বৃহস্পতিবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিশুদ্ধ গরু বিশুদ্ধ কোরবানি

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী

বিশুদ্ধ গরু বিশুদ্ধ কোরবানি

আর মাত্র পাঁচ দিন পর প্রায় সোয়া কোটি গবাদি পশু জবাই হয়ে কোটি কোটি ধনী-দরিদ্র মানুষের খাদ্য তালিকায় যুক্ত হবে। দরিদ্র মানুষের প্রোটিন ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে কোরবানি ঈদের অবদান অনন্য। কিন্তু গরুকে অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মোটাতাজা করে অনৈতিক মুনাফা অর্জনের নেশা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এক ভয়ানক চ্যালেঞ্জ। গ্রোথ হরমোন হিসেবে গরুর জন্য ব্যবহৃত স্টেরয়েডের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে অজ্ঞতা এর জন্য দায়ী। স্টেরয়েড হিসেবে যা গরুকে খাওয়ানো হয়, তা Human Drug, যেটি ডেক্সামিথাসন গ্রুপের। অথচ এটি জীবন্মৃত মানুষকে সচল করতে খাওয়ানো হয়। স্টেরয়েড গ্রুপভুক্ত ডাইকোফেনাক, ওরাডেক্সন, স্টেরন, ডেক্সাসন, এডাম কোরটান, কোরটিজল, হাইড্রো কোরটিজল ইত্যাদি এবং অতিরিক্ত ইউরিয়া ব্যবহার করে গরুকে দ্রুত অস্বাভাবিক মোটা করা হয়। বিশ্বায়নের বিষময় পরিণতিতে গরুর উৎপাদন ও বিপণন আজ করপোরেট অপরাধের শিকার। স্টেরয়েডের সরাসরি প্রভাবে গরুর পরিপাকতন্ত্রে সৃষ্ট ‘হাইপার অ্যাকটিভিটি’র ফলে তীব্র ক্ষুধা ও পিপাসা অনুভূত হওয়ার কারণে গরুর খাবারের চাহিদাও বেড়ে যায়। ফলে পরিপাকতন্ত্র অসহনীয় চাপে পড়ে অতিরিক্ত সঞ্চিত খাবার হজম না হয়ে গরুর কিডনিতে প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত পানি ও মূত্র অনিষ্কাশিত অবস্থায় শরীরে ছড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়, এতে শরীর ফুলে যায়। বিশেষজ্ঞ গবেষণায় দেখা গেছে, অতিমাত্রায় স্টেরয়েডযুক্ত গরু নিরাময়-অযোগ্য। স্টেরয়েড ব্যবহারে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের বৈজ্ঞানিক ফরমুলা ও নির্দেশনা প্রতিপালিত না হওয়ায় ডেইরি সেক্টর ঝুঁকির সম্মুখীন। এ সেক্টরে সুশাসনের শর্ত : গবাদি পশুর প্রতিষেধক মেয়াদোত্তীর্ণ কিনা, যথাযথভাবে সংরক্ষিত কিনা, গোখাদ্য সঠিক মানের কিনা, তা নিশ্চিত করা। কোনটি অপরাধ, কোনটি অপরাধ নয়, তার উপলব্ধির জন্য তিনটি বিষয় যেমন পর্যাপ্ত জ্ঞান, প্রশিক্ষণ ও আইনের অনুশাসন অপরিহার্য। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যত উন্নতি হচ্ছে, মানুষের তত নৈতিক অধঃপতন ঘটছে। তার প্রমাণ, মুনাফার লোভে বেপরোয়াভাবে স্টেরয়েডের ব্যবহার। ভাষাহীন, প্রতিবাদহীন ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা অবুঝ পশুগুলো এভাবে বিবেকহীন মানুষের কাছে অসহায়।

কৃত্রিমভাবে মোটাতাজাকৃত গরুর মাংস অবশ্যই দূষিত, যা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে হালাল নয়। কারণ কোরবানির মূল শর্ত সুস্থ ও সবল গরু। ফুডচেইনের অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় বিষযুক্ত মাংসের প্রভাব পড়ে মানুষের কিডনি, লিভার, হার্টসহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। গর্ভবতী মহিলার হরমোন ভারসাম্যও নষ্ট হয়। মানুষের শরীরের প্রাকৃতিক Immune Mechanism দূষিত খাদ্যে ধ্বংস হয়ে যায়। দীর্ঘ সময়ের রান্নাতেও এর বিষমাত্রা ধ্বংস হয় না। পুষ্টিগুণ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এ মাংস ফ্রিজে দীর্ঘদিন সঞ্চিত রেখে খাওয়া আত্মঘাতী বটে। কিন্তু জিবকে নিয়ন্ত্রণ করার মানসিক শক্তি আমরা হারিয়েছি। একদিকে বিষাক্ত মাংসে শরীর রোগাক্রান্ত হচ্ছে, অন্যদিকে চিকিৎসা ব্যয় অর্থনৈতিক ক্ষত বাড়াচ্ছে। আইনের অনুশাসন এবং সামাজিক সচেতনতাকে বক্তৃতায় সীমিত না রেখে বাস্তব প্রয়োগ ও অনুশীলন প্রয়োজন।

কোরবানির আগে মোবাইল কোর্ট, প্রাণিসম্পদ অধিদফতর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, পৌর কর্তৃপক্ষগুলোকে এখনই মিশন নিয়ে মাঠে নামতে হবে। মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯-এর ১০২ নম্বর তফসিলে ‘মৎস্য খাদ্য ও পশুখাদ্য আইন, ২০১০’-এ এটি অন্তর্ভুক্ত। এ আইনের ১২(১)(ক) ধারামতে মৎস্য বা পশুখাদ্যে মানুষ, পশু, মৎস্য বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পদার্থ থাকলে এবং একই আইনের ১২(১)(খ) ধারা অনুযায়ী ওই খাদ্যমান আদর্শ মানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে, তা অপরাধ। একই আইনের ১৪(১) ধারার মৎস্য ও পশুখাদ্য হিসেবে অ্যান্টিবায়োটিক, গ্রোথ হরমোন, স্টেরয়েড, কীটনাশকসহ অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার নিষিদ্ধ। এ ছাড়া জীবজন্তুর প্রতি নিষ্ঠুরতা আইন, ১৯২০ অনুযায়ী নিরাময়-অযোগ্য রোগাক্রান্ত পশু ধ্বংসে ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষমতাপ্রাপ্ত। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে জনস্বার্থে বার্ড ফ্লু সংক্রমিত লাখ লাখ মুরগি ধ্বংস করা হয়েছিল। যুক্তরাজ্যে ১৯৮৮ সালে ‘ম্যাডকাউ’ ডিজিজ উদ্ঘাটিত হলে বিপুলসংখ্যক গরু মেরে ফেলা হয়। অননুমোদিত স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ বিক্রি বন্ধে প্রতিটি জেলায় মোবাইল কোর্টকে মাঠে নামানোর জন্য সব জেলা প্রশাসককে আহ্বান জানাচ্ছি। স্টেরয়েডের অভিশাপ থেকে কোরবানির গরুকে মুক্ত করা প্রশাসনের আইনি ও নৈতিক দায়িত্ব। পাশাপাশি গরুর জেনেটিক মান উন্নত করা এবং বিদেশ থেকে উত্কৃষ্টমানের সিমেন আমদানি নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া সীমান্ত পথে বৈধ পশু আমদানিকালে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর, বিজিবি ও মোবাইল কোর্টের সাহায্যে কিট ব্যবহার করে রক্ত ও হরমোন পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া অভিযান অর্থহীন। স্যাটেলাইটে তোলা ছবি এখন ২০ মিনিটেই পাচ্ছে পৃথিবী, প্রযুক্তির পর্যবেক্ষণে যে কোনো বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া অত্যন্ত সহজ। সুতরাং প্রাণিসম্পদ অধিদফতরকে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। গরুতে স্টেরয়েড বা ক্ষতিকর ওষুধের উপস্থিতি প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার, কিট ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। অপরাধ প্রমাণ হলে শুধু জেল-জরিমানা নয়, ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ৫১৬ থেকে ৫২৫ ধারার আলোকে বিষাক্ত গরু জব্দ করে ধর্মীয় বিধি মোতাবেক জবাই করে তা নিরাপদ স্থানে পুঁতে ফেলতে হবে। ভেজাল খাদ্য ধ্বংসের মতো বিষাক্ত গরু ধ্বংস না করলে এ অপরাধ বন্ধ হবে না। কারণ জেল-জরিমানার সমান্তরালে অসাধু ব্যবসায় সম্পৃক্ত পণ্য জব্দ বা ধ্বংসের অর্থনৈতিক ক্ষতি এই হীন অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে সহায়ক। পাশাপাশি দীর্ঘদিনের শ্রম, ঘাম ও অর্থে লালিত পশু বাজারজাত করার জন্য সৎ খামারিদের প্রণোদনা দিতে হবে। নির্ভেজাল পশুখাদ্য নিরাপত্তার অপরিহার্য অনুষঙ্গ, সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে এর নির্দেশনা আছে। তবে কোরবানিতে সুস্থ, সবল গরু নিশ্চিত করা সরকারের একক কর্তব্য নয়। একশ্রেণির উচ্চাভিলাষী কোরবানিদাতা বিশালাকৃতির মোটাতাজা গরু কিনে কোরবানিকে ভোগের উৎসব এবং প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় পরিণত করছেন। ভোক্তারা সৎ ও সচেতন না হলে ঘরে ঘরে গিয়ে আইন প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। হৃষ্টপুষ্ট গরুতে কোরবানির সার্থকতা নয়, অসৎ উপার্জনের অর্থে কোরবানির শুদ্ধতা নয়। ক্রয়-বিক্রয়ে সততা, লেনদেনে শুদ্ধতা এবং জীবনাচরণে নৈতিকতা ছাড়া সব আয়োজনই বৃথা। অহংকার, অনাচার ও আত্মম্ভরিতা বর্জনই মহান স্রষ্টার নির্দেশিত কোরবানির শিক্ষা।

 

লেখক : মহাপরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশন

email : [email protected]

সর্বশেষ খবর