জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষের সামনে এখন প্রশ্ন এসেছে করোনায় মরবে নাকি ক্ষুধার যন্ত্রণায় মরবে? নাকি জীবনের চ্যালেঞ্জ নিয়েই জীবিকার লড়াই করবে? করোনার ধ্বংসলীলায় কেবল প্রাণহানির ঘটনাই ঘটছে না, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়েছে আজকের পৃথিবী। করোনার ভয়কে উপেক্ষা করে মানুষ এখন জীবনের জন্য জীবিকার লড়াইয়েই নামতে চায়। লকডাউনে স্বদেশ ও পৃথিবী অচল করে কোয়ারেন্টাইনে থাকলে জীবন মুখ থুবড়ে পড়বে জীবিকার অভাবে। খাবারের অভাবে। জীবনের জন্য জীবিকার লড়াই অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ লড়াই অনিবার্য হওয়ায় ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে লকডাউন তুলে দেওয়া বা শিথিল করা হচ্ছে। যদিও তুলে নেওয়া বা শিথিলে সংক্রমণ বা আক্রান্ত ও মৃতের তালিকা ফের বড় হচ্ছে।
পশ্চিমে এতি দন ধরে করোনার কালো থাবায় যে দোজখ দেখেছি তার আক্রমণ আমাদের এখানে মাত্র শুরু। আক্রান্ত ও মৃতের তালিকা রোজ বাড়ছে। তবু করোনার সঙ্গে লড়াই করে বাঁচার চ্যালেঞ্জ নিতে পারলেও ক্ষুধার সঙ্গে যুদ্ধে মানুষ টিকতে পারে না। এমন ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মুখে দাঁড়িয়ে জীবন ও জীবিকার চ্যালেঞ্জ নিতে গিয়েই লকডাউন তুলে দিয়ে বাঁচার কৌশল খুঁজছে মানুষ। দুনিয়ার সব দেশের সরকার বা রাষ্ট্রনায়কও সেই কৌশল খুঁজছেন।
আমাদের সরকার ২৬ মার্চ থেকে সরকারি ছুটি ঘোষণা, সব যোগাযোগ বন্ধ করে কার্যত লকডাউনে যায়। ব্যাংক খোলা রাখে। এক মাস পর বেশকিছু মন্ত্রণালয় খুলে দিলেও এখন সব মন্ত্রণালয় খুলে দেওয়ার চাপ বাড়ছে। সাড়ে ৪ কোটি মানুষকে সরকার খাদ্য সহযোগিতা, ৫০ লাখ মানুষকে অর্থসহায়তা দিচ্ছে। সচিবদের প্রতি জেলায় সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়ে ত্রাণ তৎপরতা চালানো হচ্ছে ডিসি, ইউএনওর মাধ্যমে ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের দিয়ে। এতে ত্রাণ চুরির দায়ে অনেকে বরখাস্ত হন এবং জেলেও যান। ধানের বাম্পার ফলনও হয়েছে। সরকার ১০ টাকা কেজি চালও বিক্রি করছে। পাঁচ-ছয় মাস মানুষকে খাবার সহায়তা দিতে পারবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সম্ভব নয়।
এমপি-মন্ত্রীরা ব্যক্তিগত সামর্থ্যে যে যা পারছেন নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় খাদ্য ও অর্থ সহায়তা মানুষকে দিচ্ছেন। সেটাও কম নয়। বিত্তবানসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষও মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে ত্রাণ বিতরণ করায় এমপি-মন্ত্রীদের এতে কোনো দায় বা জবাবদিহি থাকল না। অনিয়ম-ব্যর্থতার দায়ও সরকারি কর্মকর্তাদের নিতে হবে এবং জবাব দিতে হবে।
সবাই বুঝছেন, লকডাউন অনন্তকাল চলতে পারে না। এই মহাসংকটকালীন সবকিছু লকডাউনে বন্ধ করে রাখলে রাষ্ট্রের ভা-ারও শূন্য হয়ে যাবে। সরকার মানুষের পাশে দাঁড়ানো দূরে থাক তখন ক্ষুধার্ত বুভুক্ষু মানুষের গণঅসন্তোষের মুখোমুখি হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য কলকারখানায় নিদারুণ বিপর্যয় নেমে এলে বেকারত্ব চরম আকার নেবে। উন্নত ধনাঢ্য প্রতাপশালী রাষ্ট্র যেখানে এ বিপর্যয় মোকাবিলায় অশান্ত-উদ্বিগ্ন সেখানে আমাদের মতো দেশ কতটা করুণ বিপর্যয়ে পড়বে তা অনুমানেরও বাইরে। করোনার সঙ্গে লড়েই জীবনের গতিপথ আমূল পাল্টে দিয়ে জীবনযাপন করতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ করোনা সহজেই বিদায় হচ্ছে না। ডা. দেবী শেঠি তো লকডাউন বা তারপরে এক বছর কঠিন জীবনযাত্রার ২০টি টিপস দিয়েছেন। মানে তুমি কর্মক্ষেত্র আর ঘরের বাইরে কোথাও প্রয়োজন ছাড়া যাবে না। সামাজিকতা, সভা-সমাবেশ সব বন্ধ। পরিচ্ছন্নতা ও মুখোশ জীবন বাধ্যতামূলক।
জীবিকার পথ রুদ্ধ করে জীবন রক্ষায় খাবার দিতে না পারলে, অর্থনীতির বিপর্যয় এলে, চরম নৈরাজ্য, সামাজিক অপরাধ, আইনশৃঙ্খলারও অবনতি ঘটার আশঙ্কা। চরম এক কঠিন সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। করোনার এই সময়ে বিশ্বে ৮০ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রতাপশালী ধনাঢ্য রাষ্ট্রে আজ প্রতি চারজনের একজন হয় বেকার, নয় কর্মহীন। ভারতেই বেকার ১২ কোটি। জার্মানি বলেছে, এই অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে আট বছর লাগবে।
আমাদের এত দুর্নীতির মধ্যেও রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বে অর্থনীতির যে বিস্ময়কর উত্থান তা করোনার ধ্বংসলীলার লকডাউনে সজোরে ধাক্কা খেল। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত ২ লাখ ২১ হাজার ১৪৫ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আহরণ হয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম আদায় হয়েছে ৫৬ হাজার কোটি।
চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রাজস্ব আদায়ের অবস্থা ভালো নয়। করোনার প্রভাবে তা এখন শোচনীয়। এটা মোকাবিলায় বাজেটে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে বিদেশি সহায়তা বাড়ানোর পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো দরকার মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভ্যাটে ৮১ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৬৪ হাজার ১১১ কোটি টাকা। আগামী মাসেই নতুন বাজেট। লকডাউনে ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনীতি স্তব্ধ। অচল অর্থনীতি সচল না হলে ট্যাক্স-ভ্যাট আসবে কোথা থেকে? না এলে সরকার চলবে কী করে? রাজস্ব আয়ের ভূমি অফিস খোলা, স্থল ও নৌ বন্দর চালু করা এখন সময়ের দাবি। আর এখানে অসচেতন জনতার একগুঁয়েমি ও গার্মেন্ট মালিকরা শুরুতেই কারখানা খুলে দেওয়ায় লকডাউন পূর্ণতা পায়নি। সরকারের এখন রাজস্ব বড় বেশি প্রয়োজন, মানুষের প্রয়োজন জীবিকা। এটা অর্জনে জীবিকার যুদ্ধে স্বাস্থ্যবিধি বা আইন কার্যকরে সরকার ব্যবসায়ী ও জনগণের দায় সমান।
এই মহামারী পৃথিবীতে এক ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক বলছে, ২০২০ সালে বিশ্বের মোট প্রবৃদ্ধি ৬.৩ শতাংশ কমে মাইনাস ৩ শতাংশে নেমে যাবে।
এই মহামারীর কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে সারা বিশ্বের জিডিপির মোট ক্ষতি হবে ৯ লাখ মার্কিন ডলার। আইএলও বলছে, করোনার থাবায় দেশে দেশে কাজ বন্ধ থাকায় বিশ্বের ৮১ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ নিদারুণ কষ্টে পড়েছে।
সবচেয়ে বেশি ভুগছে যারা অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মে নিয়োজিত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবারই সবচয়ে বড় আঘাত এসেছে শ্রমজীবীদের জন্য।
মানুষের জীবনের মূল্য সবার আগে। তা নিশ্চিত করে অর্থনৈতিক কর্মকা- কীভাবে শুরু করা যায় সেটাই এখন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। এটা করতে না পারলে জনগণের বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে আবার রুগ্ন চেহারা ফিরে পাবে। এমনকি দুর্ভিক্ষ আসবে।
সরকার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে রেখেছে, কিন্তু চাইলে এখনই সব টাকা খরচ করতে পারবে না, তুলতেও পারবে না। সরকারের সব উন্নয়ন প্রকল্প শেষ করাও কঠিন। কিন্তু করতে হলে করোনার থাবা থেকে মানুষের জীবন রক্ষার সঙ্গে বৃহৎ মাঝারি ছোট শিল্প-বাণিজ্যের সব ব্যবসায়ীকে বাঁচিয়ে, কৃষকের স্বার্থ রক্ষার চ্যালেঞ্জ নিয়ে অর্থনীতিকে রক্ষার কৌশল নিতেই হবে। মানুষের মনোবল রক্ষা করে চ্যালেঞ্জটা যত কঠিনই হোক জয়ী হতে হবে।
রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা থেকে দেশের অর্থনীতিকে নিরাপদ রেখেছিলেন। ইউরোপে চরম বিপর্যয় নেমেছিল। ট্যাক্সিক্যাব চালক থেকে রেস্তোরাঁ পাব নাইটক্লাব সবখানে তার বিরূপ প্রভাব পড়েছিল! তবে তখন জীবনের ওপর থাবাটা আসেনি। এবার জীবন-জীবিকা দুটোই লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। পৃথিবীর সব সরকারই প্রণোদনা দিয়েছে। শেখ হাসিনা ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়েছেন সব ব্যবসায়ীর জন্য। কৃষকের জন্য। শুরুতেই গার্মেন্ট শিল্পের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা দিলেও শ্রমিকদের বেতন-ভাতার জন্য বিক্ষোভ করতে হয়েছে! প্রণোদনা ব্যাংক লুটেরা শকুনদের হাতে পড়বে কিনা প্রশ্ন উঠেছিল। দায়িত্বশীলরা বলেছিলেন, প্রশ্নই ওঠে না। শেয়ারবাজার ও ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পাচারসহ নানা অপকর্মের অপরাধীরা সমাজে দাপুটে। আইন তাদের স্পর্শ করেনি, তাই প্রশ্ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ১২ এপ্রিলের সার্কুলারে বলা হলো, ঋণখেলাপিরা প্রণোদনার ঋণ পাবে না।
এমনও বলা হয়েছিল, কোনো প্রতিষ্ঠানের ঋণ মন্দ হিসেবে শ্রেণিবিন্যাসিত হওয়ার পর যদি তিনবারের বেশি নবায়ন করা হয়ে থাকে, তবে ওই প্রতিষ্ঠানও এ প্যাকেজের আওতায় ঋণ সুবিধা পাবে না। কিন্তু ১১ মে সোমবার খবর হয়েছে, করোনা সংকট মোকাবিলায় শিল্প খাতের জন্য সরকার ৩০ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ করেছে, তাতে খেলাপিদের ঋণ দেওয়ার বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে! মানে যারা এত দিন ব্যাংকের ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেনি সেই লুটেরাদের আবারও টাকা দেওয়া হচ্ছে। প্রণোদনার নামে ঋণখেলাপিদের আবার টাকা দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের মাত্রা কত তা কমবেশি সবার জানা। ২০০৯ সালের শুরুতে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের শেষে সরকারি হিসাবে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এর সঙ্গে কাগজপত্র মর্টগেজ ছাড়াই ডাকাতির ৩৭ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এটা সরকারের হিসাব। কিন্তু গত বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে আইএমএফের ৬৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে জানা যায়, সরকার অনেক কিছুই খোলাসা করেনি। ডেইলি স্টারের (২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯) প্রকাশিত খবরে আসে, সরকার এত দিন খেলাপি ঋণের যে হিসাব দিয়েছে আসলে সত্যটা তার দ্বিগুণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এত দিনের হিসাব ছিল খেলাপি ঋণ ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। আইএমএফ বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবপত্র ঘেঁটে বলেছে, এর পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ৪০ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। সরকারের হিসাব অনুযায়ী খেলাপি ঋণ মোট ঋণের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ; বাস্তবে তা ২২ শতাংশের ওপরে! ব্যাংক ডাকাতির আরেক ব্যবস্থা হচ্ছে পুনঃ তফসিল করা। খেলাপি ঋণ কম দেখাতে এবং বেশি মুনাফা দেখানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে গত বছর রেকর্ড পরিমাণ ৫০ হাজার ১৮৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা হয়েছে। জনগণের টাকা এভাবে এই দুঃসময়েও ব্যাংক ডাকাতদের আর দেওয়া যায় না। এটা দেশের প্রকৃত বড়-ছোট ব্যবসায়ীদের দিতে হবে।
প্রণোদনার সব টাকা দেশের ভিতর থেকে জোগাড় হবে মনে করার কারণ নেই। এ টাকার এক বড় অংশ আসবে ধারদেনা থেকে। বাংলাদেশ সরকার আশা করছে, পাঁচটি উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান- আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ২২ হাজার কোটি টাকা পাওয়া যাবে। কিছু ইতিমধ্যেই পাওয়া গেছে। এ টাকা তো ফেরত দিতে হবে। তার মানে জনগণের ভবিষ্যৎ বন্ধক দিয়ে আনা টাকা তুলে দেওয়া হচ্ছে ব্যাংক লুটেরাদের হাতে। দেশের অর্থনীতি কয়েক হাতের সিন্ডিকেটে সর্বনাশ হবে তা হতে পারে না।
যারা ব্যাংক লুট করেছে, অনেক ব্যাংকের মালিক হয়েছে, শেয়ারবাজার লুট করে সূর্যাস্ত নামিয়েছে, তারা দেশদ্রোহী। অপরাধী। সাজা ভোগ করেনি। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়নি। বুক টানিয়ে হাঁটে। করোনার দুঃসময়ে মানুষেরও পাশে নেই। ত্রাণে নেই, দানে নেই- এসব ডাকাতের হাতে এই দুঃসময়ে জনগণের টাকা দেওয়া যায় না। দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ীদের দিতে হবে। যারা খেলাপি নয়। দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। লেনদেন ব্যাংকের সঙ্গে পরিষ্কার, স্বচ্ছ। সেসব ব্যাংকের টাকা মেরে অর্থ পাচারকারীদের আর না। ওদের সব সম্পদ কেড়ে নিলামে তুলে অর্থ আদায়ের সময়। এদের স্বার্থরক্ষার শক্তিটা খুঁজে বের করার সময় এখন।
করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলেও মানুষের হাতে আসতে কেউ বলছেন ন্যূনতম এক বছর, কেউ বলছেন দুই বছর লাগবে। শত বছর পর পর আসা মহামারীকেও নিয়ন্ত্রণে আনতে ঢের সময় লেগেছে মানুষের। লড়াই করেই বাঁচতে হয়েছে। জীবন ও জীবিকার লড়াইয়ের মাধ্যমেই মানুষ জয়ী হয়েছে অনেক প্রাণের বিনিময়ে।
টানেলের শেষ প্রান্তে আলোর রেখা দেখার এখনো বাকি। আঁধার শেষে ভোরের আলো আসবেই। বিলম্ব হবে বলে মুখ থুবড়ে অসহায়ের মতো সরকার ও জনগণ বসে থাকতে পারে না। জীবনের লড়াই চলবে, জীবিকার লড়াইও চলবে। দেশের সব উন্নয়ন উৎপাদন আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা-বাণিজ্য এক কথায় অর্থনৈতিক গতি তীব্র হবে। মানুষকে কাজের জায়গা দিতে হবে। আবার সচেতনতাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণকে বাধ্যতামূলক করে জীবনের লড়াইটাও শক্তিশালী করতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতেই হবে। দেশের সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসাব্যবস্থাকেও পরিকল্পিত সমন্বিত ও শক্তিশালী করে সুখ্যাতি আনতে হবে। এর বিকল্প পথ নেই। কভিড-ননকভিড হাসপাতাল নির্ধারণ না করায় মানুষ দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে চিকিৎসা পায় না। চিকিৎসাসেবা দিতে হবে।
রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকে আজ দেশের শীর্ষ পর্যায়ের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠীর ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ, সামরিক-বেসামরিক সব বাহিনীর নেতৃত্বকে নিয়ে পরামর্শ করে জীবন ও জীবিকার লড়াইয়ের চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। কুশলী পরিকল্পনা গ্রহণ করে প্রয়োজনে মন্ত্রিসভায় রদবদল, প্রশাসন ও স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে। দুর্নীতি-অনিয়ম কঠোর হাতে দমন করে বেসরকারি খাতকে সহযোগিতার উদারনীতি দিতে হবে। আইনের প্রয়োগে হতে হবে কঠোর। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, হয়রানি বন্ধ করতে হবে। সব মন্ত্রণালয় ও সরকারের রাজস্ব আদায়ের খাত সামনে নিয়ে অফিস-আদালত সব খুলে দিতে হবে। এক কথায় মানুষের জীবন নিরাপদ রেখে সব মন্ত্রণালয়, সরকারি অফিস-আদালত ছুটিমুক্ত করে দেশকে উন্নয়ন কর্মকান্ডে মুখর করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধির আওতায় সরকারি-বেসরকারি সব শিল্পকারখানা খুলে দিতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে দেশকে এই মুমূর্ষু আতঙ্কিত বিষণ্নতা থেকে মুক্তি দিতে হবে। হোটেল, রেস্তোরাঁ, ক্লাব খুলে না দিলে, উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি ও পণ্য সরবরাহ না হলে সরকার ট্যাক্স-ভ্যাট কোথায় পাবে? আর মানুষের কাজের নিশ্চয়তাও কোথা থেকে হবে? প্রণোদনাও কীভাবে কাজে লাগবে? ব্যাংকও কীভাবে টিকে থাকবে? তাই অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের দরজা খুলতে পরিকল্পনা নিতেই হবে।
তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অবশ্যই বন্ধ রাখতে হবে কারণ সেখানে সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব রেখে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা তাদের জন্য কঠিন। প্রয়োজনে অনলাইনে পড়াশোনার মতো পরীক্ষা বা অটোপ্রমোশনে যেতে হবে যেমন মুক্তিযুদ্ধের পর করা হয়েছিল। এবারও পশ্চিমা দেশ করেছে।
সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত কলকারখানা জীবাণুমুক্ত রাখতে, স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে মনিটরিং-ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। সেই সঙ্গে চিকিৎসাব্যবস্থাকে তৃণমূল পর্যন্ত শক্তিশালী সেবামূলক করে তুলতে হবে দ্রুত। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আল্লাহর অসীম করুণায়, সবার দোয়ায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন। খ্যাতিমান চিকিৎসক দেবী শেঠি এসে তার অবস্থা নির্ণয় করে সিঙ্গাপুর নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মাত্র। কিন্তু যুদ্ধটা আমাদের চিকিৎসকরাই করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেশিন নাকি খুলে দেখা হয় নষ্ট অথবা পর্যাপ্ত নয় রোগীকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য। শেষে বেসরকারি ল্যাবএইড হাসপাতালের মেশিন আনা হয়েছিল।
আমরা করোনাকালে দেখেছি, লকডাউনে পৃথিবী আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন। কেবল করোনা রোগের বাইরেও কত ধরনের অসুখে ভোগা রোগী কি উচ্চবিত্ত কি মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নমধ্যবিত্ত উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতেন তারা এখন দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন। চিকিৎসা কারও জুটেছে কারও জোটেনি। আচমকা যেমন আমাদের চিকিৎসা খাতের সীমাহীন দেউলিয়াত্ব দুর্নীতি অনিয়ম অদক্ষতা অব্যবস্থাপনা উন্মোচিত হয়েছে, তেমনি এই সত্য জেনেছি, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা ভঙ্গুর অবস্থা থেকে দুর্নীতিমুক্ত করে কতটা উন্নত করা জরুরি তার তাগিদ।
অভিজ্ঞতার শিক্ষাটা ক্ষমতাবান, বিত্তবান, চিকিৎসক সবারই হয়েছে। হয়নি লোভী চোরদের। এদের বাদ দিয়েই আমাদের সাজাতে হবে চিকিৎসা খাত। কতটা গবেষণা, ল্যাব, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, দক্ষ নার্স, টেকনোলজিস্ট, আইসিইউ, ভেনটিলেশন ও আইসিইউ বিশেষজ্ঞের দরকার জেনেছি। আরও জেনেছি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জেলা পর্যায়ে যেমন থাকতে চান না তেমনি কতটা বেহালদশা স্বাস্থ্যসেবার মান।
আমরা নিশ্চয় তওবা করে হলেও নিজের জীবনের স্বার্থে চিকিৎসাসেবা শক্তিশালী উন্নত আধুনিক করব। এ নির্মম সত্যটা তো হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। আর যেসব বাজিকর এই দুর্যোগে জাল এন৯৫ মাস্ক সরবরাহ করেছে এবং যারা এটাকে জায়েজ করেছে ভুল বলে এবং প্রশ্ন তোলা চিকিৎসককে ওএসডি করেছে তাদের জন্য এ খাত হারাম করব। বিদেশে যারা চিকিৎসায় বিশাল ব্যয় করেন সেটিও দেশে থাকবে। এজন্য সরকারি খাতকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিতে প্রণোদনা সুবিধা দিতে হবে। এটা সেবা, বাণিজ্য নয়। হেলাফেলাও নয়। চিকিৎসক থেকে নার্সদের আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে সেই উচ্চতার প্রশিক্ষণও দিতে হবে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।