মঙ্গলবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

মানব হত্যা মহাপাপ

মুফতি মাওলানা মুহাম্মদ এহছানুল হক মোজাদ্দেদী

মানব হত্যা মহাপাপ

ইসলাম শান্তির ধর্ম। এ ধর্ম মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানব হত্যা কিংবা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করা ছাড়া অন্য কোনো কারণে যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করল, সে যেন পৃথিবীর সমস্ত মানুষকেই হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারও জীবন রক্ষা করল সে যেন পৃথিবীর সমস্ত মনুষের জীবনই রক্ষা করল।’ সূরা মায়েদা : ৩২। অন্যায়-ভাবে কোনো মুসলমানকে হত্যার পরিণাম নিশ্চিত জাহান্নাম। আল্লাহ বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি জেনে-বুঝে কোনো মোমিনকে হত্যা করে, তার শাস্তি হচ্ছে জাহান্নাম। সেখানে সে চিরকাল থাকবে। তার ওপর আল্লাহর ক্রোধ ও লানত বর্ষিত হতে থাকবে। আল্লাহ তার জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছেন।’ সূরা নিসা : ৯৩।

নিরীহ মানুষকে হত্যা করার চরমপন্থা গ্রহণ বা বাড়াবাড়ির অবকাশ ইসলামে নেই। দুনিয়ায় অহেতুক কারও প্রাণনাশ বা হত্যা করা সামাজিক অনাচার ও অত্যাচারের অন্তর্ভুক্ত। আল কোরআনে মানব হত্যাকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তোমরা তাকে হত্যা করো না।’ বনি ইসরাইল : ৩৩। একবার হজরত হামজা (রা.) রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমাকে এমন পথ বলে দিন যা আমাকে সুখী করবে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, মানুষের জীবন রক্ষা ও ধ্বংস করা— এ দুটির মধ্যে তুমি কোনটি পছন্দ কর? হামজা (রা.) বললেন, মানুষের জীবন রক্ষা করা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দুনিয়া ও আখেরাতে সুখী হওয়ার জন্য তুমি এ কাজই করতে থাকো। মুসনাদে আহমাদ।

যখন কেউ অন্যায় ও অবৈধভাবে মানুষ হত্যায় লিপ্ত হয় তার ওপর থেকে আল্লাহর রহমত ও বরকত উঠে যায়। নরহত্যা, বর্বরতা ও নাশকতার ফলে পৃথিবীর শান্তি বিনষ্ট হয় এবং ভূপৃষ্ঠে একের পর এক শাস্তি ও বিপর্যয় আপতিত হয়। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘একজন প্রকৃত মোমিন তার দীনের ব্যাপারে পূর্ণ প্রশান্ত থাকে, যে পর্যন্ত সে অবৈধ হত্যায় লিপ্ত না হয়।’ বুখারি।

পৃথিবীতে যত পাপ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কোনটি? একাধিক হাদিসে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সাতটি মহাপাপ থেকে বেঁচে থাকো। এর প্রথমটি হলো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক বা অংশীদার করা। আর তৃতীয়টি হলো অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা। বুখারি, মুসলিম। ইমাম কুরতুবি (রহ.) মুসনাদে বাজ্জারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘পৃথিবীর সব মানুষ একসঙ্গে যদি একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে আল্লাহ সব মানুষকেই জাহান্নামে দেবেন। এর পরও অন্যায়ভাবে হত্যাকে কখনো মেনে নেবেন না।’ ইমাম কুরতুবি আরেকটি হাদিস উল্লেখ করেছেন। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো মানুষ যদি আরেকজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যায় মুখের একটি কথা দিয়েও সাহায্য করে, তাহলে কিয়ামতের দিন তার কপালে লেখা থাকবে— এই ব্যক্তি আল্লাহর রহমত থেকে মাহরুম। আকদিয়াতুর রসুল (সা.)।

কিয়ামতের দিন মানুষ হত্যার বিচার করা হবে সবার আগে। তারপর অন্য অপরাধের। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে মোকদ্দমার ফয়সালা হবে, তা হলো রক্তপাত (হত্যা) সম্পর্কিত।’ বুখারি, মুসলিম। অন্য একটি হাদিসে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন নিহত ব্যক্তি হত্যাকারীকে নিয়ে আসবে। হত্যা-কারীর চুলের অগ্রভাগ ও মাথা নিহতের হাতের মুষ্ঠিতে থাকবে আর তার কণ্ঠনালি থেকে তখন রক্ত ঝরতে থাকবে। সে বলবে, হে আমার রব! এই ব্যক্তি আমাকে হত্যা করেছে। এমনকি সে তাকে আরশের কাছে নিয়ে যাবে।’ তিরমিজি, মুসনাদ আহমাদ।

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো মোমিন বান্দা যদি আল্লাহর কাছে এমন অবস্থায় হাজির হয় যে সে কারও রক্ত ঝরায়নি, অর্থাৎ কোনো হত্যাকাণ্ডে জড়ায়নি, তাহলে আল্লাহর দায়িত্ব হয়ে যায় তাকে ক্ষমা করে দেওয়া।’ মুসলিম।

ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড থেকে সমাজ ও দেশকে মুক্ত রাখতে হলে আমাদের সবাইকে আল্লাহর বিধান ও রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ মেনে চলতে হবে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি সব ধরনের অন্যায়, অবিচার ও যাবতীয় পাপাচার থেকে একনিষ্ঠভাবে তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে আসতে হবে। নিজেদের ও নিজেদের সন্তান তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুত্তাকি ও নবীপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমেই সম্ভব হানাহানি ও নৈরাজ্যমুক্ত দেশ উপহার দেওয়া। তবেই আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা আমাদের জান্নাতের দরজায় পৌঁছে দেবে। আসুন, আমরা সবাই কোরআন-সুন্নাহ মেনে চলি। জবান ও হাত থেকে সব মুসলমানকে ভালোবেসে নিরাপদে রাখি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।

 

লেখক : এমফিল গবেষক, মুফাসসিরে কোরআন, বেতার ও টিভির ইসলামবিষয়ক উপস্থাপক; খতিব, মণিপুর বাইতুর রওশন (মাইকওয়ালা) জামে মসজিদ

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর