মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

‘নির্বাচনেই যদি দুর্নীতি হয়, তবে নির্বাচননির্ভর গণতন্ত্র হয় প্রতারণা’

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

‘নির্বাচনেই যদি দুর্নীতি হয়, তবে নির্বাচননির্ভর গণতন্ত্র হয় প্রতারণা’

২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ সদ্যসমাপ্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ঠিক ছয় বছর আগে থাইল্যান্ডে একটি সাধারণ নির্বাচন হয়। বিভিন্ন কারণে এ নির্বাচনটি নানাবিধ বিতর্কের জন্ম দেয়। এ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল বিরোধী ডেমোক্র্যাট পার্টি। গোলযোগের কারণে ৩৭৫টি নির্বাচনী এলাকার ৬৯টিতেই ভোট প্রদান বন্ধ থাকে। একপর্যায়ে আদালত এ নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করে। এমনই এক প্রেক্ষাপটে থাইল্যান্ডের একজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক লিখেছিলেন ‘নির্বাচনেই যদি দুর্নীতি হয়, তবে নির্বাচননির্ভর গণতন্ত্র হয় প্রতারণা’- এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখার আগে নির্বাচনের আরও কিছু তথ্য তুলে ধরতে চাই। ২০১৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের রাজধানী দিল্লির বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৬৭.৪৭ শতাংশ। দিল্লি বিধানসভার ৭০টি আসনের মধ্যে ৬৭টি পেয়ে দিল্লির মসনদে বসে রাজনীতিতে নবাগত আম আদমি পার্টি আর মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এককালের ট্যাক্স কর্মকর্তা ৪৭ বছর বয়সী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। দুই বছর পর একই দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয় ‘মিউনিসিপ্যাল অব দিল্লি’ নির্বাচন। এ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন ৫৩-৫৮ শতাংশ ভোটার। আর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। ইভিএম ব্যবহৃত এ নির্বাচনে কারিগরি কারচুপির অভিযোগ তোলেন কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টির নেতারা। ২০১৬ সালের ৫ মে ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয় মেয়র নির্বাচন। এ নির্বাচনে ভোট পড়ে ৪৫.৩ শতাংশ। এ নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে প্রদত্ত ভোটের ৪৪.২ আর দ্বিতীয় রাউন্ডে ৫৬.৮ শতাংশ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ৪৬ বছর বয়সী ব্রিটিশ মুসলমান সাদিক আমান খান।

২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জার্মানির রাজধানী বার্লিনের মেয়র নির্বাচিত হন জার্মানির তৎকালীন ক্ষমতাসীন জোট ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব জার্মানির প্রার্থী মাইকেল মুলার। এ নির্বাচনে ৬৬.৯ শতাংশ ভোটার ভোটের মাধ্যমে বার্লিন নগরের নতুন মেয়র নির্বাচন করেন।

২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর মেয়র নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল মাত্র ৩০.৯১ শতাংশ। এ নির্বাচনে রাশিয়ার একসময়ের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ীসহ বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদকে পেছনে ফেলে মোট প্রদত্ত ভোটের ৭০.১৭ শতাংশ পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী সার্জিয় সিমাইয়ো নোভিচ সোবাইয়া নিন। তিনি প্রথম মেয়াদে ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মস্কোয় মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তৃতীয়বারের মতো মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এককালের নগণ্য মেকানিক এবং প্রশাসনের নিম্নশ্রেণির কর্মচারী এই সার্জিয় সোবাইয়া নিন। ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বাংলাদেশের রাজধানীর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের সিটি নির্বাচন। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে ৩০ শতাংশের কম ভোটার কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে তাদের আগামী দিনের নগরপিতা নির্বাচন করেছেন। এ পর্যন্ত দেশ-বিদেশের ভোটার উপস্থিতি -সংক্রান্ত সব তথ্যই ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত। সুতরাং বাংলাদেশের রাজধানীর ভোটের এ চিত্র ইন্টারনেটের মাধ্যমে যে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে বা ছড়িয়ে পড়বে তা সহজেই অনুমান করা যায়। বিশ্ব যখন উন্নয়নের রোল মডেল খ্যাত বাংলাদেশের সচেতন এবং শিক্ষিত নাগরিকের আবাস ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের মেয়র নির্বাচনের এ তথ্য দেখবে তখন অনেকেই হয়তো উন্নয়ন, গণতন্ত্র, নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে নতুন অঙ্ক কষবে।

ইংরেজিতে অ্যাপাথি বলে একটি শব্দ আছে যার সহজ বাংলা অর্থ অনীহা, অনাগ্রহ, উদাসীনতা ইত্যাদি। রাজনীতিবিজ্ঞানের ছাত্রদের কাছে অ্যাপাথি বা অনীহা একটি পরিচিত শব্দ। আশির দশকে রাজনীতিবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়ার সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়েছিলাম ভোটার অ্যাপাথি (ভোটদানে অনীহা) ও পলিটিক্যাল অ্যাপাথি (রাজনীতিতে অনীহা)-সংক্রান্ত অধ্যায়গুলো। বলা বাহুল্য, আশির দশকের বাস্তবতায় এ অধ্যায়গুলো ছিল প্রাসঙ্গিক এবং বেশ প্রণোদনাপূর্ণ। মাঝে কেটে গেছে অনেক বছর। জাতীয় পার্টি, বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক এবং আওয়ামী লীগের হাতে চার দশক পাড়ি দিয়েছে বাংলাদেশ। পরিবর্তন অনেক হয়েছে। গাণিতিক হিসাবে দেশের উন্নতিও ঈর্ষণীয়। তবে মাঝে মাঝে কোথায় যেন হোঁচট খেতে হয় যখন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ জীবন আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের রাজনীতিপ্রিয় মানুষ ভোট কিংবা রাজনীতিবিমুখ হয়।

সত্যিই কি বাংলাদেশের মানুষ ভোট ও রাজনীতিবিমুখ? প্রাচীনকালে বর্গীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, অত্যাচারী জমিদারের বিরুদ্ধাচরণ, ব্রিটিশ শাসকের অবসান, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদবিরোধী আন্দোলন, তথাকথিত ১/১১ এসব কিছুই প্রমাণ করে এ দেশের মানুষ ভোট কিংবা রাজনীতিবিমুখ নয়, বরং ভোট এ দেশে উৎসবের আবহ তৈরি করে। আর পাড়া-মহল্লায় চায়ের দোকানেও চলে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। বাসে, লঞ্চে এবং চায়ের দোকানের মালিকরা একসময় বিরক্ত হয়ে ‘রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ’ কথাটি লিখে রাখতেন দৃশ্যমান স্থানে। এমনই একটি দেশে মোট ভোটের প্রায় ১৫ শতাংশ পেয়ে মেয়র নির্বাচন মেনে নেওয়া কঠিন। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ঢাকা উত্তরের মোট ৩০,১২,৫০৯ জন ভোটারের মধ্যে ৪,৪৭,২২১ জন মেয়র আতিকুল ইসলামকে ভোট দিয়েছেন, শতকরা হিসাবে যা মোট ভোটের ১৪.৮৪ শতাংশ। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণের ২৪,৫৩,১৫৯ জন ভোটারের মধ্যে মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস পেয়েছেন ৪,২৪,৫৯৫ ভোট, যা শতকরা হিসাবে মোট ভোটের ১৭.৩০ শতাংশ। মোট প্রদত্ত ভোটের সিংহভাগ পাওয়ার কৃতিত্ব উভয় প্রার্থী, তাদের সমর্থক ও দলীয় নেতারা দাবি করতেই পারেন। কিন্তু যে নিন্দুকেরা বলে বেড়ায় ঢাকায় এ দুই প্রার্থীর সমর্থক ১৫ শতাংশ তাদের মুখ বন্ধ করা সহজ নয়। দুই প্রার্থীও হয়তো মনের অজান্তে হলেও অস্বস্তিবোধ করছেন। যেহেতু দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হয়েছে, সেহেতু এ দুই প্রার্থীর দলীয় সমর্থক, কর্মী বা নেতাদের কতজন ভোট দিয়েছেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে, নির্বাচনের আগে যারা এই নির্বাচিত মেয়রদের নিয়ে বড় বড় শোডাউন করেছেন, শুধু তাদের ভোটই ১৫ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা। বাস্তবে তা হয়নি। অন্যদিকে বাধাবিপত্তি মাঝে মাঝে ঘটলেও মোটা দাগে বলা যায়, বিএনপি বিগত কয়েক বছরের মধ্যে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি প্রকাশের সবচেয়ে বড় সুযোগ কাজে লাগিয়েছে সিটি নির্বাচনের প্রাক্কালে। বিভিন্ন স্থানে বিএনপির শোডাউন ছিল ছোখে পড়ার মতো। তাহলে ঢাকা দক্ষিণে তাদের প্রার্থী তরুণ প্রকৌশলী, সাবেক মেয়র ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ইশরাক হোসেন কেন ২,৩৬,৫১২ ভোট, যা মোট ভোটের মাত্র ৮.৫৫ শতাংশ পেলেন, তা ভাবার বিষয়। অন্যদিকে ঢাকা উত্তরে রাজনীতির নেপথ্যে থাকা প্রভাবশালী ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টুর তরুণ পুত্র ও বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক তাবিথ আউয়ালের ভাগ্যেই বা কেন মাত্র ২,৬৪,১৬১ ভোট, যা শতকরা হিসাবে মোট ভোটের ৮.৭ শতাংশ জুটল তা নিয়েও গবেষণা করতে হবে। বিশেষত যারা ভাবেন বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের বিশেষ সখ্য আছে এবং যারা বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গত্যাগের নসিহত করেন, তাদেরও ভাবা উচিত নির্বাচনে কি তবে জামায়াত ঘরে বসে ছিল? কেননা রাজধানীতে শুধু জামায়াতের নীরব ভোটব্যাংকেই তো এর চেয়ে বেশি ভোট আছে বলে দাবি করেন স্বয়ং জামায়াতের নেতারা। উইকিপিডিয়া তাত্ত্বিক বিচার এবং অভিধানে ভোটার অ্যাপাথি বা ‘ভোটারদের মাঝে অনীহা’, বলতে এক ধরনের বিশেষ মানসিক অবস্থাকে বোঝায়, যার ফলে ভোটাররা নির্বাচন নিয়ে উন্নাসিকতা, নির্লিপ্ততা, অনাগ্রহ ও বিরূপ মনোভাব অনুভব করেন। এ অ্যাপাথি বা অনীহার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হলো নির্বাচনে অনুপস্থিত থাকা বা কেন্দ্রে কমসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি। তাই তত্ত্বমতে, বিপরীতমুখী সম্পর্ক রয়েছে এ দুটি বিষয়ে। অর্থাৎ ভোটারদের অনীহা যত বেশি হবে, ভোট তত কমবে। আর অনীহা কমলে ভোট বাড়বে। সংজ্ঞা ও ফলাফল নিয়ে কোনো বিতর্ক না থাকলেও বিতর্ক রয়েছে এই অনীহার কারণ নিয়ে। ২০১৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর চলতি ঘটনাভিত্তিক ব্রিটিশ অনলাইন পোর্টাল রাকনটিউর ভোটারদের ভোট না দেওয়ার নেপথ্যে পাঁচটি কারণ খুঁজে পায়। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে নিছক অনিচ্ছা। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় হলো, ইন্টারনেটের বিস্তার যত বেড়েছে, ভোট প্রদানে অনীহাও তত বেড়েছে। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে জ্ঞান ও উপলব্ধির অভাব। একটি নির্বাচন বা নির্বাচিত প্রতিনিধি একজন ভোটারের জীবনে কী পরিবর্তন আনতে পারেনÑ এ বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও উপলব্ধি না থাকলে ভোট প্রদানের তার কোনো উৎসাহ থাকে না। তৃতীয় কারণ ছিল মোহমুক্তি। ভোটাররা যখন উপলব্ধি করেন, ভোটের আগে বলা কথাগুলো বরাবরের মতো ভোটের পরে মূল্যহীন হয়ে যাবে, প্রতিশ্রুতি পূরণ হবে না এবং দৃশ্যত কোনো পরিবর্তন হবে না, তখন কেন্দ্রে যাওয়া না যাওয়া সমার্থক হয়ে যায়। চতুর্থ কারণটি বেশ চমকপ্রদ। এ ক্ষেত্রে অনাগ্রহী ভোটারদের আখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘সেইফ সিট রেসিডেন্টস’ হিসেবে। তাদের বদ্ধ ধারণা যে, তাদের ভোট প্রদান দৃশ্যত মূল্যহীন। কেননা যা তারা ধরে নিয়েছে তা ঘটবেই, এ ক্ষেত্রে সে কাকে ভোট দিল, তাতে কিছু আসে যায় না। বিশেষত ক্ষমতাসীন দল বা ব্যক্তি যদি পরম পরাক্রমশালী হয় এবং ভোটের ফলাফল তাদের বা তার পক্ষে যাবে মর্মে যদি বদ্ধমূল ধারণা জন্মায়, তবে ভোটাররা আর ভোট প্রদানে উৎসাহ পায় না। সর্বশেষ কারণটি হলো ইচ্ছা থাকলেও বিভিন্ন কারণে ভোট দিতে বাধাগ্রস্ত বা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হওয়া।

এবার ঢাকার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যায় নির্বাচনের দিন ভোট প্রদান নয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের মতামত প্রকাশে ব্যস্ত ছিল একশ্রেণির নাগরিক ভোটার। ইন্টারনেটই তাদের এ সুযোগ করে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, দেখা যায় একজন নতুন ভোটারও তার জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়ার পর অন্তত তিনজন মেয়র দেখেছে। দৃশ্যত কোনো পরিবর্তন কি পাড়া-মহল্লা পর্যায়ে পড়েছে? এক. প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের অভাব অনুভব করে সবাই। কিন্তু তার কাছাকাছি ভাবমূর্তি নিয়ে কেউ কি সামনে এসেছেন? সুতরাং ভোটার যখন ধরে নেয় ভোট দিলে বা না দিলে পাড়া-মহল্লা পর্যায়ে কিছুই পরিবর্তন হবে না, তখন কেন্দ্রে তার আর যাওয়া হয় না। তৃতীয়ত, একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতার আচার-আচরণ সত্যিকার অর্থেই ভোটারদের মোহমুক্তি ঘটিয়েছে। বিশেষত বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর এবং দাপুটে তরুণ ও উদীয়মান নেতার সাম্প্রতিক ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি ভোটারের মনে গোটা রাজনৈতিক সমাজের প্রতি বিরূপ ধারণা দিয়েছে। চতুর্থত, এ নির্বাচনের ফলাফল যেন সবারই জানা ছিল। একদল ভেবেছে আমি ভোট না দিলেও জিতবে অমুক। আর অন্য দল ভেবেছে আমাদের অমুক তো জিতেই আছে। সুতরাং কষ্ট করে ভোট দেওয়ার আর কী প্রয়োজন। বরং তিন দিনের ছুটিটাকে ভোট নয়, অন্য কাজে লাগাই। পঞ্চমত, উভয় দলের সন্ত্রাস, কেন্দ্র দখল, লঞ্চভর্তি সন্ত্রাসী আমদানি, সারা দেশ থেকে পেটোয়া বাহিনী ঢাকায় জমায়েত, নিজ ছাত্র ও যুব সংগঠন দিয়ে ভোট কেন্দ্র পাহারার নির্দেশসংক্রান্ত ঘোষণা, বিবৃতি, সংবাদ ও বক্তৃতা ভোটারদের মাঝে ভয় সৃষ্টি করে। তাই কেন্দ্রের কাছে যেতেও দ্বিধা করেছে অনেকে। নিরাপত্তার কথা ভেবে সন্তান ও স্বামী-স্ত্রীকে ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা দিয়েছে অনেক নগরবাসী। তাই আপাতত ৩০ শতাংশের নিচে ভোট নিয়ে সন্তুষ্ট নির্বাচন কমিশন আর ১৫ শতাংশ ভোট পেয়ে শত বছরের সেরা নির্বাচন বলে ভাবছে বিজয়ী দল। তবে সত্যিকারের গণতন্ত্রে ভোটার উপস্থিতির কোনো বিকল্প নেই। থাইল্যান্ডের র‌্যাংগসিট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চ্যান চাই চিতলাওরপর্ণের লেখা ‘দি রিলেশনশিপ বিটুইন দি ইলেকশান অ্যান্ড দি ডেমোক্রেসি’ (নির্বাচন ও গণতন্ত্রের সম্পর্ক) শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ইন্টার ডিসিপ্লিনারি রিসার্চ। (ভলিউম ৪, নম্বর ২, প্রকাশকাল ১ জানুয়ারি, ২০১৫)। প্রবন্ধটিতে তিনি তুলে ধরেছেন যে, নির্বাচন হলো গণতান্ত্রিক ধারার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অন্য কথায়, নির্বাচন হলো গণতন্ত্রের প্রতীক। নির্বাচনেই যদি দুর্নীতি হয়, তবে নির্বাচননির্ভর গণতন্ত্র হয়ে যায় প্রতারণা। নির্বাচন নষ্ট করে এমন এক ডজন কারণও উল্লিখিত তার লেখায়, যার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো এ দেশের কিছু কিছু নির্বাচনের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যাবে।

ভোটে অনীহা থেকে রাজনীতিতে অনীহা কিংবা রাজনীতিতে অনীহা থেকে ভোটে অনীহাÑ এ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। তবে বিতর্কের ঊর্ধ্বে ধ্রুব সত্য হলো, দেশ ও দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য রাজনৈতিক সচেতনতা ও নাগরিকদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। লেখাটি শেষ করব আমেরিকার প্রথম সাহিত্যনির্ভর ম্যাগাজিন ‘নর্থ আমেরিকান রিভিউ’-তে আজ থেকে প্রায় ১২১ বছর আগে (ভলিউম ১৬৭ নম্বর ৫০৩) প্রকাশিত তৎকালীন লেখক ও গবেষক স্পিড মোসবির লেখা ‘ডেঞ্জার অব পলিটিক্যাল অ্যাপাথি’ (রাজনীতিতে অনীহার বিপদ) শীর্ষক প্রবন্ধের একটি অংশ স্মরণ করে। প্রায় ১২১ বছর আগে তার লেখার মর্মার্থ-

‘...আমাদের মাঝে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক তথাকথিত কিংবা নামে মাত্র নাগরিক (জনগণ) আছেন, যারা রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন। প্রশাসন ও রাজনীতিতে যে অসুস্থতা, সীমাহীন দুর্নীতি ও অসততা বিরাজ করে, তার নেপথ্যে রয়েছে নাগরিকদের বা জনগণের এই রাজনৈতিক অনীহা।’

পুনশ্চ : বছরের শুরুতে একটি লেখায় এসি, ডিসি, ওসি, ভিসি, এমপি, মন্ত্রী ও সচিব পর্যায়ে মাত্র ১ হাজার সৎ মানুষের প্রত্যাশা করেছিলাম মুজিববর্ষে। আজও জাতির পিতার সম্মানে ১৬ কোটি মানুষ থেকে মাত্র পাঁচজন নির্বাচন কমিশনার নামক লৌহমানবের জন্য স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা জানাই, যাদের কথা ও দৃশ্যমান কাজ ভোটারদের আশ্বস্ত করবে এবং নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্রে যেতে উৎসাহ জোগাবে।

                লেখক : গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর