শুক্রবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

পথহারা পথিক! কে কোথায় বিলীন...

মনজুরুল আহসান বুলবুল

পথহারা পথিক! কে কোথায় বিলীন...

ছেলেবেলায় আমাদের সবজান্তা পন্ডিত বানানোর চেষ্টা ছিল। এই সর্ববিষয়ের একটা ছিল বাংলাদেশের নদী। কোন নদীর কোথায় জম্ম , কীভাবে পথচলা এবং শেষে কোথায় বিলীন। এ বিষয়গুলো পড়তে হতো ভবিষ্যতে নদী বিশেষজ্ঞ হব এজন্য নয়, দেশকে জানার জন্য। এখনো মনে পড়ে, বাংলাদেশের বৃহত্তম নদ ব্রহ্মপুত্র হিমালয়ের কৈলাস শৃঙ্গের মানসসরোবরে জম্ম  নেয়। উৎপত্তিস্থলে এর নাম সাংপো, কোথাও নাম লৌহিত্য, কোথাও কংশ। এ নদ বাংলাদেশে প্রবেশ করে কুড়িগ্রামের ভিতর দিয়ে। নদটি জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে যমুনা ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নামে বিভক্ত হয়েছে। ময়মনসিংহের ভিতর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের পুরাতন প্রবাহ বিলীন হয়েছে ভৈরবের কাছে মেঘনায় পতিত হয়ে। ভূমিকম্পের কারণে ১৭৮৭ সালে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের স্রোত পরিবর্তন হয়ে যমুনা নদী হয়। ব্রহ্মপুত্রের উপ নদ-নদী হচ্ছে ধবলা ও দুধকুমার। নদীর এ উৎপত্তি, প্রবাহরেখা বদল, কোথাও নতুন পরিচয়ে প্রবহমান থাকা আবার কোথাও নিজের পরিচয় বিলীন করে ইতিহাস হয়ে যাওয়া খুবই কৌতূহলোদ্দীপক।

নদী বিশেষজ্ঞ নই; এ নিয়ে কাউকে জ্ঞান দেওয়ার ধৃষ্টতাও নেই বা বঙ্কিমের সাহিত্য পাঠ নিয়েও কারও সঙ্গে সাহিত্যরস বা দর্শনের বিতর্কে যাওয়াও লক্ষ্য নয়। তবে হালফিল রাজনীতিতে পরিচিত পথিকদের পথ বদল দেখে বার বার যেন জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হয় ‘পথিক! তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’ তেমনি সেই ছোটবেলায় পড়া নদীর গতিপথ অনুসরণ করে পর্যবেক্ষণ করি, কে কোথায় কীভাবে বিলীন হচ্ছেন।

এত গৌরচন্দ্রিকা করতে হলো আমাদের হালের রাজনীতির নানা সমীকরণ দেখে। রাজনীতিবিদরা যখন অঙ্ক কষেন নিশ্চয়ই তাদের নানা হিসাব-নিকাশ থাকে। তার কতকটা দৃশ্যমান; কতকটা অদৃশ্য। কিন্তু রাজনীতির সাধারণ পর্যবেক্ষকরা বিভ্রান্তিতে পড়েন এসব প্রকাশ্য সমীকরণ দেখে। এই মানুষদের মাথায় অসংখ্য প্রশ্ন, কিন্তু মেলে না জবাব। বিভ্রান্তি আরও বাড়ে, যখন যখন প্রশ্নগুলো হয় সহজ, উত্তরটাও থাকে জানা। কিন্তু যাদের ব্যাখ্যা দেওয়ার কথা তারা যখন কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেন না।

রাজনীতিতে আদর্শ, নৈতিকতা, ত্যাগ, জনগণবহুল উচ্চারিত বিষয়। আদর্শিক কারণে দলে বিভক্তি বা বিভক্ত দুই অংশের পাল্টাপাল্টি আদর্শচ্যুতির বাহাসও আমরা কম প্রত্যক্ষ করিনি। তরুণ সাংবাদিক হিসেবে যখন রাজনীতিকে ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করতে শুরু করি, তখন চোখের সামনে দেশের প্রগতিশীল দল ন্যাপ ভাঙছে। কেন এই ভাঙন তা ব্যাখ্যা করতে বিশাল একটি ছাপানো দলিল বিতরণ করা হচ্ছিল। খুবই আগ্রহভরে সেই পুরো দলিল পড়ে ন্যাপ ভাঙার আদর্শিক কোনো কারণ খুঁজে পাইনি। কেবল একটাই কথা; দলে এক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে একনায়কতন্ত্রের অভিযোগ। শেষ পর্যন্ত ন্যাপ ভাঙল। ন্যাপের সলতেটি নিভু নিভু করে জ্বলছে এখনো। ভিন্ন নামে একটি অংশ বড় দলের সঙ্গে জোট করে কিছুটা দৃশ্যমান। আবার এ ভাঙন প্রক্রিয়ার অনেক নেতা আওয়ামী লীগে বিলীন। এসবই হয়েছে আদর্শের নামে, এমনটিই ব্যাখ্যা।

তবে বাংলাদেশের বা এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে ডিগবাজি নতুন কোনো বিষয় নয়। এ ব্যক্তিগত ডিগবাজির সঙ্গে আদর্শ, নৈতিকতার কোনোই সম্পর্ক নেই, আছে কেবলই প্রাপ্তিযোগ। মাত্র কয়েকদিন আগে সংলাপের সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আনুষ্ঠানিকভাবেই কয়েকজনকে নাম ধরেই তাদের নানা সময়ের ডিগবাজি নিয়ে তির্যক হাস্যরস করেন। যাদের সম্পর্কে তিনি বলেন, তারাও যে জোরালোভাবে এর প্রতিবাদ করতে পেরেছেন তেমনটি জানা যায়নি। বরং একজন তো সব হজম করে, লজ্জার মাথা খেয়ে তার অবৈধ মালিকানার বাড়িটি ফেরত পাওয়ার তদবির করেন। আখেরে সেই প্রাপ্তির প্রত্যাশাই একমাত্র সত্যি! কেন জানি মনে হয়, সেই বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আরেকটি মজাদার ডিগবাজির সার্কাস জাতিকে উপহার দিতে পারতেন। কিন্তু অতি ডিগবাজিতে বিবর্ণ এই রাজনীতিক বোধহয় বুঝতে পেরেছেন, রাজনীতিতে তার মূল্যও এখন পড়তির দিকে।

রাজনীতিতে আদর্শ, নৈতিকতা, ত্যাগ, জনগণ এসবকে ভিত্তি ধরে দেশে এখনো কিছু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দল জোট নিজেদের পরিচয় ধরে রেখেছে। কিন্তু তারা এতটাই ক্ষুদ্র যে দেশের গণভিত্তিক রাজনীতিতে তাদের প্রভাব  ভালো ভালো কথা ছাড়া কোনো সূচক দিয়েই পরিমাপ করা মুশকিল।

কেউ পছন্দ করুন বা না-ই করুন বাংলাদেশের রাজনীতি বড় দাগে দুই ধারায় প্রবহমান। গত ৪৭ বছরে এ চিত্রটি এতটাই স্পষ্ট যে, বিষয়টি বোঝার জন্য খুব বড় গবেষণার দরকার পড়ে না। নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেও বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারা আর এই চেতনাবিরোধী মানচিত্রটি খুবই দৃঢ়ভাবে দৃশ্যমান। আবার এ দুই ধারার আকর্ষণী শক্তিও প্রবল। অনেক উজ্জ্বল অতীতের রাজনীতিক এ দুই ধারার মধ্যে যেমন বিলীন হয়ে গেছেন, তেমনি এ দুই ধারাকে অবলম্বন করেই কোনো কোনো ক্ষুদ্রগোষ্ঠী নিজেদের পরিচয় কিছুটা বাঁচিয়ে রেখেছেন। এ দুই ধারার ধারণ করার শক্তিও অসীম। এরা কখন যে কাকে আত্মস্থ করে ফেলে সেটাও দেখার বিষয়।

এর মধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা মহল নানা সময়ই হুঙ্কার দেয়, এ দুই ধারার বাইরে গিয়ে তৃতীয় শক্তি গড়ে তোলার জন্য। তৃতীয় শক্তি বলতে একসময় সেনাবাহিনীর কথা বলা হলেও বৈশ্বিক পট পরিবর্তনে কেবল পাকিস্তানের মতো অসভ্য দেশ ছাড়া, সভ্য বিশ্বের কোনো দেশেই সেনাবহিনী রাষ্ট্র পরিচালনায় আগ্রহবোধ করে না। নৈতিকভাবেও এ ব্যবস্থাকে গ্রহণযোগ্য মনে করে না। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু হাল আমলে সৎ মানুষ, সৎ রাজনীতি, সৎভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অধিকারের কথা বলে জীর্ণ পুরাতনকে বাদ দিয়ে নতুন ধারার কথা বলে মাঠে নামেন অনেকে। দুশ্চিন্তার কারণ, এদের অনেকেই মাঠে নামেন নানা নেপথ্য শক্তির প্রেরণায়, নিজের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নয়। সেই যে কবির ভাষায় : মিছিলের সব হাত, কণ্ঠ, পা এক নয়। সেখানে সংসারী থাকে, সংসারবিরাগী থাকে; কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার। কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার।

এটি খুবই ভালো হতো যদি দেশে এমন রাজনীতি থাকত যাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭১, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ, জাতির হাজার বছর ধরে প্রবহমানতার ইতিহাস নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকবে না। বিতর্ক থাকবে না বাংলা নামে দেশটির প্রতিষ্ঠার দর্শন নিয়ে। বহুমত থাকবে বা বিতর্ক হবে দেশের অগ্রযাত্রার সব বিষয় নিয়ে। ধর্মীয় পরিচয় রাজনীতিকে সংকীর্ণ গন্ডিতে আবদ্ধ করে রাখবে না। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের রাজনীতি প্রবাহিত হয়েছে বহুরৈখিক পথে। কাজেই যখন কেউ বলেন তারা সৎ মানুষ, সৎ রাজনীতি, সৎভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করবেন, তখন সাধারণ মানুষ একটু ঘাড় বাঁকা করে তাকায়; আশাবাদী হতে চায়, কিন্তু দ্রুতই তারা হতাশ হয়।  সেই হতাশায় আবার নিমজ্জিত হলো গোটা জাতি। দেশের মানুষ বুঝে নিল যারা ভালো কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা করলেন চূড়ান্ত বিচারে তারাও আসলে দেশ বা জনগণের জন্য নয়, তারা মাঠে নেমেছেন নিজেদের সংসার সাজাতেই। সৎ মানুষ, সৎ রাজনীতি, সৎভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অধিকারের বিষয়গুলো শুধুই ফাঁকা বুলি। দেশের রাজনীতিতে সর্বশেষ যে চমকগুলো দেখছি মুখোশ যাই থাকুক, তা অনেকের আসল চেহারা ফাঁস করে দিচ্ছে।

বারাক ওবামা যখন প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসেন তখন তাত্ত্বিক ও বিশ্লে­ষক তারিক আলী একটি বই লিখেছিলেন, ‘ওবামা সিনড্রোম : সারেন্ডার এট হোম, ওয়ার এব্রড’। বইটির প্রচ্ছদটি ছিল খুব চমৎকার। কৃষ্ণাঙ্গ ওবামার ছবি, কিন্তু মুখের চামড়াটি তুলতেই দেখা যায় ভিতরে ওবামার শ্বেতাঙ্গ রূপটি বের হয়ে আসছে। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে তিনি যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, তার ক্ষমতায় আসায় বিশেষত ‘কালারড’ জনগোষ্ঠী যতটা আশান্বিত হয়েছিল, ততটাই দ্রুত তারা হতাশ হন এ কারণে যে, ওবামা তার মেয়াদে যা যা করেছেন তার সঙ্গে আগের শ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্টদের কার্যক্রমে খুব বেশি ফারাক নেই। আমাদের রাজনীতিতেও যাদের এতদিন দেখলাম এমন একটি মুখোশ নিয়ে তারা মাঠে নামলেন। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু নিয়ে মুখে ফেনা তুলতে তুলতে তারা শেষ পর্যন্ত বিলীন হলেন ভিন্ন স্রোতে।

খোলাসা করেই বলি, ড. কামাল হোসেন ও তার সহযোগীরা একদা বলতেন ধানের শীষ সন্ত্রাসীদের প্রতীক, তারা বলতেন জামায়াতের সঙ্গে বেহেশতে যেতেও তারা রাজি নন। সেই তারাই দেখি আজ সবাই ধানের শীষে বিলীন। ধানের শীষ পেতে নিবন্ধনহীন, যুদ্ধাপরাধীদের দল যেভাবে মরিয়া; তেমনি মরিয়া ‘একদা মুক্তিযোদ্ধারা’। জাতির বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা সর্বকালের জন্যই স্মরণীয়, বরণীয় থাকবেন। কিন্তু জীবনের মাঝপথে কেউ যদি পথ হারান; তাহলে মানুষ তো বিভ্রান্ত হবেই। একাত্তরের রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধার নাম যদি আজ দেখি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকারদের নামের সঙ্গে ধানের শীষের তালিকায়. গায়ে মুজিবকোট মুখে জয় বাংলার কাউকে যদি দেখা যায় জিন্দাবাদের পতাকা হাতে পথ চলতে, তাহলে সাধারণ মানুষ তো প্রশ্ন তুলতেই পারে আসলে এদের মূল আদর্শিক অবস্থান কী? মুক্তিযুদ্ধ, জয় বাংলা নাকি চানতারা, জিন্দাবাদ?

একজন মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারী নানা কারণে হতাশ হতে পারেন। অসম্মানবোধও করতে পারেন। তার বা তাদের অভিমানকে গুরুত্ব না দেওয়ার জন্য অভিযোগ থাকতেই পারে, কিন্তু তাই বলে তো কেউ ভিন্ন পথের পথিক হতে পারেন না। তিনি কেন যথাযথ মূল্যায়ন পাচ্ছেন না সে প্রশ্নের জবাব পাওয়ার জন্য তাকাতে হবে নিজের দিকেও। নিজের কৃতকর্মের মধ্যে এমনকি কোনো সমস্যা আছে, যেজন্য তার মূল্যায়ন হচ্ছে না? প্রকৃত আদর্শের অনুসারী হলে নানা কারণে অভিমান হবে কিন্তু বিদ্রোহী হওয়ার সুযোগ নেই। নিজের ঘরের সমস্যার জন্য অন্যের বাড়িতে বিচার চাইতে যাওয়াটা কোনো যুক্তির কথা নয়। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজনীতিতে যা ঘটে চলেছে তাতে কে যে কোথায় বিলীন হচ্ছেন তার হিসাব রাখাই মুশকিল। কোথায় জম্ম , কীভাবে উত্থান, কী উজ্জ্বল প্রবাহ আর কোথায় বিলীন; এ হিসাব বুঝি পথহারা পাখিরাও রাখতে পারছে না। শুধুই একটা আসন? শুধুই একটা প্রতীক? শুধুই মন্ত্রী হওয়া, গদিতে বসা? এই যদি সত্যি হয় তাহলে এত আদর্শের কথা কেন বলা! জনগণের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য এত মাতম কি শুধুই লোক দেখানো! রাজনীতিতে সুস্থ ধারার কথা কি শুধুই গালভরা বুলি!

যে পথিকরা নতুন পথ বেছে নিয়েছেন, তার পক্ষে নিশ্চয়ই একেকজন একেকটা যুক্তি দাঁড় করাবেন। কিন্তু এ দেশের রাজনীতির কয়েক দশকের একজন ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক হিসেবে বলি; এই পথহারা পাখিরা আখেরে কোথাও নিজের নীড় তৈরি করতে পারেননি। নবাব সিরাজউদ্দৌলা সিনেমার সেই গানের মতোই বলি; আপাত কিছু চমক দেখালেও শেষ পর্যন্ত এই পথহারা পাখিরা ‘কেঁদে ফিরে একা...’।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর