সোমবার, ১ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব এবং জাতীয় লজ্জা

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব এবং জাতীয় লজ্জা

একজন গর্বিত নাগরিকের সবচেয়ে বড় দায়িত্বের মধ্যে পড়ে জীবন দিয়ে হলেও নিজস্ব জাতিগত মর্যাদার জায়গাটিকে সমুন্নত রাখা এবং সম্মান করা। এর জন্যই আমরা বাঙালি জাতি মাথা উঁচু করে সারা বিশ্ব দরবারে গর্ব করি এই বলে যে, আমরা ৩০ লাখ মানুষের জীবন দিয়েছি, কিন্তু জাতির মর্যাদার সঙ্গে কোনো আপস করিনি। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে সিক্ত এই বাংলার মাটি, আকাশ, বাতাসের প্রতি সামান্য সম্মানবোধ ও কৃতজ্ঞতা থাকলে কোনো ব্যক্তি জাতীয় মর্যাদাকে ধুলায় মিশিয়ে নিজের ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের চিন্তা করতে পারে না। এই কথাগুলো যখন জোরের সঙ্গে বলছি তখন অজান্তে মনের ভিতর এ কথাও আসছে যে, এ দেশে তো মীর জাফর, জগৎ শেঠ ও খোন্দকার মোশতাকেরও জš§ হয়েছে। তাই যুগে যুগে এদের উত্তরসূরিরা আছে এবং থাকবে। তবে জাতীয় স্বার্থে এদের চেনা দরকার এবং এদের সম্পর্কে সতর্ক হওয়া উচিত। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়টি রাষ্ট্রের একান্ত নিজস্ব বিষয়। এটা নিয়ে বিদেশিদের কাছে যাওয়া এবং বিদেশিদের শালিসির জন্য ডেকে আনার থেকে লজ্জাকর আর কিছু জাতির জন্য থাকতে পারে না। এ বিষয়টি নিয়েই আজকে লিখতে হচ্ছে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর সব পত্রিকায় বড় খবর ছিল, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতিসংঘে গেছেন বাংলাদেশের রাজনীতির বিষয় নিয়ে নালিশ করার জন্য। ইতিহাস সাক্ষী, যুগে যুগে বাংলাদেশে তো বটেই বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশে বারবার প্রমাণ হয়েছে কোনো সরকার যদি জনবান্ধব না হয় এবং বৃহত্তর সাধারণ জনগণ যদি সেরকম মনে করে এবং ক্ষমতাসীন দলের বিকল্প হিসেবে বিরোধী দলের প্রতি জনগণের আস্থা থাকে তাহলে কোনোভাবেই ওই সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হয় না। আওয়ামী লীগ গত প্রায় ১০ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। এই সময়ে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং রাজনীতি, সব ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছে যা আগের কোনো সরকার করতে পারেনি এবং বিশ্বের খুব কম দেশই তা পেরেছে। এর স্বীকৃতি স্বরূপ বিশ্বব্যাংক থেকে শুরু করে খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ এবং বড় বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনের দৃষ্টান্ত এবং উন্নয়নের রোল মডেল। তারপরও একটানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে সরকারের বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনার জায়গাও আছে। অধিকন্তু ন্যায্য-অন্যায্য বিবেচনার তোয়াক্কা না করে সহজাত কারণেই সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে কিছু সংখ্যক মানুষ না পাওয়ার বেদনায় সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়। উইনস্টন চার্চিলকে বলা হয় গ্রেটেস্ট লিডার অব দ্য ওয়ার্ল্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটা পরাজয়মুখী ব্রিটিশ জাতিকে শুধু রক্ষা করেননি, যুদ্ধে হিটলারের বিরুদ্ধে জয় নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু দেখা গেল যুদ্ধ শেষের মাত্র এক-দেড় মাসের মাথায় জাতীয় নির্বাচনে চার্চিলের রক্ষণশীল দল হেরে গেল এবং ব্রিটেনে ক্ষমতায় চলে এলো লেবার পার্টি এবং প্রধানমন্ত্রী হলেন ক্লেমেন্ট অ্যাটলি। যুদ্ধজয়ের অভাবনীয় সাফল্য থাকলেও জনজীবনের নানা বিষয়ে মানুষ চার্চিল সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে চার্চিলের টোরি পার্টির পরবর্তীতে উপযুক্ত বিকল্প হিসেবে অ্যাটলির লেবার পার্টিকে বেছে নিয়েছিল। বাংলাদেশেও আজ এই কথাটি প্রযোজ্য হতে পারত যদি বিএনপি এতদিনে আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেত। কিন্তু বিএনপি তা পারেনি, চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপির মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী রাজনীতি, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে অস্বীকার, জাতির পিতাকে অস্বীকার ও অবমাননা এবং তারপর ২০০১-২০০৬ মেয়াদে ক্ষমতায় গিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানানো, সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষকতা, চরম দুর্নীতি, ভয়ানক অপশাসনের হাত ধরে রাজনীতিতে কৌশল নির্ধারণে একের পর এক চরম ভুল করে যে বিপর্যস্ত অবস্থায় আজ পড়েছে সেগুলোকে ঢাকা দেওয়ার জন্য অত্যন্ত অসম্মান ও লজ্জাজনকভাবে জাতিসংঘ এবং বিদেশিদের কাছে ধরনা দিচ্ছে, নালিশ করছে যাতে বিদেশিরা এসে বিএনপি যে রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে তার থেকে উদ্ধার করে দেয়। এহেন কাজ বিএনপির জন্য তো অবশ্যই, সমগ্র জাতির জন্য লজ্জাকর এবং কলঙ্কের কথা। শুধু তাই নয় নিজেদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশিদের ডেকে আনার ফলে অনেক জাতি তাদের স্বাধীনতা পর্যন্ত হারিয়েছে। বিএনপির কর্মকা- দেখে মনে হয় তারা পণ করেছে দেশ, রাষ্ট্র, স্বাধীনতা, জাতীয় মানসম্মান বড় কথা নয়, যে কোনো মূল্যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে নামাতে হবে। দলীয় অন্ধ সমর্থক ব্যতীত সাধারণ জনগণ তাদের সঙ্গে নেই, এটা বিএনপি বুঝতে পেরেছে বলেই এখন কা-জ্ঞানহীন আচরণ করছে। এটাকে বলা যায় রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের শেষ পরিণতি। বিএনপি সময়ের সঙ্গে তাল মিলাতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। ২০১৪ সালকে ১৯৯৬ ভেবে যে ট্রেন তারা মিস করেছে সে ট্রেন তো আর কোনো দিন ধরতে পারবে না। নির্বাচন প্রতিহতের নামে জ্বালাও পোড়াও এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ বিএনপিকে প্রান্তিক অবস্থানে নিয়ে গেছে। কানাডার একটি ফেডারেল কোর্ট বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। পত্রিকায় দেখলাম আমেরিকাতে কন্ট্রাক্টর বা ঠিকাদার (লোবিস্ট) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যারা বিদেশের মাটিতে বিএনপির রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে কাজ করবে। এগুলো নিজেদের সাংগঠনিক ক্ষমতার চরম দুর্বলতা এবং জনগণের ওপর আস্থাহীনতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। ড. কামাল হোসেন ও ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মতো জনবিচ্ছিন্ন ও সাংগঠনিক ক্ষমতাহীন ব্যক্তি ও দলের কাছে বিএনপির মতো একটি বড় দল যখন ধরনা দেয় তখন তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে। শুধুমাত্র দলীয় লোকদের দ্বারা ভোটে জয়ী হওয়া যায় না, আন্দোলনও করা যায় না। একথার সত্যতা বিগত কয়েক বছরে বিএনপি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। বিএনপির দুর্নীতিপরায়ণ নেতা-নেত্রীদের জেল থেকে বের করার জন্য জনগণ কী জন্য তাদের সঙ্গে আন্দোলনে নামবে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে বিএনপি এমন কোনো কাজ করতে পারেনি যাতে জনগণ মনে করবে বিএনপি ছাড়া তাদের আর গতি নেই। সুতরাং বিএনপি এখন খড়কুটো ধরে বাঁচার মতো জনগণ বিচ্ছিন্ন নেতাসর্বস্ব দলের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার অলীক স্বপ্নে বিদেশপানে ছুটছে যদি কিছু হয় সেই আশায়। ২০১৪ সালের মধ্যভাগে ভারতে যখন সরকার পরিবর্তন হয়ে বর্তমান বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এলো তখন বিএনপির আনন্দ, উল্লাস এবং মিষ্টি খাওয়া ও বিতরণের মহাযজ্ঞ দেখে সবাই মনে করেছিলেন এবার বোধহয় বিএনপির ভাগ্য খুলে গেল। হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসী বিজেপি সরকার এবার বাংলাদেশে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। কিন্তু ধন্য আশা কুহকিনি। বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েও বিএনপি দিল্লি­ দৌড়াচ্ছে কিসের আশায় তা বাংলাদেশের মানুষ বুঝতেও পারছে না। বাঙালি সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথ এবং সর্বোপরি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এই চারটি জায়গায় বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশের শেকড় প্রোথিত। এই শেকড়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন ও সংযোগহীন রাজনীতি করে বিএনপি এতদিন টিকে থাকলেও সংগত কারণেই এখন বিপর্যয়ের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত একটি কেবিনেট বৈঠক থেকে বের হওয়ার পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তখনকার অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বলেছিলেন, বাংলাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের কোনো অবদান নেই, তাই তার নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন আসে না। এখানেই শেষ নয়, আরও আছে। তখন ভৈরব সেতু উদ্বোধনের সময় সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সেতুর নামকরণে সৈয়দ নজরুল ইসলামের নামটি বাদ দেওয়া হলো কেন? সাইফুর রহমানের উত্তর ছিল, কোথাকার কোন নজরুল, আমি তো তাকে চিনি না। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী রাজনীতি এবং ষড়যন্ত্র ও অপকৌশলের পথ বেছে নিয়ে নিজেদের ভুল রাজনীতিরই খেসারত দিতে হচ্ছে বিএনপিকে। নিজেদের ভুল সংশোধন না করে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের দ্বারে দ্বারে ধরনা দেওয়া, জাতিসংঘে নালিশ জানানো, এগুলো রাষ্ট্র ও জাতির জন্য অপমানজনক। তবে এটাই যে প্রথম তা নয়, এর আগেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বিশ্বের সামনে বাংলাদেশকে ছোট করা হয়েছে। জাতির পিতাকে যারা হত্যা করল, সেই স্বঘোষিত খুনিদের বিচার করা যাবে না এই মর্মে আইন করা হলো এবং খুনিদের রাষ্ট্রীয় চাকরি দেওয়া হলো তা আবার কোথায়, বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে। বিশ্বের মানুষ কী ভাবল বাংলাদেশ সম্পর্কে। দুই সামরিক স্বৈরশাসক পর পর একটানা ১৫ বছর দেশ শাসন করল। এটাও বাংলাদেশের জন্য কম লজ্জার ছিল না। সিটিং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হলেন। তারপর জিয়ার গঠিত দল ক্ষমতায় থাকল ১০ বছর। জিয়ার পরিবার এত ক্ষমতাশালী হলেন, অথচ জিয়াউর রহমান হত্যার বিচার কেউ চাইল না। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীরা বাংলাদেশের ক্ষমতাধর মন্ত্রী হলেন। ২০১৩ সালে জামায়াত-শিবির জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে দিল, শহীদ মিনার ভেঙে দিল। বিএনপি তাদের সমর্থন দিল, জাতীয় পতাকা পোড়ানো ও শহীদ মিনার ভাঙার প্রতিবাদ করল না। এত লজ্জার কাহিনীকে পেরিয়ে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি দিল্লি­, লন্ডন, নিউইয়র্কে দৌড়াচ্ছে, প্রতিদিন ধরনা দিচ্ছে গুলশান-বারিধারায় বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের দুয়ারে। নিজেদের শক্তির ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে এবং দ- রহিত করার জন্য তখনো বিএনপি-জামায়াত পশ্চিমা বিশ্বে লবিস্ট নিয়োগ করেছিল। কাজ হয়নি। অতীত থেকে শিক্ষা না নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল নিজেদের দুর্বলতা ঘুচাতে যখন দেশের জনগণের কাছে নয়, বিদেশে গিয়ে ধরনা দেয় তখন শুধু ওই দলের নিজেদের দেউলিয়াত্বই প্রকাশ পায় না, দেশের মানুষকেও লজ্জায় ফেলে দেয়।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লে­ষক।

ই-মেইল :[email protected]

সর্বশেষ খবর