর্বে বহু মাহুতকে অবলীলায় মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছে। সুতরাং এর পিঠে এভাবে আরোহণ করায় অনেক সুদক্ষ হাতিচালকও আশ্চর্যান্বিত হয়ে যেতেন। অনেক সময় দেখা যেত সম্রাট আকবর বড় কোনো বৃক্ষ থেকে কোনো একটি প্রকাণ্ড ও দুর্দান্ত হাতির পিঠে লাফিয়ে পড়লেন। তিনি বৃহৎ সেই হাতির পিঠে আরোহণ করামাত্র হাতিটিও যেন কোনো এক মন্ত্রবলে তার বশীভূত হয়ে যেত। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সহোদর শাহজাদা দানিয়েলের অধীনে হাতি ছিল ১৫০০। দানিয়েলের মৃত্যুর পর হাতিগুলোকে দেখাশোনার ভার জাহাঙ্গীরের ওপরই বর্তায়। তিনি তার আত্মজীবনীতে আরও লিখেছেন- ‘আমার ভ্রাতার সুন্দর হস্তীর মধ্যে একটি অশেষ গুণসম্পন্ন হস্তী ছিল। আমি ইহার নাম “ইন্দ্রের হস্তী” রাখিয়াছিলাম। এত বৃহৎ হস্তী আমি পূর্বে কখনো দেখি নাই। ইহার পৃষ্ঠে আরোহণ করিতে হইলে চৌদ্দ ধাপবিশিষ্ট একটি মইয়ের প্রয়োজন হইয়া থাকে। ইহার স্বভাব এত মৃদু ও শান্ত যে অতিশয় উত্তেজিত হইলেও ইহার সম্মুখে কোনো শিশু পতিত হইলে তত্ক্ষণাৎ শুঁড় দ্বারা সরাইয়া সযত্নে তাহাকে নিরাপদ স্থানে রাখিয়া দেয়। ইহা এত দ্রুতবেগে চলিতে পারে যে, অতি দ্রুতগামী অশ্বকেও পশ্চাৎপদ করিয়া দেয়। এই হস্তী এত সাহসী যে একশত মত্ত হস্তীর সহিত অনায়াসে যুদ্ধ করিতে পারে। ইহার অন্যান্য অনেক সদ্গুণও আছে।

প্রতিদিন প্রাতঃকালে এই হস্তী ১৪ সের জল পান করে এবং প্রতি প্রাতে ও সন্ধ্যায় ইহার জন্য ৫৬ সের চাল, ২৮ সের ভেড়া কিংবা গোরুর মাংস, ১৪ সের তৈল অথবা ঘি দ্বারা রন্ধন করা হয়।’ হাতি মূলত নিরামিষভোজী হলেও রাজড়াদের হাতি বলে কথা! ওরা তো এসবই খাবে তাই না? চাণক্য কিংবা কৌটিল্য তো আরও একধাপ এগিয়ে তার অর্থশাস্ত্রে হাতিদের মদ ও মাংস খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।

সমুদ্র কিংবা পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ যেভাবে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, হাতির সামনেও বোধকরি দর্শনার্থী এর বিশালতা ও সৌন্দর্যে বিস্মিত হয়। এই প্রাণীটিকে দেখে যেমন মুগ্ধ হয়েছিলেন সলোমন দ্য গ্রেট। ইথোপিয়ার রানী ‘কুইন অব সিবা’ যখন সলোমনের সঙ্গে দেখা করতে আসেন তখন তিনি এসেছিলেন হাতির পিঠে চড়ে। অন্যদিকে সলোমন রানী সিবাকে দেখা বাদ দিয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলেন সিবার হাতিগুলোর দিকে। এর কারণ সম্ভবত রাজা সলোমন ইতিপূর্বে কোনো দিন হাতি দেখেননি। হাতি অবশ্য শেক্সপিয়রও জীবনে দেখেছিলেন কিনা বলা যায় না, (না দেখার সম্ভাবনাই অবশ্য বেশি)। যিনি ইংল্যান্ডের বাইরে এক পা না ফেলেই লিখে ফেলেন ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’, ‘টু জেন্টেলম্যান ফ্রম ভেরোনা’ ইত্যাদি নাটক। তার পক্ষে সবই সম্ভব। কারণ তার লিখিত নাটক ‘জুলিয়াস সিজারে’ আছে সিজারকে হত্যার ঠিক আগের রাতে ক্যাসিয়াস ব্রুটাসকে বোঝাচ্ছেন— ভালুককে ঘাবড়ানো যায় আরশি দেখিয়ে, আর হাতিকে ফাঁদে ফেলা যায় গর্তে ফেলে— ‘বেয়ার্স্ উইথ গ্লাসেস, এলিফ্যান্টস্ উইথ হোলস্।’

শুধু কিং সলোমন কিংবা শেক্সপিয়রই নয়, সাড়ে তিন হাজার বছর আগে তুরস্ক, ইরান, কাজাখস্তান প্রভৃতি দেশ থেকে আর্যরা যখন ভারতবর্ষে আসেন তখন তারাও হাতি চিনতেন না। কারণ ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে তখন হাতি পাওয়া যেত না। সেজন্যই আর্যজাতির প্রধান কীর্তি হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদে ‘হস্তী’ শব্দটি মোটে পাঁচবার এসেছে। আর্যজাতি হাতি না চিনলেও মৃগ অর্থাৎ হরিণ চিনত খুব ভালো করে। আর এজন্যই তারা হাতিকে বলতেন ‘হস্তীমৃগ’, ঋগ্বেদেও সে কারণে হাতিকে হস্তীমৃগ বলে সম্বোধন করা হয়েছে।

প্রশান্ত মহাসাগরের পলিনেশিয়ান অঞ্চলে ফরাসি ঔপনিবেশিক দেশ তাহিতি দ্বীপের লোক শুধু শূকর চিনত। ইউরোপীয়রা যখন সেখানে ঘোড়া, কুকুর, ভেড়া আরও নানারকম জন্তু-জানোয়ার নিয়ে গেল তখন লোকজন ঘোড়াকে বলত চিঁ-হিঁ-হিঁ শুয়োর, কুকুরকে বলত ঘেউ ঘেউ শুয়োর, ভেড়াকে বলত ভ্যা ভ্যা শুয়োর। আর্যরা একইভাবে মৃগ চিনতেন, কেননা তারা শিকারে খুব পারদর্শী ছিলেন। তাদের খাবারদাবারের মূল উৎসই ছিল হরিণের মাংস। ভারতবর্ষে এসে যখন তারা হাতি দেখলেন তখন তাকে হাতওয়ালা হরিণ বলে ডাকতে লাগলেন। এক অর্থে হস্তী মানে তো হাতই।

এবার হাতি প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে দু-চার কথা বলি। এই তো কয়েকদিন আগে গাড়ি নিয়ে নিকুঞ্জ থেকে প্রধান সড়কে ওঠার জন্য যানজটে পড়েছি। সঙ্গে পুরো পরিবার। হঠাৎ কোত্থেকে বিশালাকৃতির এক হাতি এসে দাঁড়াল একেবারে গাড়ির সামনে। জানালা খুলে ড্রাইভার কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই হাতিটি ওর লম্বা শুঁড়টি ঢুকিয়ে দিল জানালার ভিতর দিয়ে। আর যায় কোথায়! আমার তিন বছরের ছেলেটি ভয় ও আতঙ্কে চিৎকার জুড়ে দিল। আমার স্ত্রী তড়িঘড়ি করে তার ব্যাগ থেকে ১০টি টাকা তুলে দিল হাতির শুঁড়ে। না, হাতি ১০ টাকা নিতে রাজি নয়। পিঠের ওপর থেকে হাতিটিকে কৌশলে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন চতুর মাহুত। হাতির দাবি ৫০ টাকা। অবশেষে ২০টি টাকা হাতির শুঁড়ে গুঁজে দিয়ে কোনোমতে সে সময়ের জন্য রক্ষা পাওয়া গেল। এর কিছুদিন আগের ঘটনা। আমার ভগ্নিপতি আমার দুই ভাগ্নে জাহিন ও জাবিরকে নিয়ে রেসিডেনশিয়াল স্কুল থেকে সবে বের হয়েছেন। ভাগ্নে দুটি পড়ে ওই স্কুলে। রিকশায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আচানক এক হাতি এসে সামনে হাজির। দাঁড়িয়ে গেছে শুঁড় উঁচিয়ে। ভাগ্নে দুটি তো ভয়ে অস্থির। ৫০ টাকা গচ্চা দিয়ে তবেই মুক্তি। মাসখানেক আগে আমার একজন অতি প্রিয় মানুষ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসান নিজে ড্রাইভ করে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন ঢাকার পূর্বাচলের দিকে। সেখানেও হাতির চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য। আচমকা অতিকায় এক হাতি এসে পথরোধ করে দাঁড়িয়ে গেল তার গাড়ির সামনে। ব্যারিস্টার হাসানেরও রোখ চেপে গেল মাথায়। এসব কী! দিনদুপুরে চাঁদাবাজি! যাক অবশেষে অল্পের জন্য রক্ষা পায় তার ব্যক্তিগত গাড়িটি। ভাবতেই অবাক লাগে হাতির মতো এমন সংবেদনশীল প্রাণীকে দিয়ে চাঁদাবাজি করানো হচ্ছে। হাতি নিঃসন্দেহে সব প্রাণিকুলের মধ্যে অন্যতম বুদ্ধিদীপ্ত একটি প্রাণী। সেই সঙ্গে মানুষের স্বভাবচরিত্রের সঙ্গেও হাতির স্বভাব-চরিত্রের রয়েছে বিস্তর সাযুজ্য। বর্তমানে যদিও হাতি পোষা হয় প্রধানত চাঁদাবাজি ও সার্কাস খেলা দেখানোর জন্য। কিন্তু প্রাচীনকালে হাতি পোষা হতো মূলত হাতিকে যুদ্ধে ব্যবহার ও রাজা-জমিদারদের শিকারের প্রয়োজনে। ভারতে হাতির ব্যবহার সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় তার লেখা ‘বাঙালির ইতিহাস’ বইতে লিখেছেন— ‘গ্রিক ঐতিহাসিকেরা বলিতেন যুদ্ধে গঙ্গা রাষ্ট্রের সৈন্যবলের মধ্যে প্রধান বলই ছিল হস্তীবল।’ কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় এই হস্তীবলই মার খেয়েছিল দুটি ক্ষেত্রে। বিশেষ করে আলেকজান্ডার ও তৈমুর লংয়ের কাছে।

যুদ্ধে হাতি ব্যবহারের চিন্তাভাবনার শুরু ভারতেই। ভারতীয় রাজা পুরু ও সম্রাট আলেকজান্ডারের সেই ইতিহাসবিখ্যাত যুদ্ধ— ফলাফলে পুরুরাজ হেরেছিলেন। কিন্তু অমিতবিক্রম সম্রাটও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন ভারতের ছোট্ট এক রাজ্যের রাজার রণবাহিনীতে এত হাতি দেখে। যুদ্ধে হাতি তিনিও ব্যবহার করেছিলেন, তবে পুরুরাজের ১৩০টির তুলনায় তা নেহাতই কম। মাত্র ৩৮টি। তবু আলেকজান্ডারের বুদ্ধির কাছে তাকে হার মানতে হয়েছিল। এ ছাড়া হাতিকে ঘায়েল করার কলাকৌশল আলেকজান্ডারের জানা ছিল ভালোভাবেই। এর আগে প্রুশিয়ার যুদ্ধে তিনি গজবাহিনী স্বচক্ষে দেখেছিলেন।

চীনা সম্রাট কুবলাই খানকে চার হাতির পিঠের ওপর বসানো কাঠের তৈরি প্রাসাদে কীভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা পাওয়া যায় মার্কোপোলের বিবরণে।

১৩৯৮ সালে তৈমুর লং যখন ভারত আক্রমণ করেন তখন দিল্লির সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহ তুঘলক সহস্রাধিক হাতি নিয়ে তৈমুর লংকে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। তার ধারণা ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে চলমান পাহাড়ের মতো এসব প্রাণীকে তেড়ে আসতে দেখে লড়াইয়ের আগেই হয়তো হেরে বসে থাকবেন তৈমুর। কিন্তু তৈমুর লং ছিলেন একজন অতিশয় দক্ষ ও দুর্ধর্ষ সমরপতি। হাজারখানেক উটের পিঠে খড়ের স্তূপ চাপিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দিলেন তৈমুর। আগুনের গনগনে আঁচে সেসব উট উদ্ভ্রান্তের মতো আছড়ে পড়ল সেই হাতির পালের মধ্যে। আগুনের লেলিহান শিখা দেখে হাতিগুলোও ছুটতে লাগল দিগিবদিক। সুলতানের সৈন্যবাহিনীর বেশির ভাগই পদদলিত হলো নিজ হাতিবাহিনী দ্বারা। সে এক চরম মর্মান্তিক দৃশ্য। ঘরে পোষা হাতির কথা পাওয়া যায় হিন্দুদের প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্বেদে। এরও বহুপূর্বে মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা থেকে সিলমোহরে পাওয়া গেছে দড়িবাঁধা হাতির ছবি। হরপ্পার কিছু পোড়ামাটির খেলনায় মিলেছে হাতির মূর্তি। এশিয়ার শিল্পীদের হাতে বানানো নানান জিনিসের ভিতর পাওয়া গেছে হাতিও। এগুলো প্রাক-সিন্ধু সভ্যতার। সিন্ধু উপত্যকা থেকে পাওয়া জিনিসপত্র খ্রিস্টজন্মের তিন হাজার বছর আগের। আজ থেকে দু-তিন হাজার বছর আগে এশিয়াজুড়ে শুধু হাতি আর হাতি। মুদ্রায় হাতি, ছবিতে হাতি, ভাস্কর্যে হাতি, ধর্মে হাতি। প্রাচীন লোকগাথায় হাতি। রাজার উপাধি ‘গজপতি’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

ব্রিটিশ আমলে আমাদের প্রিয় শহর ঢাকাও ছিল হাতিময়। হাতির ঝিলে হাতিদের গোসল করানো হতো। হাতির পুল এলাকায় সে সময় একটি শক্তপোক্ত সাঁকো ছিল। সেই সাঁকো পার হয়ে এলিফ্যান্ট রোড (হাতির সড়ক) দিয়ে সব হাতি নিয়ে রাখা হতো পিলখানায়। (পিল অর্থও হাতি) সেসব হাতির দেখভাল করার জন্য মাহুতরা সাধারণত পুরান ঢাকার যে অঞ্চলটিতে থাকতেন তার নাম মাহুতটুলী। প্রখ্যাত কবি শামসুর রাহমানও জন্মেছিলেন এই মাহুতটুলীতে। অন্যদিকে সিরাজউদ্দৌলা যখন কলকাতা আক্রমণ করতে আসেন তখন তিনি তার হাতিগুলোকে যেখানে রেখেছিলেন সে স্থানের নাম ‘হাতিবাগান’। হাতির আরেকটি নাম হচ্ছে পিল। শুধু পিল বলে কথা নয় অভিধান ঘেঁটে দেখা যায় হাতির রয়েছে প্রায় অর্ধশত সমার্থক শব্দ। তার মধ্যে পিল, পীলু, ঐরাবত, গজ, দ্বিপ, দ্বিরদ এগুলো তো আছেই। এ ছাড়া হাতির একটি সমার্থক শব্দ দারুণভাবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হচ্ছে ‘নাগ’। আমরা সাধারণত জানি সাপের সমার্থক শব্দ হচ্ছে নাগ। কিন্তু হাতির সমার্থক শব্দ নাগ হয় কী করে! নিজের জ্ঞান ফলানোর জন্য বলছি না। বহুদিন আগে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র কবি ও প্রাবন্ধিক ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখিত একটি বইয়ে এ বিষয়ে পড়েছিলাম। বেশ কিছু বছর ধরেই বাংলাদেশের হাতি দিয়ে চলছে চাঁদাবাজি। হাতি দিয়ে চাঁদাবাজি শিরোনামে শুধু এ বছরই ডজনখানেকের মতো খবর ছেপেছে পত্রপত্রিকাগুলো। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত লিখেছে বাংলাদেশ প্রতিদিন। ৩ মার্চ ২০১৮ খবর ছেপেছে প্রথম আলো। এ ছাড়া যুগান্তর, সমকাল, পরিবর্তনসহ আরও অনেক পত্রিকা। এর পরও নেই কারও ভ্রুক্ষেপ। প্রশাসন ভাবলেশহীন ও নির্লিপ্ত। শুধু যে হাতি দিয়েই চাঁদাবাজি হচ্ছে তা কিন্তু নয়। আরও নানা ধরনের ও বৈচিত্র্যময় উৎপাত লক্ষ্য করা যায় শহরের অলিগলিতে, সড়ক ও প্রান্তরে। বেশ কয়েক বছর আগে বোধহয় পত্রিকাতেই পড়েছিলাম একশ্রেণির চাঁদাবাজের কথা তারা নাকি মানুষের বিষ্ঠা হাতে নিয়ে ঘুরত। নিরীহ পথচারী কিংবা যাত্রীরা টাকা না দিলে সেই পুরীষ ছিটিয়ে দেওয়ার হুমকি দিত সেই চাঁদাবাজরা। দু-তিন বছর আগে গুলশান-১ নম্বর ট্রাফিক সিগন্যালের আগে একদল বেদেনিকে দেখতাম ছোট ছোট কাঠের বাক্স নিয়ে ঘুরতে। রিকশা কিংবা গাড়িতে উপবিষ্ট যাত্রীদের প্রচ্ছন্নভাবে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা করত। একদিন আমি সিগন্যালের সামনে যানজটে বসে আছি রিকশায়। ঠিক সে সময় এক বেদেনি কাছে এসে কাঠের ছোট্ট একটি বাক্স আমার মুখের সামনে ঘোরাতে ঘোরাতে টাকা চাইল। আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল কাঠের ওই বাক্সের মধ্যে আদৌ কোনো বস্তু আছে কিনা! থাকলেও আমার ধারণা ওগুলো নির্বিষ ধরনের কোনো সাপটাপ হবে হয়তো। আমি আমার বাঁ-হাতটি ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, তোমার ওই সাপ দিয়ে বরং হাতে একটা ছোবল খাইয়ে যাও কিন্তু কোনো টাকা-পয়সা দিতে পারব না। আমি বললাম, তোমাকে দেখে তো যথেষ্ট কর্মঠ মানুষ বলেই মনে হচ্ছে। কাজ করে খাও না কেন! এমন একটি পরিস্থিতির জন্য বেদেনিটি মনে হয় মোটেও প্রস্তুত ছিল না। আমার কথা শুনে সে হনহন করে চলে গেল নতুন কোনো শিকারের খোঁজে। এ ছাড়া আছে হিজড়া ও স্বেচ্ছায় পতিত ভিক্ষুকের দল। তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষগুলোর অত্যাচারে সাধারণ মানুষ একেবারে অতিষ্ঠ। সরকারের কি কোনো দায়বদ্ধতা নেই অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীর প্রতি। প্রতিদিন শত শত ভিক্ষুক কোন সুড়ঙ্গ থেকে যে পিলপিল করে পিপীলিকার মতো বেরিয়ে আসে সে এক বিস্ময়। তারা কে, কোন জাতি, কোন সমাজের লোক কিংবা কেমন তাদের জীবনযাত্রা কখনই আমরা খতিয়ে দেখি না কিংবা দেখতে চাই না। অন্ধ, খঞ্জ, বিকলাঙ্গ, বিবিধ ব্যাধিগ্রস্ত, মেয়ে-পুরুষ ও বালক-বালিকার দল— সব বয়সের। কারও পরনে স্বল্পবসন, কারও শরীরে জীর্ণ কাপড়ের টুকরো, কোমরে জড়িয়ে রয়েছে ছেঁড়া ময়লা জামা, কারও চোখ নেশায় লাল, কারও মাথায় বন্যচুলের রাশ, কেউবা সর্বহারা। কারও কোলে কাঁকালে ঘুমের বড়িতে আচ্ছন্ন উলঙ্গ শিশু। যেসব মানুষ স্বেচ্ছায় বেছে নেয়নি ভিক্ষাবৃত্তি, হয়তো তাদের সত্যি সত্যি কোনো উপায়ান্তর নেই ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া জীবনধারণের। দেশের সাধারণ মানুষের দাবি— সরকারের কর্তাব্যক্তিদের জন্য দামি দামি গাড়িবাড়ি না কিনে আগে পুনর্বাসন করতে হবে রাষ্ট্রের অবহেলিত এই মানুষদের।

            লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

ইমেইল :  [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর