রবিবার, ৫ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

হোলি আর্টিজান হামলার মূল্যায়ন

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন

হোলি আর্টিজান হামলার মূল্যায়ন

দেখতে দেখতেই চার বছর পার হয়ে গেল। ২০১৬ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে মর্মান্তিক ও ভয়ঙ্করতম জঙ্গি হামলা হয়েছিল গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারি কাম ক্যাফেতে, যে হামলায় জঙ্গি যুবকরা ২২ ব্যক্তিকে হত্যা করে, যার ১৭ জনই ছিলেন বিদেশি। ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই এ মামলার ব্যাপারে অভিযোগপত্র দেওয়া হয় এবং ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর বিচারিক আদালত সাতজনকে মৃত্যুদ- ও একজনকে খালাস দিয়ে রায় প্রদান করেন। হোলি আর্টিজানের জঙ্গি হামলা কয়েকটি কারণে বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক জঙ্গি হামলার ইতিহাসে পঠিত ও বিশ্লেষিত হওয়ার দাবি রাখে। প্রথমত, এটি ছিল এমন একটি জঙ্গি হামলা যেটি ২৮ থেকে ৩৫ জনের একটি দল দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি, প্রশিক্ষণ ও অর্থায়নে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় পরিচালনা করে, যেটি বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। দ্বিতীয়ত, এ হামলাটির পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধানে ছিল আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএস, যদিও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এটিকে সবসময়ই নাকচ করা হয়েছে। কৌশলগত কারণে সরকারি অবস্থান সঠিক বলে প্রতীয়মান হলেও আইএসের সংশ্লিষ্টতা নানা তথ্য দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। রাত সাড়ে ৮টার দিকে হামলা শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আইএস বা ইসলামিক স্টেটের বার্তা সংস্থা ‘আমাক’ এক টুইটার বার্তায় জানায়, ইসলামিক স্টেটের কমান্ডোরা ঢাকার একটি ক্যাফেতে হামলা চালিয়েছে। এরপর সারারাত ধরে আইএস ঘটনার সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে ধারাবাহিকভাবে পোস্ট দিতে থাকে। তারা জঙ্গি পাঁচ যুবকের ছবি ও ছদ্মনাম প্রকাশ করে।‘আমাক’ কর্তৃক প্রকাশিত ও সাইট ইনটেলিজেন্স কর্তৃক সত্যায়নকৃত ছবিতে দেখা যায়, হোলি আর্টিজানে হামলাকারী পাঁচ যুবক অস্ত্র হাতে, কালো পাঞ্জাবি ও হাজী ওড়না পরে পোজ দিয়েছেন। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে কোনো জঙ্গি হামলায় এর আগে ১৭ জন বিদেশি হত্যাকান্ডের শিকার হননি, যার মধ্যে ছিলেন জাপানি, ইতালি, ভারতীয় ও আমেরিকান নাগরিক। তথ্যপ্রযুক্তি ও অত্যাধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার এবং এতজন বিদেশিকে হত্যার কারণে হামলাটি বৈশ্বিক মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। চার বছর আগের এ হামলার ব্যাপারে দেশি-বিদেশি নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষকরা তাদের মতামত ও মূল্যায়ন জানিয়েছিলেন, সে বিষয়ে একটু নজর দিতে চাই। প্রথমত, সরাসরি হামলায় অংশগ্রহণকারী যুবকদের মধ্যে প্রায় সবাই সচ্ছল পরিবারের সন্তান এবং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। হামলাকারী যুবকদের মধ্যে তিনজন ইংরেজি-মাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন। ফলে এত দিন ধরে যে প্রচলিত ধারণা ছিল, দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত ও ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিতরা জঙ্গিতে পরিণত হয়, সে ধারণাটি ভেঙে গেল। এর মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হলো যে, বাংলাদেশের সমাজের নানা স্তরের মধ্যে আইএস সমর্থকদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং তারা সচ্ছল ও ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত যুবকদের ‘মগজ ধোলাই’ করতেও সক্ষম।

দ্বিতীয়ত, হোলি আর্টিজান বেকারির হামলাটি ছিল ‘নো এক্সিট স্ট্র্যাটেজি’র, অর্থাৎ হামলার মধ্যে পিছু হটা বা বেরিয়ে যাওয়ার কোনো কৌশল ছিল না। এটি ছিল একটি ‘সুইসাইড মিশন’, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। আইএস বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে কর্মকৌশল প্রয়োগ করে আক্রমণ চালায়, তার সঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা ‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন। কোনো কোনো নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মতে সীমিত আকারে হলেও ঢাকা আক্রমণের সঙ্গে ২০১৫ সালের নভেম্বরে প্যারিসে সংঘটিত জঙ্গি হামলার মিল আছে।

তৃতীয়ত, হোলি আর্টিজান হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গি হামলা মোকাবিলায় পুলিশের ঘাটতিগুলো উন্মোচিত হয়েছিল। কেননা হামলা শুরুর পর পুলিশের কর্মকর্তারা তো সেটি থামাতে পারেনইনি, বরং হামলা থামাতে গিয়ে গুলশান থানার ওসিসহ দুজন নিহত হয়েছেন। এমনকি র‌্যাবও সারারাতের চেষ্টায় হামলা থামাতে ব্যর্থ হলে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো এনে পরদিন সকালে হামলাকারীদের হত্যা করে বেকারির মধ্যে তখনো জীবিত থাকা জিম্মিদের উদ্ধার করা হয়। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে জঙ্গি হামলা মোকাবিলার যে ধরনের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োজন ছিল তা হোলি আর্টিজান হামলার সময় পুলিশের ছিল না। ওই হামলার সময় পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের কাছে ছিল অটোমেটিক চাইনিজ রাইফেল, নাইন-এম-এম পিস্তল ও শটগান; অথচ হামলাকারীদের কাছে ছিল ফোল্ডেড বাঁট একে-টুয়েন্টি-টু অ্যাসল্ট রাইফেল, নাইন-এম-এম পিস্তল ও গ্রেনেড। চতুর্থত, অভ্যন্তরীণ ও বহিঃসূত্র থেকে প্রাপ্ত সব বার্তাকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেয়নি বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন। কেননা ২০১৬ সালের এপ্রিলে আইএসের ইংরেজি ম্যাগাজিন ‘দাবিক’-এ ইসলামিক স্টেটের বাংলা প্রদেশের গভর্নর তামিম চৌধুরী একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘খিলাফত ও বৈশ্বিক জিহাদের জন্য বাংলা একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল এবং আমাদের সৈনিকরা এ এলাকার নাস্তিকদের জবাই করার জন্য তাদের ছুরিতে শান দিচ্ছে।’ মনে রাখা প্রয়োজন, আইএস কর্তৃক সংজ্ঞায়িত বাংলা প্রদেশ বা বাংলা অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের রয়েছে একটি বিশেষ স্থান, কারণ বাংলাদেশের ১৭ কোটি জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশই মুসলমান। এজন্য বাংলাদেশ শুধু ইসলামী জঙ্গি ‘রিক্রুট’ করার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, একই সঙ্গে এটি ‘অপারেশনাল গ্রাউন্ড’ বা অভিযান পরিচালনার জন্যও একটি আদর্শ স্থান। পঞ্চমত, হোলি আর্টিজানের হামলাটি ছিল ২৮ থেকে ৩৫ জনের দলের একটি ‘সেল বেইজড’ হামলা। সরাসরি হামলাকারীদের কয়েকজন হামলার আগে কয়েক মাস ধরে নিখোঁজ ছিলেন। ফলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো একটু তৎপর হলে পরিকল্পনাটি হামলা পর্যন্ত না-ও গড়াতে পারত বলে কারও কারও ধারণা। কেননা ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার, সরকারি বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের দেশের ধর্মীয় জঙ্গি, কট্টর অভিবাসনবিরোধী ও সাদা চরমপন্থিদের ব্যাপারে এতটাই সক্রিয় যে, এসব দেশে এখন দল বেঁধে বা সাংগঠনিকভাবে জঙ্গি বা চরমপন্থি হামলার সুযোগ নেই বললেই চলে। ফলে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোয় হামলাগুলো হচ্ছে ‘লোন ওলফ’ কর্তৃক, অর্থাৎ একজন সাদা চরমপন্থি ব্যক্তি কোনো দল বা সংগঠনের সহযোগিতা ছাড়াই একক পরিকল্পনা ও চেষ্টায় হামলা পরিচালনা করছেন। উদাহরণ হিসেবে ২০১১ সালের জুলাইয়ে অ্যান্ডারস বেহরিং ব্রেইভিক কর্তৃক ৭৭ জন যুবক-যুবতীকে হত্যা এবং প্রায় ৩০০ ব্যক্তিকে আহত করার ঘটনার উল্লেখ করা যায়। ২০১৯ সালের মার্চে ব্রান্টান্ট টারান্ট নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে হামলা চালিয়ে ৫১ মুসলিমকে হত্যা করেন এবং ৪০ জনকে হত্যার চেষ্টা করেন।

হোলি আর্টিজানের হামলাটি ‘লোন ওলফ’ কর্তৃক বা একজন জঙ্গি দ্বারা পরিকল্পিত ও পরিচালিত হামলা ছিল না। সরাসরি হামলাকারীরা নিখোঁজ ছিলেন কয়েক মাস। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ, অর্থায়ন, তথ্যপ্রযুক্তি সহায়তা নিয়ে প্রকৌশলী-ব্যাংকার-অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাসহ আরও ২৫-৩০ জন ছিলেন হামলাটি সফল করার জন্য। এতজন ব্যক্তির নানা কর্মকা-ের তথ্য না থাকাটাকে একটি সামগ্রিক গোয়েন্দা ব্যর্থতা বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। যা হোক, হোলি আর্টিজানের মর্মান্তিক ও ভয়ঙ্কর হামলার পর সরকারের পক্ষ থেকে জঙ্গিবাদের ব্যাপারে ‘শূন্য সহনশীলতার নীতি’ গ্রহণ করা হয়। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিট (সিটিটিসি), র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ঢাকার ভিতরে ৬টি স্থান ও ঢাকার বাইরে ১১ জেলায় অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল নব্য জেএমবিসহ জঙ্গিদের দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে ফেলে। জঙ্গিবাদের বিপদ থেকে বাংলাদেশকে নিরাপদ করার মধ্য দিয়ে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহ দেশে ও বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। তবে এতে আত্মতুষ্ট হয়ে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। কারণ করোনা মহামারীর সংকটের সময় জঙ্গিরা অনলাইনে তাদের সদস্য সংগ্রহ করছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ মহামারীর কারণে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে জঙ্গিরা আবারও সক্রিয় হতে পারে বলে ইতোমধ্যে অনেকে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে রাশিয়ার অনবরত বোমা বর্ষণে সিরিয়া ও ইরাকে অবস্থিত ইসলামিক স্টেটের ঘাঁটির পতন হলেও আইএস জঙ্গিরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। তাদের ২০ হাজার সৈন্য বিভিন্ন ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে হামলা অব্যাহত রেখেছে। এপ্রিলের প্রথম দিকে পূর্ব সিরিয়ার একটি শহরে হামলা চালিয়ে আইসিসের ‘জিহাদি’ (বা জঙ্গিরা) ৩২ সিরীয় সেনাকে হত্যা করেছে বলে তাদের সংবাদপত্র আল নাবার এপ্রিল সংখ্যায় দাবি করা হয়। আইএস সদস্যদের অনেকেই নিজ দেশে ফিরে গেছেন বা আফ্রিকার দিকে সরে গেছেন বলে অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মনে করেন। অন্যদিকে বৈশ্বিক মহামারীর মধ্যেও বোকো হারামের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর হামলায় নাইজেরিয়ায় ৪৭ সেনা ও চাদে ৯২ সেনা নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া মোজাম্বিক ও মালিতেও জঙ্গি হামলায় হতাহত হয়েছেন অনেকে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকেও সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মূল লড়াইটি আদর্শিক। সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে গেলেও অনলাইনে তারা সক্রিয়। শিক্ষা, সংস্কৃতি দিয়ে ধর্মীয় ও দার্শনিকভাবে জঙ্গিবাদকে মোকাবিলা করা না গেলে এ বিপদ থেকেই যাবে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি, সেই আকাক্সক্ষাও হোঁচট খাবে বারবার।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর