সোমবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

রাহুলের ঐতিহাসিক ডেকচি ভরা খেয়ালি পোলাউ

এম জে আকবর

রাহুলের ঐতিহাসিক ডেকচি ভরা খেয়ালি পোলাউ

মায়াময় আরব্য রজনীর ভাবনায় আমরা প্রধানত দেখি জিন, মণিমুক্তা আর রহস্যময়ী নর্তকী যারা সাত পরত ওড়নার ভিতর দিয়ে সুলতানের পানে তাকায়। তবে অনুষঙ্গ দিয়ে ধ্রুপদ কিছু গড়া যায় না। এটা গড়ে তোলে সারগর্ভ ব্যঞ্জনা। আরব্য রজনীর সে ধরনের কাহিনিগুলোর একটির নাম ‘বার্মাকি ভোজন’।

‘বার্মাকি’ শব্দের উৎপত্তি এই সম্প্রদায়ের আদিপুরুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী খালিদ ইবনে বার্মাক থেকে। আরবরা দখল করে নেওয়ার আগে বল্খ নগরীতে বাস করতেন তিনি। গুণীজন হিসেবে সুপরিচিত খালিদ ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর তাঁকে সরকারি সুউচ্চ পদে বসানো হয়। তার ছেলে ইয়াহিয়া ইবনে খালিদ আর খলিফা হারুন-অর রশিদের মধ্যে ছিল প্রগাঢ় দোস্তি। কালক্রমে বার্মাকি গোষ্ঠীর প্রতিপত্তি এতটাই বেড়েছিল যে ধারণা করা হতো, আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের খলিফাদের চেয়েও এদের ঐশ্বর্য বেশি।

গল্পে আছে, ধনপতি এক বার্মাকি তার প্রাসাদে কাঙ্গালিভোজের আয়োজন করেন। গরিব লোকগুলোকে ডেকে এনে বাহারি কার্পেটে বসানো হয়। তাদের মাঝখানে বসলেন বর্ণাঢ্য পোশাক পরা সেই আমন্ত্রণকর্তা। করতালি দিয়ে পরিচারকদের ডাকলেন তিনি। হুকুম দিলেন, ‘খানা বিলাও’। ভৃত্যরা বড় বড় থালা হাতে এগিয়ে এসে মনিবকে জানান, ‘প্রথম পেশ করছি মজাদার কাবাব’। থালায় কিন্তু কিছুই নেই। মনিব ভান করলেন, একটা কাবাব তিনি থালা থেকে তুলে মুখে পুরেছেন। চিবানোর ভান করে তিনি বলে উঠলেন, ‘আহ্! কী সুস্বাদু!’ হতভম্ব, অসহায় মেহমানরা এতই হীনবল যে প্রতিবাদ জানানোরও সাহস নেই। তারাও গৃহকর্তার মতোই গ্রাসের ভান করে আর রান্নার প্রশংসায় একে অন্যকে হারানোর কাজে মেতে ওঠে। পোলাউ খাওয়ার ভান করা পর্যন্ত এই অবস্থা চলে। ভোজনশেষের কৃত্রিম তৃপ্তির ঢেকুর তোলাও বাকি থাকল না।

যাদের খুবই খাদ্যাভাব, তাদের স্বাদু খাবার খাওয়ানোর মোহজালে আটকিয়ে রেখে কষ্ট দেওয়ার এই ঘটনা হাজার বছরেরও বেশিকাল ধরে জনস্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে রয়েছে। ভারতে এ ধরনের প্রবঞ্চনার নাম ‘খেয়ালি পোলাউ’।

২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের ইশতেহার প্রকাশের সময় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে রাহুল গান্ধী খেয়ালি পোলাউর যে ডেকচি দেখালেন তা ইতিহাসের বৃহত্তম। তিনি বলেছেন, ‘তাঁর দল ক্ষমতায় গেলে সব দুস্থকে (যারা দেশের জনসংখ্যার ২০ শতাংশ) মাসে মাসে ছয় হাজার রুপি দেবে। তালিকা কীভাবে করা হবে অথবা এত টাকা কোথা থেকে আসবে, তা তিনি বললেন না। মোহজাল ছড়ানোটা বোঝা গেল। প্রশ্ন করা হয়েছিল, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে তো ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি রুপি লাগবে। এই তহবিল জোগাড় করা হবে কীভাবে? জবাবে রাহুল বলেন, এ বিষয়ে পরে বিশদ জানানো হবে। প্রকল্প বর্ণনার সময় না জানিয়ে এর আর্থিক বিশদ পরে জানানো হবে কেন? একাধিক কারণ থাকতে পারে। প্রকল্পের জন্য কেউ একজন সংখ্যা-ভিত্তিক নানাবিধ হিসাব কষে রেখেছে, আর রাহুল গান্ধী ওই গণিত বোঝেন না, এটা বিশ্বাস না করলে মানতেই হবে যে, প্রশ্নটির যৌক্তিক কোনো জবাব নেই।

যুক্তি বলছে, জনগণকে মোহগ্রস্ত করতে কংগ্রেস যে রঙিন বেলুন ছেড়েছে তা ফুটো হয়ে যাক, এটা দলটি চায় না। তাই প্রকল্পের বাস্তবতা নিয়ে আলোচনায় তাদের আগ্রহ নেই। রাহুল সম্ভবত মনে করেন যে, তিনি বার্মিকি ভোজ দিয়ে পার পেয়ে যাবেন, যেমনটি তিনি পেরেছিলেন সাম্প্রতিক তিনটি বিধানসভা নির্বাচনে। ওই সময় তিনি অঙ্গীকার করেন, কৃষিঋণ মওকুফ করে দেবেন। মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে ভাগ্যগুণে মোটামুটি জয় পায় কংগ্রেস। জয়ের পর পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। কর্ণাটক রাজ্য সরকার এ পর্যন্ত কৃষিঋণ মওকুফ করে মাত্র তিন হাজার কোটি রুপি। যতটা মওকুফের অঙ্গীকার করা হয়েছিল, এই অঙ্ক তার তুলনায় অনেক কম। মধ্যপ্রদেশে মওকুফ করা হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি রুপি, এটাও প্রতিশ্রুত অঙ্কের ক্ষুদ্রাংশ। ক্ষমতায় বসার ছয় মাসেরও কম সময়ে এই রাজ্যে নতুন সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ যে বাড়ছে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। রাহুল গণিতচর্চা না করলেও অন্যরা তো করেন। যারা করেন তারা দেখতে পাচ্ছেন, রাহুলের খেয়ালি পোলাউ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারতে আর্থিক ঘাটতির চলতি হার ৩ দশমিক ১৪ শতাংশ থেকে বাড়তে বাড়তে ৬ শতাংশ বা ৭ শতাংশে পৌঁছবে। গ্রামীণ ও শহুরে জনগোষ্ঠীর কল্যাণে যে ভর্তুকি দেওয়া হয় তা বন্ধ করতে অথবা ছেঁটে ফেলতে হবে। দায়িত্বজ্ঞানহীন শাসক মুদ্রাস্ফীতি ডেকে আনে। রাহুলের প্রতিশ্রুত দুস্থ কল্যাণ প্রকল্প চালু করা হলে মুদ্রাস্ফীতির প্রাবল্যের ফলে কল্যাণের ব্যাপারটি দ্রুতগতিতে কমতে থাকবে। ২০ মার্চ ‘ব্লুমবার্গ’ এক রিপোর্টে বলেছে, এশিয়ায় ভারতীয় রুপি এখন বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠছে। জুনের মধ্যে ডলারের দর ৬৭ রুপিতে নেমে আসবে। আসন্ন নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির বিজয় ঘটবে বাজারের এই আভাসের প্রভাবে বিদেশ থেকে ভারতে ৫০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ এসেছে। ভারতীয় ভোটাররা কখনই বোকামি করেন না। খেয়ালের বশে নয়, তারা তাদের মনস্থির করেন জীবনের কঠিন-কঠোর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। খেয়ালি পোলাউর মিথ্যে হাতছানি নয়, ভোটাররা চান নতুন ভারতের বিশ্বাসযোগ্য দিগন্ত।

 

            লেখক : ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও উপমহাদেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর