মঙ্গলবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

খালেদা-তারেকহীন বিএনপির কী হবে

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

খালেদা-তারেকহীন বিএনপির কী হবে

৬ নভেম্বর, ২০১৮ প্রায় সব বড় পত্রিকায় এই সময়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খবর ছাপা হয়েছে। খবরটি ছিল, বিএনপির নেতৃত্ব হারাচ্ছেন খালেদা জিয়া ও তারেক, আদালতের নির্দেশনা মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ইসির। এ বছরের শুরুর দিকে বিএনপি তড়িঘড়ি করে দলের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে। তাতে গঠনতন্ত্রের সপ্তম ধারার পরিবর্তন আনে। সংশোধিত নতুন ধারা অনুসারে দুর্নীতিসহ যে কোনো ক্রিমিনাল অপরাধে দন্ডিত ব্যক্তির জন্য দলের নেতৃত্বে থাকতে কোনো অসুবিধা হবে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এটা ভাবা যায় না। বিএনপি আজ যে গণতন্ত্র ও সুশাসনের কথা উচ্চৈঃস্বরে বলছে তার অবস্থা তাহলে কী দাঁড়ায় তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বিশ্বের অন্যতম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা উদাহরণ দিই। সম্প্রতি ফরাসি সংবাদ সংস্থা এএফপি পরিবেশিত এক খবরে দেখা যায়, আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে, কারণ তাদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল রেকর্ড ও শাস্তি রয়েছে। খালেদা জিয়া ও তারেক বিএনপির নেতৃত্বে থাকতে পারবেন না এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ এখনো বিএনপির রয়েছে। তাই এখনো শেষ কথা বলার সময় আসেনি। তবে হাই কোর্টের আদেশ আপিল বিভাগে গিয়ে বড় পরিবর্তনের উদাহরণ খুব বেশি নেই। তাই বিভিন্ন মহলে বলাবলি হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান নেতৃ-ত্ব থেকে মাইনাস হয়ে গেলে অবধারিতভাবে বিএনপিতে ভাঙন ধরবে। সে ভাঙন কত ভাগে হবে তা সঠিকভাবে এখন বলা না গেলেও কিছুটা তো অবশ্যই অনুমান করা যায়। তবে একটি কথা এখানে বলে রাখি, এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি যদি বিগত ৪০ বছর ধরে তাদের রাজনীতির মৌলিক ভুল ও নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণগুলো চিহ্নিত করে সময়ের চাহিদা মেটাতে দলের মৌলিক আদর্শের জায়গায় প্যারাডিম শিফট অর্থাৎ বড় পরিবর্তন এনে ভাঙন ঠেকিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে তাহলে সেটি বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য খুবই সুখবর হবে। তবে তা অত্যন্ত কঠিন ও প্রায় অসম্ভব কাজ। ভালো আশা করতে ক্ষতি নেই বলে কথাটি উল্লেখ করলাম। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতার অপ্রত্যাশিত ও মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের সিঁড়ি বেয়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্তৃক রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়া, নতুন রাজনৈতিক দল বিএনপি গঠন, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী মৌলিক নীতি গ্রহণ এবং এসবের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশকে যে পথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তা যে বুমেরাং যাত্রা ছিল সেটি প্রমাণিত হয়েছে তার নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে। প্রকৃতির নির্মম পরিহাস এবং বিএনপির রাজনীতির ভিতরে আদর্শের জায়গা কত দুর্বল ও ফাঁকা তা প্রমাণিত হয় একজন সিটিং রাষ্ট্রপতি নিহত হলেন অথচ তার বিচার এতদিনেও কেউ চাইল না, যদিও পরবর্তীতে বিএনপি ও জিয়ার পরিবারের সদস্যরা প্রবল প্রতাপের সঙ্গে দীর্ঘদিন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন। জিয়াউর রহমান কেন বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের সব গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এবং তার মাধ্যমে অর্জিত আধুনিক এবং প্রাসঙ্গিক সব আদর্শ ও দর্শনকে বিসর্জন দিয়ে প্রত্যাঘাত, পরাজিত, ধর্মাশ্রয়ী পাকিস্তানি তন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করলেন সে সম্পর্কে অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লে­ষণ আছে। কিন্তু এ প্রসঙ্গে বিএনপি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো বলে আসছে, বিএনপিও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল। এ সম্পর্কে উটপাখির মতো আচরণ না করে সময়ের চাহিদার সঙ্গে সাড়া দিলে এই সময়ে এসে এমন বিপর্যয়ের মুখে বিএনপিকে পড়তে হতো না। ২০১৮ সালে এসে বিএনপির সব ছদ্মবেশ উম্মোাচিত হয়ে গেছে। এর ফলে দেখা যাচ্ছে বেগম খালেদা জিয়ার দুর্নীতির দায়ে শাস্তি, ক্রিমিনাল অফেন্সে তারেকের যাবজ্জীবন কারাদ- প্রসঙ্গে বিএনপি যা বলছে তার কিছুই বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করছে না। আর বিশ্বাস করছে না বলেই এ ইস্যুতে আন্দোলন গড়ে তোলার শত চেষ্টা করেও বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে। দলীয় সমর্থক ও ক্যাডার বাহিনী যতই থাকুক সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা না থাকলে গণআন্দোলন হয় না তা আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে। মানুষ বুঝতে পেরেছে বিএনপির রাজনৈতিক চাহিদা ও ইস্যুর সঙ্গে জনমানুষের কল্যাণ ও স্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, দুর্নীতি ও ক্রিমিনাল অফেন্সের অভিযোগ এবং তা নিয়ে বিএনপি অনেক চেষ্টা করেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভিতর কোনো আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি। বিএনপি বলে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল। এ কথা বলে বটে, কিন্তু তারা নিজেরা এ কথা বিশ্বাস করে বলে মানুষ মনে করে না। এতে বোঝা যায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী রাজনীতি বাংলাদেশে অচল তা বুঝতে পারে বলেই একটা ছদ্মবেশ ধারণের চেষ্টা তারা করে আসছে। ছদ্মবেশের প্রধান অস্ত্র বা পোশাক হিসেবে তারা জিয়াউর রহমানকে ব্যবহার করে। কিন্তু জিয়া হত্যার বিচার চায় না। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বিচার করেনি। জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ও বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত। কিন্তু তিনি যেসব রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছেন, যে রাজনীতি বাংলাদেশে চালু করেছেন এবং বিএনপি এখনো যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে তাতে কি তাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল বলা যায়? যেমন, এক. একাত্তরের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে বিএনপি স্বীকার করে না, সম্মান দেখায় না এবং জাতির পিতাকেও তারা স্বীকার ও আনুষ্ঠানিক সম্মান দেখায় না। দুই. দীর্ঘ সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাহাত্তরের সংবিধানের অন্যতম মৌলিক আদর্শ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে জিয়াউর রহমান সামরিক আদেশ দ্বারা বাতিল করে দেন। বিএনপি এখনো সেই জায়গাই আছে। তিন. একাত্তরের মুজিবনগর সরকার, যাদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয় তাদের প্রতি বিএনপি কখনো আনুষ্ঠানিক সম্মান প্রদর্শন করে না। চার. পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের সংগ্রাম, যার বাঁকে বাঁকে সংঘটিত গৌরবোজ্জ্বল ঘটনাবলি যেমন, ৬ দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর মার্চে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন, যেগুলো অনাদিকাল ধরে নতুন প্রজম্মে র জন্য উৎসাহ সৃষ্টি, অনুপ্রেরণা দান ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার অফুরন্ত সম্পদ, এর প্রতি বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান তো দেখায়ই না, বরং এসব বিকৃত ও আড়াল করার চেষ্টা করে। আরও অনেক কর্মকা- রয়েছে যার মাধ্যমে বোঝা যায়, বিএনপি শুধু যে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী দল তাই নয়, গত ৪০ বছরে তাদের কর্মকা- দেখে মনে হয় এত ত্যাগ ও সংগ্রামের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত আদর্শ বিনষ্ট করার কাজ তো হতে পারে না, যা করেছে বিএনপি। সুতরাং মুখে তারা যা-ই বলুক, বাস্তবে সেগুলোর কোনো প্রতিফলন নেই। বিএনপি মুখে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের নাম করে যা বলছে, তা জনগণের সঙ্গে প্রহসন ও প্রতারণার শামিল। এ কারণেই সাধারণ মানুষ তাদের কোনো কথায় বিশ্বাস রাখতে পারছে না। বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের অস্তিত্ব নির্ভরশীল উপাদান বাঙালি সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শকে উপেক্ষা করে এতদিন টিকে থাকলেও ২০১৮ সালে এসে এখন তারা পথ খুঁজে পাচ্ছে না। যার কারণে দেখা যাচ্ছে বড় ভোটব্যাংকসম্পন্ন দল হয়েও বিএনপিকে আজ ধরনা দিতে হচ্ছে নিচ দলবহির্ভূত ভোটারহীন, জনসংযোগহীন নেতাদের ওপর। এই চরম দুর্দিনে যদি বিএনপি নেতাদের উপলব্ধি জাগ্রত হয় এবং মনেপ্রাণে প্রকাশ্যে তারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের রাজনীতিতে ফিরে এসে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে তাহলে সেটা তাদের জন্য এবং দেশের জন্যও ভালো হবে, যে কথা লেখার শুরুতেই বলেছি। তবে এটাকে সবাই দুরাশা বলছেন। যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে বিএনপি ভেঙে যাবে এমন আশঙ্কাই করছেন অনেক মানুষ। আর ভাঙা শুরু হলে দুই ভাগ নয়, আরও বেশি হতে পারে। তাতে হয়তো কট্টরপন্থি গ্রুপ বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার নামে জেনারেল জিয়ার লেগেসি বহন করার চেষ্টায় পুরনো অবস্থানে অটল থাকবে। এই গ্রুপ নির্বাচন বয়কট করতে পারে এই অজুহাতে যে, বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া কোনো নির্বাচন তারা করবেন না। ১/১১-এর সময় বিদ্রোহী গ্রুপ ব্যর্থ হওয়ার উদাহরণে এই গ্রুপ শক্তি সঞ্চয় করতে পারে। তবে ২০০৭-২০০৮ আর ২০১৮, ১০ বছরে অনেক পার্থক্য ঘটে গেছে।

অন্যদিকে ভাঙনের দ্বিতীয় গ্রুপটি, যারা দলে অপেক্ষাকৃত বড় হতে পারে, তারা নির্বাচনে অংশ নিয়ে মূল বিএনপি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু সমস্যা হবে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে। এটি নিয়ে আইনি লড়াই শুরু হতে পারে। তৃতীয়ত, কিছু নেতা অপেক্ষাকৃত ভালো কিছু প্রাপ্তির আশায় নির্বাচনমুখী অন্যান্য দলের সঙ্গে ভিড়ে যেতে পারে। এসব কথা বহুদিন থেকেই বাজারে আছে। এর সবকিছুই বিচার-বিশ্লে­ষণের কথা। আসলে কী হবে তা দেখার জন্য আর কয়েকটি দিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে অন্য যে বিষয়টি সম্পর্কে মানুষ প্রায় নিশ্চিত, তা হলো আলোচ্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট টিকবে না। ঐক্য টিকে থাকার মতো কোনো উপাদান তাদের মধ্যে নেই। তাদের একটি মাত্র কমন উপাদান শেখ হাসিনাবিদ্বেষ এবং তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত। আর অল্প কিছুদিনের মধ্যে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বুঝতে পারবেন এ যাত্রায় তাদের এই মিশন অর্জন হচ্ছে না। তখন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষায় ইঁদুর-দৌড় শুরু করবেন। তাতে কে কোথায় গিয়ে পড়বে তা দেখার বিষয় হবে। এমন হলে আগের অভ্যাসমতো ড. কামাল হোসেন রাগ করে বিদেশে চলে যাবেন। তবে নির্বাচন সঠিক সময়ই হবে। এটা বানচাল করার যে চেষ্টা কেউ কেউ করছেন তা সফল হবে না। আলোচ্য ঘটনাপ্রবাহের পরম্পরায় জিয়াউর রহমানের বিএনপি টিকে থাকবে কিনা তা নিয়ে এখন বাংলাদেশের মানুষের মনে প্রবল সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, বিশ্বের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, সামরিক স্বৈরশাসকের সৃষ্ট রাজনৈতিক দল শেষ পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী দল হতে পারেনি, টিকে থাকতে পারেনি।

 

            লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর