সকল প্রশংসা আল্লাহ রব্বুল আলামিনের, যিনি হজরত আদম ও হাওয়া আলাইহিস সালামকে বানিয়েছেন যুগলরূপে, লাখো-কোটি দরুদ ও সালাম মানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর, যিনি জাহেলি সমাজের হিংস্রতা থেকে নারীকে দিয়েছেন মুক্তির পয়গাম, তার কপালে পরিয়েছেন সম্মানের রাজটিকা। তার হৃদয়ে জুগিয়েছেন আশার আলা, যে আলোয় সে ইসলামের প্রথম শহীদ, অসংখ্য হাদিসের মুহাদ্দিস, জান্নাতের রমণীদের সরদার ও আরও অসংখ্য মর্যাদায় সমাসীন হয়েছেন। সালাতু সালাম তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কিরাম ও সব মুমিনের ওপর।
নারী ও পুরুষের যৌথ উদ্যোগেই স্থাপিত হয়েছে মানবীয় সমাজের ভিত। সমাজ গঠনে এ দুটি অংশই একটি অন্যটির অনিবার্য পরিপূরক। যেমন পুরুষকে বাদ দিয়ে কোনো মানবীয় সমাজ কল্পনা করা যায় না, তেমন নারীকে বাদ দিয়েও পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায় না কোনো মানবীয় সমাজের। মানবসমাজে এ দুয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক যতক্ষণ না সঠিক ভিত্তির ওপর স্থাপিত হবে এবং পরস্পরের সঠিক মর্যাদা ও অধিকার তারা প্রাপ্ত হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো সমাজব্যবস্থাই দুনিয়ার বুকে সুন্দর ও কল্যাণকররূপে গড়ে উঠতে পারে না।
সমাজে নারীর অবস্থান যখন ছিল অমানবিক এবং অতি করুণ তখন থেকেই ইসলাম নারীর অধিকার ও মর্যাদা উন্নয়নের জন্য নজিরবিহীন পদক্ষেপ নিয়েছে। সেসব পদক্ষেপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- নারী সম্মানিত সৃষ্টি : ১. ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ অতীব সম্মানিত ও সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি।’ সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৭০। ২. ইমান ও আমলই নারী-পুরুষের মর্যাদা নির্ণয়ের সঠিক মাপকাঠি। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের সফলতা ও ব্যর্থতা সুস্থ চিন্তা ও সঠিক কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইসলাম পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছে, মর্যাদা, লাঞ্ছনা এবং মহত্ত্ব ও নীচতার মাপকাঠি হলো তাকওয়া বা পরহেজগারি এবং চরিত্র ও নৈতিকতা। এ মাপকাঠিতে যে যতটা খাঁটি প্রমাণিত হবে আল্লাহর কাছে সে ততটাই সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হবে। আল্লাহ বলেন, ‘পুরুষ বা নারীর মধ্য থেকে যে-ই ভালো কাজ করল সে ইমানদার হলে আমি তাকে একটি পবিত্র জীবন যাপন করার সুযোগ দেব এবং তারা যে কাজ করছিল আমি তাদের তার উত্তম পারিশ্রমিক দান করব।’ সূরা আন নাহল, আয়াত ৯৭।আল্লাহ আরও বলেন, ‘তাদের রব তাদের দোয়া কবুল করলেন এই মর্মে যে, পুরুষ হোক বা নারী হোক তোমাদের কোনো আমলকারীর আমল আমি নষ্ট করব না।’ সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৯৫।
এই নির্যাতিত শ্রেণিটির বেঁচে থাকার অধিকার পর্যন্ত ছিল না। আল কোরআন বলল, না, তারাও জীবিত থাকবে এবং যে ব্যক্তিই তার অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে, আল্লাহর কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। আর যখন জীবন্ত প্রোথিত কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল? সূরা আত তাকভির, আয়াত ৮-৯।
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি তিনটি কন্যাসন্তান লালন-পালন করেছে, তাদের উত্তম আচরণ শিখিয়েছে, বিয়ে দিয়েছে এবং তাদের সঙ্গে সদয় আচরণ করেছে সে জান্নাত লাভ করবে।’ আবু দাউদ। নারীদের প্রতি কোমল ব্যবহারের গুরুত্ব প্রকাশ করছে কোরআনের নিম্নোক্ত নির্দেশ, ‘আর নারীদের সঙ্গে সদয় আচরণ কর।’ সূরা আন নিসা, আয়াত ১৯। একসময় রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীরা উটের পিঠে সফর করছিলেন। স্ত্রীদের কাচের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বললেন, ‘কাচগুলোকে (স্ত্রীদের) একটু দেখে শুনে যত্নের সঙ্গে নিয়ে যাও।’ মুসলিম। ইসলামী শরিয়াতের সীমার মধ্যে থেকে অর্থনৈতিক ব্যাপারে শ্রম-সাধনা করার অনুমতি রয়েছে নারী-পুরুষ সবার। ইসলাম নারীকে যেসব অধিকার দিয়েছে অনেক সময় সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেকেই তাদের অধীনস্থ নারীকে তা থেকে বঞ্চিত করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে নারীর ধর্মীয় অনুশাসন মানার ক্ষেত্রেও অনেক অন্তরায় সৃষ্টি করা হয়। যেমন নারীকে তার হিজাব পরিধানের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান হিজাব পরিধান নিষিদ্ধ করে। ইসলাম নারীর মানমর্যাদা ও ইজ্জত-আব্রু হেফাজতের ব্যবস্থাই শুধু করেনি, বরং নারী যাতে কোনোক্রমেই দৈহিক কিংবা মানসিকভাবে অত্যাচারিত ও নির্যাতিত না হয় সে রকম দিকনির্দেশনা দিয়েছে এবং তদনুযায়ী নিয়ম-পদ্ধতি ও বিধান জারি করেছে। নিচে তার একটি ছোট্ট বিবরণ দেওয়া হলো। ১. ইসলাম নারীর সার্বিক নিরাপত্তাবিধান করেছে। রাস্তায়, কর্মস্থলে ও যত্রতত্র নারীদের হয়রানি করা দূরের কথা বরং ইসলাম নারীদের সৌন্দর্যের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে অবনত রাখার নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনদের বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থান হেফাজত করে। এটা তাদের জন্য পবিত্রতম।’ সূরা আন নুর, আয়াত ৩০। ইসলামের সোনালি যুগে দেখা যায়, নারীরা সুদূর বাগদাদ থেকে মক্কা নগরীতে একাকী গমন করলেও তাদের কেউ উত্ত্যক্ত করত না। কেননা এ রকম নিরাপত্তাই ইসলামী সমাজে প্রত্যাশিত। যারা নারীদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি, ইসলাম তাদের তাজিরমূলক শাস্তি দেওয়ার পথ খোলা রেখেছে। আর কেউ যেন নারীকে হয়রানি না করে বরং বোনের দৃষ্টিতে দেখে সেজন্য পুরুষকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নারী পুরুষের সহোদরা।’ আবু দাউদ।