বুধবার, ১৩ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

হে মহান আরও বীরের জন্ম দাও

শহীদুল্লাহ ফরায়জী

হে মহান আরও বীরের জন্ম দাও

করোনায় লন্ডভন্ড বিশ্বে মূল্যবোধ ও বিশ্বাসে এক মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। তলোয়ার তীর বর্শা সমরাস্ত্র এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দেয় না। মানবজীবনে বা সমাজজীবনে শক্তিমত্তার তান্ডব কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না, মনোবল বা আত্মবিশ্বাসে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। করোনা পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের আত্মম্ভরী অহংকার গুঁড়িয়ে  দিয়েছে। এত দিন যাদের বীর বলে পূজা করা হতো, ইতিহাসের পাতায় যাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হতো, কৃতজ্ঞতার জীবনপাত্রে ঠাঁই দেওয়া হতো তাদের এখন বিতাড়নের সময় এসেছে।

বীর কারা, বীর হিসেবে কাদের চিহ্নিত করা হবে তা নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। মানুষ চিরকাল স্বপ্নের চেয়েও বড়, নশ্বর জীবনে অবিনশ্বর হওয়ার শক্তির অনুসন্ধান করে। বীর কৃত্রিম মুখোশটাকে সরিয়ে ফেলে জীবনের উৎকর্ষতায় নিজেকে নিয়োজিত করে। বীর অন্ধকারকে তাড়িয়ে বিপন্ন মানুষের পাশে বিশাল সাহস নিয়ে শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে।

করোনায় বিশ্বে বহু বীরের আবির্ভাব ঘটেছে। সজ্ঞানে নিজের মৃত্যুকে অবজ্ঞা করে অন্যের জীবনকে বাঁচানোর প্রেরণা জুগিয়েছে। নিজের জীবন ও স্বপ্নকে বলি দিয়ে অন্যের জীবন ও স্বপ্নকে সুরক্ষা দিয়েছে। নিজেকে মৃত্যুর কালো হাতে তুলে দিয়ে অন্যের প্রাণে নিজের হাতে মমতার বিস্তার করে দিয়েছে। এভাবে নিজের মৃত্যুঝুঁকি অগ্রাহ্য করে মানুষের পাশে থাকার মহৎপ্রাণ যাদের তারাই বীরের মর্যাদায় সংবর্ধিত হবে।

কভিড-১৯ অনেক নিষ্ঠুরতার জন্ম দিয়েছে। মানুষের চিরকালীন বন্ধনকে ছিন্নভিন্ন করতে চেয়েছে। মানুষের কাছে থাকার আকুল আকাক্সক্ষাকে অবরুদ্ধ করেছে। পুত্রের লাশ পিতার দেখার মাঝে ভয়ের প্রাচীর তুলেছে। কফিনে শেষ ভালোবাসার অর্ঘ্য দেওয়ার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। মাকে জঙ্গলে রাখার দানবিক শক্তি জুগিয়েছে। পরিবারের সঙ্গে শত্রুতার আচরণ শিখিয়েছে। করোনা মানুষের মনে ভয়ভীতি গ্রোথিত করেছে।

করোনার অদৃশ্য যুদ্ধের ভয়ভীতি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে হাজার হাজার বীরের জন্ম হয়েছে। মহামানবের মতো মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। করোনায় আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসায় নিজের জীবনের গভীরতর স্বপ্নকে মাটিচাপা দিয়ে অন্যের জীবনের তরীতে স্বপ্ন বোঝাই করে তুলে দিয়েছে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। মানুষের প্রতি কি অসম্ভব ভালোবাসা থাকলে নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে অন্য মানুষের জীবনে নিজের ভালোবাসা বণ্টন করে দিতে পারে। মানুষকে চিকিৎসা দিয়ে বাঁচার আনন্দ উপহার দিয়ে নিজে না-ফেরার দেশে গমন করতে পারে। করোনার এই ভয়াবহতায় স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্য- যারা নিজেদের জীবন চরম ঝুঁকিতে রেখেও দেশ ও জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন তারাই বীর।

এমন আরও বীরের জন্ম হোক এই পৃথিবীতে। যারা জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিকিৎসা প্রযুক্তি ও সাহস দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবে, কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করবে। করোনা মানুষের দেহের ভিতর মৃত্যু খোঁজে আর বীরেরা দেহের ভিতর জীবন খোঁজে। এসব চিরকালীন বীরকে সমাজ ও রাষ্ট্র সর্বোচ্চ সম্মান জানাবে। রাষ্ট্র তাদের বীরত্বের স্বীকৃতি দেবে। শিশুরা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের ইতিহাস পড়ে উজ্জীবিত হবে। এসব বীরের ঘটনা নিয়ে সাহিত্য রচিত হবে, চলচ্চিত্র নাটক কবিতা হবে। এসব বীরের ছবি ঘরে ঘরে সংরক্ষিত হবে। ডাক বিভাগের ডাকটিকিটে বীরদের প্রতিকৃতি থাকবে।

করোনার সর্বগ্রাসী ভীতি উপেক্ষা করে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে গেছে। ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার দিচ্ছে অসহায় মানুষকে সাহস দিচ্ছে, শিশুর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে, বৃদ্ধা মাকে আশ্রয় দিচ্ছে এরাই মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে মানবিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে। এরাই সমাজের পরশপাথর। এদের সাহায্যে এদের সংস্পর্শে মানুষ মানবিক হয়ে উঠবে, সাহসী হয়ে ওঠার প্রেরণা নেবে। জাতিকে আত্মিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ জোগাবে।

করোনা হলে মাকে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসা, স্বামী স্ত্রী সন্তানকে অস্বীকার করা, বাড়িভাড়া বাতিল করা, ত্রাণসামগ্রী চুরি বা আত্মসাৎ করা, কবর দেওয়ায় বাধা সৃষ্টি করা, লাশের সৎকার করতে না দিয়ে বিঘ্ন সৃষ্টি করা এগুলো নিষ্ঠুরতার চরম বহিঃপ্রকাশ। এসব গুটিকয় নির্মম মানুষ তারা মানবসমাজের প্রতিনিধিত্ব করে না। জল্লাদ খুনি বর্বর অমানুষরা বিবেকের বা ন্যায়বোধের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না।

আমরা এতকাল কাদের বীর মনে করেছি। যারা যুদ্ধবিগ্রহের নামে, লুণ্ঠনের নামে, প্রভুত্ব বিস্তারের নামে মানুষের রক্তে মাটি রঞ্জিত করেছে, যারা মহাশক্তি নিয়ে রণহুঙ্কার দিয়ে উন্মত্ততায় মানুষ নিধন করেছে, কতল করেছে তাদের আমরা বীর বলেছি। যারা সমর ক্ষমতায় বিস্তীর্ণ বসতি গুঁড়িয়ে দিয়েছে, যারা মানুষকে জবাই করে রক্তের উষ্ণতায় অগ্নিবর্ণ মদ খেয়ে ভোজ উৎসব করেছে, যারা মানুষের খুলি দিয়ে পানপাত্র বানিয়েছে তাদের আমরা বীর বলেছি। যারা মানুষের আর্তনাদ গোঙানি বিলাপকে অট্টহাসি দিয়ে উপহাস করেছে তারা বীর সেজেছে। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ঠাঁই পেয়েছে। যারা লাশের ওপর তা-ব করেছে তারা রাজতুল্য পদক পেয়েছে। যে যত বড় খুনি সে তত বড় বীরের খ্যাতি পেয়েছে। নামের সঙ্গে দ্য গ্রেট বা মহাত্মা সংযোগ হয়েছে।

আমরা মহাকাব্য ইলিয়াডে দেখেছি ক্রোধ ঈর্ষা প্রতিশোধ-পরায়ণতার কী ভয়ঙ্কর মোহ। বিশাল শক্তিমত্তার নির্মম মঞ্চায়ন, ধ্বংস হয়ে যাওয়া জনপদের দুঃস্বপ্ন। একদল মানুষের আক্রমণে আরেকদল মানুষ ভয়ঙ্করভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া। দাউ দাউ আগুনে পুড়তে থাকা ট্রয় নগরী। ভায়োলেন্স, যৌনাকাক্সক্ষা, প্রতিশোধপরায়ণতা ও বিদ্বেষ, যুদ্ধ আর যুদ্ধ। ১৫৯৬৩ লাইনের মাঝে ৫০০০ লাইন যুদ্ধের দৃশ্য বর্ণনা। পরতে পরতে শরীরের ওপর মৃত্যু ঝরে পড়ার কাহিনি।

হোমারের ইলিয়াডের অন্যতম বাংলা অনুবাদক মাসরুর আরেফিন তার ভূমিকায় বলেছেন, ‘মানুষের উচ্চাশা লালসা কাম বাসনা প্রেম প্রতিশোধস্পৃহা ক্রোধ খ্যাতির মোহ বীরত্বের নেশা সর্বনাশা আত্মবিনাশী যুদ্ধের নিষ্ঠুর পাশবিকতার অমূল্য দলিল ইলিয়াড।’ সুতরাং খুনের উৎসব, রক্তের হোলিখেলা, নিষ্ঠুরতার তা-ব নিয়ে বীরের মহাকাব্য আর নয়।

এখন মহাকাব্য হবে মানবতার সর্বোচ্চ আলোকবর্তিকার ঘটনাবলি নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উচ্চতম বোধের দৃশ্যকল্প নিয়ে। আমাদের জানতে হবে ভীতি ও একাকিত্বের দীর্ঘতম যন্ত্রণা ঘুচিয়ে দেওয়ার গল্প। পৃথক্করণের প্রাচীর ভেঙে দেওয়ার গল্প। মানুষকে মানবিক করার এবং রাষ্ট্র ও সমাজকে নৈতিক-মানবিক করার চূড়ান্ত সময় সমাগত। নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার দানবীয় উন্নয়ন স্তব্ধ করার সময় এসেছে। অশুভ প্রতিযোগিতার বিশ্বব্যবস্থা পরিবর্তনের সুযোগ এসেছে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার -ভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণের তাগিদ সৃষ্টি হয়েছে। এক নবতর বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার এখনই সময়। আসুন আমরা নতুন বীরদের অভ্যর্থনা জানাই।

বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক কাহলিল জিবরান বলেছেন, করুণা কর সেই জাতিকে যারা কাপুরুষকে সাহসী হিসেবে প্রশংসা করে, যারা ধ্বংস ছাড়া দম্ভোক্তি করতে পারে না। করুণা কর সেই জাতিকে যাদের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা বছরের পর বছর ধরে বধির হয়ে আছে এবং যাদের শক্তিশালী লোকেরা এখনো বসবাস করে দোলনায়। আমরা যেন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া রাষ্ট্রকে করুণার শিকারে পরিণত না করি।

আসুন এই গভীর সত্যকে উপলব্ধি করে সমাজ ও রাষ্ট্রের মুক্তির লক্ষ্যে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করি।

লেখক : গীতিকবি।

e-mail: [email protected]

সর্বশেষ খবর