রবিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মিরাকল ট্রি, সুপার ফুড শজনে

শাইখ সিরাজ

মিরাকল ট্রি, সুপার ফুড শজনে

‘সজনে ডাঁটায়

ভরে গেছে গাছটা,

আর, আমি ডালের বড়ি

শুকিয়ে রেখেছি

খোকা তুই কবে আসবি!

কবে ছুটি?’

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘মাগো, ওরা বলে’ কবিতায় বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটি অংশ ধরা দেয়। খাদ্যাভ্যাস কিংবা বাংলার মানুষের খাদ্য উপকরণগুলো সম্পর্কে বেশ একটা ধারণা পাওয়া যায়। কুমড়ো ফুলের বড়া, শজনে ডাঁটার ঝোল কিংবা ডালের বড়ির তরকারি সন্তানের ভাতের থালায় তুলে দিতে পারলে একসময় বাংলার মায়েরা সুখ অনুভব করতেন। আমাদের খাদ্যাভ্যাস অনেকখানি বদলে গেছে। তার পরও শর্ষে ইলিশ, শজনে ডাঁটার ঝোল বা ডালের বড়ির তরকারির রসনা এখনো আমাদের ডুবিয়ে রাখে ঐতিহ্যের তৃপ্তিতে। আর তাই এগুলোর বাজারমূল্যও রয়েছে। এখন শজনের মৌসুম নয়, গত মৌসুমের শুরুতেও ঢাকায় শজনের কেজি ছিল ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। ভর মৌসুমেও দর থাকে ৪০-৫০ টাকা প্রতি কেজি। তার মানে, বাজারে শজনের বেশ চাহিদা আছে।

শজনের বৈজ্ঞানিক নাম Moringa oleifera. ইংরেজিতে মরিঙ্গা বা ড্রাম স্টিক নামেই পরিচিত। ধারণা করা হয়, Morunga শব্দটি এসেছে দ্রাবিড় ভাষার Morunga শব্দ থেকে। দক্ষিণ ভারতীয়রা এখনো এ নামেই চেনে। Morunga শব্দের অর্থ Generic Root। ড্রেক্সেল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ববি পসমন্তিয়েরের he Medicinal Qualities of Moringa Oleifera শিরোনামে দীর্ঘ একটা আর্টিক্যাল পড়েছিলাম। তাতে শজনের আদ্যোপান্তই উঠে এসেছে।

ইতিহাস বলে, মহর্ষি সুশ্রুত রচিত চিকিৎসাবিষয়ক প্রাচীন পুস্তক ‘সুশ্রুত সংহতি’তে ঔষধি ৭০০ ভেষজ উদ্ভিদের মধ্যে শজনের উল্লেখ আছে। শজনে গাছ, শজনে আর শজনে পাতা নিয়ে চলছে নানামুখী গবেষণা। পুষ্টিগুণের বিবেচনায় শজনেকে বলা হচ্ছে Miracle Tree বা ‘অলৌকিক গাছ’। প্রাচীনকাল থেকেই শজনে পাতার নানামুখী ব্যবহার প্রচলিত। আজকের আধুনিক বিজ্ঞানও এর গুণাগুণ নিয়ে বলছে সে কথাই। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ভাষ্য, শজনে পাতায় কমলার চেয়ে তিন গুণ বেশি ভিটামিন সি, দুধের চেয়ে চার গুণ বেশি ক্যালসিয়াম ও দ্বিগুণ আমিষ, গাজরের চেয়ে চার গুণ বেশি ভিটামিন এ, কলার চেয়ে তিন গুণ বেশি পটাশিয়াম রয়েছে। তাই একে বলা হচ্ছে সুপার ফুড। এটি ভিটামিন, প্রোটিন ও অ্যামাইনো অ্যাসিড, বিটা ক্যারোটিনসহ বহু রকমের খনিজ উপাদানের এক অনন্য উৎস। শজনে এমন এক বৃক্ষ, যার প্রতিটি অংশেই রয়েছে বিস্ময়কর রকমের পুষ্টিগুণ। একইভাবে শজনে বা শজনের বীজ খাদ্য হিসেবে অতুলনীয়। শজনে বীজ থেকে যদি তেল করা হয়, তাতেও রয়েছে অসাধারণ পুষ্টি উপাদান।  আমাদের দেশেও শজনে নিয়ে চলছে নানা কর্মকা-। এর মাঝে খবর পেলাম চুয়াডাঙ্গার সফল কলা চাষি, আমাদের কলা কাদের শজনে নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন সামাজিক অভিযান। এর আগে কলা চাষে তার সাফল্য তুলে ধরেছিলাম ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে। তাই তার শজনে অভিযান দেখতে একদিন সদলবলে ছুটলাম চুয়াডাঙ্গায় কৃষক আবদুল কাদেরের বাড়িতে। শীতের আগমনী সময়। কেবল আড়মোড়া ভেঙে সকালের আলো ফুটেছে। আমাদের সঙ্গে ছিলেন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা তালহা জুবাইর মাসরুর। শজনে নিয়ে কথা হচ্ছিল। শজনে ডাঁটার অনেক প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্যে এক প্রজাতি বছরে দুই থেকে তিনবার বাজারে পাওয়া যায় তার নাম রাইখঞ্জন। আছে বারোমাসি শজনের জাতও। শজনে গাছ তৈরি করতে চারা রোপণ করতে হয় না। যে কোনো পতিত জমিতে, পুকুরপাড়ে, রাস্তায় বা বাড়ির আঙিনায় অথবা যে কোনো ফাঁকা জায়গায় গাছের ডাল পুঁতে রাখলেই প্রাকৃতিকভাবে ধীরে ধীরে এর ডালপালা বেড়ে গাছ বড় হতে থাকে। তাই শজনে চাষে খরচ নেই বললেই চলে। বড় মাঝারি একেকটি গাছে ৯-১০ মণ পর্যন্ত শজনে পাওয়া যায়। বিনা খরচ ও পরিশ্রমে অধিক আয় পেতে অনেকেই বাণিজ্যিকভাবে শজনে চাষের জন্য আগ্রহী হয়ে শজনে গাছের বাগান করছেন। কৃষক আবদুল কাদেরের বাড়িতে যখন পৌঁছলাম তখন সকালের সূর্য মিষ্টি রোদ ছড়াচ্ছিল। নদীর তীরে ছোট্ট ছিমছাম গোছানো এক কৃষকের বাড়ি। আঙিনায় ডালিম, কলা, পেয়ারাসহ নানান ফলের গাছ। তাকে নিয়ে বের হলাম তার শজনে অভিযান দেখতে। গ্রামটি সবুজে ছাওয়া এবং কৃ-ষি খেতগুলো নানারকম ফল-ফসলে সমৃদ্ধ। মাঠে মাঠে আগাম শীতের ফসল। বাড়িগুলোতেও বিভিন্ন সবজি ও ফলের গাছ। পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই শজনে গাছ আছে। কথা বলছিলাম বিভিন্ন কৃষক ও কৃষাণীর সঙ্গে। তারা শজনে চাষে বেশ সচেতন। এ থেকে পাচ্ছেন বাড়তি আয়।

এখন পৃথিবীর অনেক দেশেই শজনে গাছের বাণিজ্যিক আবাদ হচ্ছে। বিশেষ করে সাউথ আফ্রিকা, মালাউই, কম্বোডিয়া, ফিলিপিন্স, কেনিয়া, ইথিওপিয়াসহ এশিয়ার বেশকিছু দেশে শজনের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। পাতা সংগ্রহের জন্যই গড়া হয়েছে বিশাল এলাকা নিয়ে শজনের বাগান। যেখান থেকে প্রতিদিন সংগ্রহ করা হয় শজনের পাতা। বেশ কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে শজনের পাতা থেকে বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনায় তৈরি করা হয় সবুজ ট্যাবলেট। ইউরোপ, আমেরিকায় এ ট্যাবলেটের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। অ্যামাজন বা আলিবাবার মতো অনলাইন মার্কেট থেকে সারা পৃথিবীর মানুষ কিনতে পারছে শজনে পাতার ট্যাবলেট। ১০০ ট্যাবলেটের একটা ফাইল বিক্রি হয় ১৫ থেকে ২৫ ডলার করে, অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা।

বাংলাদেশের এক তরুণ উদ্যোক্তাও কাজ করছেন শজনে পাতা নিয়ে। রাজীব পারভেজ নামের তরুণ সেই উদ্যোক্তার সঙ্গেও কথা হয় আমার। শজনে পাতা নিয়ে তিনি স্বপ্ন বুনছেন। সে পথে হেঁটেছেনও অনেকখানি। শজনে পাতা থেকে তৈরি চা ও পাউডার বিক্রি করছেন তিনি। রাজীব বলছেন, স্বাস্থ্য উপকারী বলে শজনে পাতার তৈরি চা ও পাউডারের চাহিদাও বাড়ছে দিন দিন। শজনে পাতার চা খেলে ভালো ঘুম হয়। শজনে পাতার চায়ে কোনো ক্যাফেইন নেই। তাই যাদের ঘুমের সমস্যা তারা এ চা পান করে উপকার পাবেন বলে জানালেন রাজীব। তিনি আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বললেন, গবাদিপশুকে শজনে পাতা খাওয়ালে দানাদার খাবার আর দিতে হয় না। ১০টি জেলায় শজনে পাতা নিয়ে দারুণ এক সম্ভাবনার জাল বুনেছেন রাজীব পারভেজ। তিনি কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছেন শজনে চাষে। পাশাপাশি শজনে পাতার চা, পাউডার ও ট্যাবলেটের বাজার তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

বিজ্ঞানের এ যুগে কোনো কিছুর গুণাগুণ বের করা খুব কঠিন বিষয় নয়। বিস্ময়কর পুষ্টির আধার শজনে হতে পারে চমৎকার এক কৃষিপণ্য। সুপার ফুড হিসেবে এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। আমাদের ওষুধ কোম্পানিগুলো সাপ্লিøমেন্টারি ফুড তৈরিতে শজনেকে বিবেচনায় আনতে পারে। তাহলে কৃষকও পাবে নতুন এক অর্থকরী ফসল; যা তাকে নিজের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি সমৃদ্ধ করবে অর্থনৈতিকভাবেও। এ ক্ষেত্রে সরকারি, অসরকারি সংশ্লি­ষ্টরা পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে এলে শজনে হতে পারে সমৃদ্ধির নতুন সম্ভাবনা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর