পুঁজিবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবাদের মুনাফা-লালসার উন্নয়ন-কৌশলের ফলে পৃথিবীর প্রাকৃতিক প্রতিবেশ-ব্যবস্থা মহাবিপর্যয়ের মুখোমুখি; জলবায়ু পরিবর্তন, সাগরের অম্লীকরণ, রাসায়নিক দূষণ, নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের অতি ব্যবহার, মিষ্টি পানির অতি উত্তোলন, ভূমিপ্রকৃতির রূপান্তর, প্রাণবৈচিত্র্যের বিলোপ, বায়ুদূষণ এবং ওজোন স্তরের ক্ষয় আজ মানবপ্রাণ ও সব প্রাণের অস্তিত্ব-বিধ্বংসী হয়ে উঠেছে। এ উন্নয়ন কৌশলের প্রভাবে এখন সারা বিশ্বে ঘন ঘন ও তীব্রতর ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি ও অসময়ে বৃষ্টি, প্রলম্বিত ও পৌনঃপুনিক বন্যা, নদীতীর ও উপকূল-তীর ভাঙন, দাবানল, খরা ইত্যাদির ফলে মানুষের জৈবনিক অস্তিত্ব এবং কৃষি ও জীবিকা হুমকির মধ্যে পড়েছে; মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে।
তাৎক্ষণিক ও প্রলম্বিত এসব ঝুঁকি ও প্রভাবের সঙ্গে মানব-হন্তারক মারী-মহামারীর কারণ হিসেবে ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অনুপ্রাণ; বাড়ছে তজ্জনিত রোগবালাইয়ের সংখ্যা ও বিস্তৃতি। মানবসভ্যতা এখন পার করছে কভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণজনিত বৈশ্বিক মহামারী। এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও মহামারী মানুষের সচ্ছলতা বা চেহারা দেখে আক্রমণ করে না।
করোনাকালের আগে দেশ-বিদেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় যে ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো ছিল, সেগুলোর কিছুর ওপর নতুন করে আলোকপাত করেছে। দেখা যাচ্ছে যে রাষ্ট্র- [১] স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঠিক রাখতে পারছে না, [২] খাদ্যব্যবস্থা ঠিক রাখতে পারছে না, [৩] শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক রাখতে পারছে না, [৪] সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা ঠিক রাখতে পারছে না, এবং [৫] করোনাকালের আগে যে ডিজিটাল-ডিভাইড ছিল তার সর্বনাশা প্রভাব উপলব্ধি করতে পারছে না। দেশে দেশে যে স্বাস্থ্য-খাদ্য-শিক্ষা-সুরক্ষা-ডিজিটাল ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, প্রমাণ হয়েছে যে তা মোটেই যথেষ্ট নয়, অপর্যাপ্ত। করোনাকালে প্রমাণ হয়েছে উন্নত-উন্নয়নশীল-স্বল্পোন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো পদে পদে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বিপরীতে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে চীন, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোচিয়া, কিউবা ও নেপালের মতো দেশ এবং ভারতের অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে কেরালার মতো রাজ্য করোনা মোকাবিলায় এমনকি ধনী ও সক্ষম দেশগুলোর চেয়েও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে; মানুষকে রক্ষা করেছে। সেজন্য প্রাণসংহারী করোনাকালের জীবনদায়ী শিক্ষা হচ্ছে এই যে মানুষকে মর্যাদা দিতে চাইলে আর রাষ্ট্রের মালিক যদি মানুষ হয়ে থাকে তাহলে মুনাফার আগে, ক্ষমতার আগে ও দলবাজির রাজনীতির আগে মানুষকে অগ্রাধিকার দিয়ে সব অর্থনৈতিক ও অ-অর্থনৈতিক সামষ্টিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব সামষ্টিক নীতিমালা কোনোভাবেই প্রাকৃতিক-প্রতিবেশ ব্যবস্থা এবং মানুষ ও অন্যান্য প্রাণের অস্তিত্ববিনাশী হলে চলবে না; তা হতে হবে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক।জাসদ মনে করে সব অর্থনৈতিক ও অ-অর্থনৈতিক সামষ্টিক ‘কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পথটি হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক-ব্যবস্থার পথ। এ পথে হাঁটার শুরুতে নয়া-উদারনীতিবাদের গড্ডালিকা প্রবাহের বিপরীতে পুনর্বিবেচনা করতে হবে রাষ্ট্রের ভূমিকা। এখানে- [১] মানুষের-সমাজের চাহিদা, [২] বাজার-শক্তির চাহিদা ও [৩] উদ্যোক্তার উদ্যোগ ও সৃজনশীলতার সঙ্গে [৪] রাষ্ট্রের ভূমিকা- এ চারের সমন্বয়ে চতুর্মাত্রিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হলো সে পুনর্বিবেচনা; ভেদ-বিভেদ-অসমতা-বৈষম্য থেকে মুক্তির পথে, সমাজতন্ত্রের পথে। সমাজতন্ত্রের দিকে এ পথচলায় এখনই অর্জন করতে হবে- [১] সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা, [২] সর্বজনীন খাদ্য নিরাপত্তাব্যবস্থা, [৩] সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা, [৪] সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা এবং [৫] সর্বজনীন ইন্টারনেট-অভিগম্যতার ব্যবস্থা। এগুলোকে সংবিধানের মৌলিক নীতি হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।
উল্লিখিত আর্থ-সামাজিক বিবেচনার পাশাপাশি এবার তাকানো যাক রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে। সারা বিশ্ব এখন এক অস্থির সময় পার করছে; নিদারুণ আদর্শিক সংকট চলছে সর্বত্র; মানবসভ্যতার সব মহান অর্জন-অধিকার-আদর্শগুলো বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে; ফলে মানবতা বিপন্ন হচ্ছে। সারা দুনিয়ায় ধর্মীয় জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। মানুষকে প্রত্যাখ্যান করার, তার পরিচয় নাকচ করার ও অধিকার অস্বীকার করার রাজনীতি, এবং মানুষের মধ্যে ভেদ-বিভেদের ঘৃণা ছড়ানোর রাজনীতিতে দুনিয়ার মানুষ কাঁদছে। বাংলাদেশেও ঠিক একই অবস্থা বিরাজ করছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ; কিন্তু এখনো ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ আর অন্যান্য গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মীমাংসিত বিষয়গুলো অমীমাংসিত ও অস্বীকার করা হচ্ছে। এখনো বাঙালির আত্মপরিচয় আর ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য অস্বীকার করা হচ্ছে; পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেওয়া হচ্ছে; বাউল শিল্পীদের গান গাইতে বাধা দেওয়া হচ্ছে ও তাদের নির্যাতন করা হচ্ছে। এখনো ধর্মের নামে রাজনৈতিক ওয়াজে নারীদের তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে; নারীর পড়াশোনা, ঘর থেকে বের হওয়া, স্বাধীনভাবে চলাচল ও কাজ করার বিরুদ্ধে ফতোয়া দেওয়া হচ্ছে; তাদের ‘যৌনবস্তু’ হিসেবে চিহ্নিত করে নোংরা-বিকৃত-অসভ্য-বর্বর প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এখনো এসব ওয়াজে দন্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সাফাই গাওয়া হচ্ছে।
যারা মীমাংসিত বিষয়গুলোকে অমীমাংসিত করার চেষ্টা করছে ও ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করছে তারা জামায়াত-বিএনপি ও জামায়াত-বিএনপি লালিত গোষ্ঠী। বাঙালি জাতির ওপর একাত্তরে পরিচালিত ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা-গণধর্ষণ-যুদ্ধাপরাধের হোতা জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি প্রকাশ্য রাজনৈতিক ঐক্য বহাল রেখেছে; বিএনপি এমনকি এর কাছের রাজনৈতিক দলগুলোর অনুরোধ-আহ্বান উপেক্ষা করে জামায়াতকে ত্যাগ করছে না।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে প্রতিপক্ষকে মেরে-কেটে কোণঠাসা করার, তাদের শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার আর সরকারি সহায়তায় দেশকে জঙ্গিবাদ, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ও আন্তর্জাতিক অস্ত্র চোরাচালানের লীলাভূমিতে পরিণত করার ভয়ঙ্কর শাসন ও রাজনীতি করছিল। এসবের বিরুদ্ধে ২০০৪ সাল থেকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন ও ঐক্যবদ্ধ সরকার গঠনের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ধারায় ২০০৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দল ও মহাজোটের প্রথম সরকার গঠিত হয়েছিল। সে সরকারের শুরুতে জাসদ দলগতভাবে মন্ত্রিসভায় না থাকলেও সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। এখনো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দল ও মহাজোট সমর্থিত সরকার তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায়; জাসদ এবারও মন্ত্রিসভায় না থাকলেও সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে।
২০০৯ সালে জাতীয় রাজনীতিতে একটা পরিবর্তনের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল; তা ছিল দুই ফ্রন্টের যুদ্ধ; রাজনৈতিক যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক যুদ্ধ। রাজনৈতিক যুদ্ধে ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার, জঙ্গিবাদ দমন, দেশ-মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও তাদের দোসরদের প্রতিহত করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনার এবং সংবিধানে চার মূলনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। যুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্টে ছিল বৈশ্বিক মহামন্দার মধ্যেও জাতীয় অর্থনীতিকে গতিশীল রাখা, উৎপাদন ও অর্থনীতিকে সচল রাখতে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ-জ্বালানি-অবকাঠামো চাহিদা পূরণ আর দরিদ্র-হতদরিদ্র মানুষকে বাঁচাতে সামাজিক নিরাপত্তা জাল বিস্তৃত করা, এবং অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী ধারায় গড়ে তোলা।
১৪ দল ও মহাজোটের নির্বাচনী বিজয় ও সরকার গঠনের পর ২০০৯ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়েই দেশ এগিয়েছে। বিএনপি-জামায়াত রাষ্ট্র-সরকার-জনগণের বিরুদ্ধে আগুনযুদ্ধ করেছে আর সীমাহীন রাজনৈতিক সন্ত্রাস-সহিংসতা-অন্তর্ঘাত-নাশকতা পরিচালনা করেছে। বিএনপি-জামায়াত-জঙ্গি মোকাবিলার যুদ্ধের মধ্যেই ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচনের পর যুদ্ধ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে; বিএনপি-জামায়াত-জঙ্গিরা কিছুটা কোণঠাসা হয়েছে, অশান্তি তৈরির ক্ষমতা কিছুটা কমেছে।
রাজনৈতিক শান্তি বজায় রাখার পাশাপাশি সংঘবদ্ধ লুটেরা-দুর্নীতিবাজ চক্র, সংঘবদ্ধ গু-াবাহিনী, সংঘবদ্ধ ধর্ষক বাহিনী ও বাজার সিন্ডিকেটের দাপট ও দৌরাত্ম্য সম্পূর্ণ ধ্বংস করা, শাসন-প্রশাসন ব্যবস্থা আরও গণতান্ত্রিক করা, ভেদ-বিভেদ-বৈষম্য-অসমতার অবসান করা, বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সমুন্নত রাখা এবং আদর্শহীনতার বিপরীতে আদর্শবাদের পুনর্জাগরণের ওপর গুরুত্বারোপ করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
পূর্ববর্ণিত আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে এখন একটি লাফ দিতে হবে; একটি উল্লম্ফন অর্জন করতে হবে। এ উল্লম্ফনের জন্য জাসদ নিচের নয়টি বিষয় জাতির বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করেছে।
[১] সুশাসন : দুর্নীতি, লুটপাট ও ক্ষমতার অপব্যবহারের চক্র ধ্বংস করে সুশাসন ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। প্রমাণ করতে হবে এসব দুর্নীতিবাজ, লুটেরা ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে নয়। ঝিকে মেরে বউকে শেখানো নয়, দুর্নীতির আসল বেগম ও সাহেবদের ধরতে হবে।
[২] শান্তি : রাজনৈতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মুক্তিযুদ্ধ ও অতীতের সব ঐতিহাসিক গণআন্দোলনে মীমাংসিত বিষয়গুলো অমীমাংসিত করার সব অপচেষ্টা বন্ধ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস নিয়ে বিতর্কের অবসান করতে হবে। পাকিস্তানপন্থার রাজনীতি তথা সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী-সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি ও তাদের পৃষ্ঠপোষক জামায়াত-বিএনপিকে রাজনীতির মাঠ থেকে চিরতরে বিদায় করতে হবে। গণতন্ত্র বা মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে দেশবিরোধী এ শক্তিগুলোর প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শন ও ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ কথা রাজনৈতিক বিদ্বেষপ্রসূত নয়, এটাই রাজনৈতিক বাস্তবতা। ইতিহাস ও তথ্য প্রমাণ করে যে জামায়াত-বিএনপি সুযোগ পেলেই গণতন্ত্রের পিঠে ছোবল হানে; এরা সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ উৎপাদন-পুনরুৎপাদনের কারখানা। গণতন্ত্রের বাগান সাজাতে হলে বন্য শূকরকে খোঁয়াড়ে আটকে রাখতে হবে; বন্য শূকরকে খোঁয়াড়ের বাইরে যেতে দিলে এরা গণতন্ত্রের বাগান তছনছ করে দেবে; অতীত তাই বলে।
[৩] সংবিধান : সংবিধান পর্যালোচনা করে সংবিধানের অসংগতি ও গোঁজামিল দূর করতে হবে। শাসন-প্রশাসনে গুণগত পরিবর্তন, রাজনীতিতে ভারসাম্য তৈরি, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, আরও গণতন্ত্র অর্জন, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র কায়েম আর জনগণের ক্ষমতায়ন করতে হলে শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী জনগণ, নারী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, আদিবাসীদের প্রতিনিধি এবং স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় সংসদে উচ্চকক্ষ গঠন করে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা ও সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন চালু করা এবং স্বাধীন সংস্থা হিসেবে জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পরিষদকে গড়ে তুলে কার্যকর স্থানীয় শাসন চালু করতে হবে। আমলা ও সামরিক কর্তৃত্বের বদলে জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় আইন-কানুনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে হবে।
[৪] সমাজতন্ত্র : দেশের শ্রমিক-কৃষক-নারী-যুবক-ছাত্রদের ভাগ্য তথাকথিত মুক্তবাজার অর্থনীতির ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। সিন্ডিকেট যেন আর বাজার-কারসাজির সুযোগ না পায়, ফসলের লাভজনক মূল্য না পাওয়ায় কৃষককে যেন কাঁদতে না হয়, ন্যূনতম জাতীয় মজুরির জন্য শ্রমিকদের যেন আর হাহাকার করতে না হয়- সেজন্য মুক্তবাজার অর্থনীতির ভ্রান্ত ও ব্যর্থ ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে সমাজের চাহিদা, বাজারশক্তির চাহিদা, উদ্যোক্তার উদ্যোগ ও সৃজনশীলতার সঙ্গে রাষ্ট্রের ভূমিকা সমন্বিত করে সংবিধান নির্দেশিত সমাজতন্ত্র লক্ষ্যাভিমুখী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। স্বাস্থ্য-খাদ্য-সুরক্ষা-শিক্ষা-ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।
[৫] শিক্ষা : বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা-নিম্নমান রুখতে হবে। শিক্ষা প্রশাসনকে দুর্নীতি ও দলবাজি মুক্ত করতে হবে। দেশপ্রেমিক নাগরিক ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। একজন শিক্ষিত যুবকও যেন বেকার না থাকে সে লক্ষ্যে দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করতে হবে। লুটপাট-অপচয় বন্ধ করে সে টাকায় বেকারদের ভাতা দিতে হবে।
[৬] ডিজিটালাইজেশন : তথ্যপ্রযুক্তির সর্বব্যাপক উত্থান গোটা দুনিয়ায় যে নতুন ভার্চুয়াল-বাস্তবতা তৈরি করেছে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে ও তা আয়ত্তে এনে এগিয়ে চলতে জাতীয় ডিজিটাল ও সাইবার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।
[৭] টেকসই উন্নয়ন : প্রাকৃতিক প্রতিবেশ-ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অভিযোজন ও গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন হ্রাসে জাতীয় সক্ষমতা অর্জনের সমন্বিত নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
[৮] মানবসম্পদ : ক্ষুদ্রায়তন বাংলাদেশ জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ঝুঁকির দিকে এগোচ্ছে। বন-নদী-খাল-বিল-জলাশয় ভরাট ও দখল হয়ে মাথাপিছু জমি ও চাষযোগ্য জমি আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ঝুঁকি ও চাপ মোকাবিলায় জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
[৯] সহযোগিতা : বিশ্বায়ন-আঞ্চলিকায়ন-বাণিজ্যায়ন- যোগাযোগায়নের দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে দেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখতে বহুমাত্রিক কৌশলের ভিত্তিতে জোরালো কূটনীতি অনুসরণ করতে হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা ব্যবহার করতে দ্রুত জাতীয় প্রস্তুতি নিতে হবে।
জাতীয় উল্লম্ফনের বর্ণিত ৯ দফার জন্য একটি শক্ত পাটাতন দরকার; আর ৯ দফার প্রথম দফাটিই হচ্ছে সে পাটাতন- সুশাসন ও আইনের শাসন। জামায়াত-জঙ্গি-বিএনপির বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধের সঙ্গে সমানতালে লড়ে যেতে হবে সুশাসন ও আইনের শাসন কায়েমের যুদ্ধে। এই হলো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের ৪৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ডাক।
লেখক : সভাপতি, কেন্দ্রীয় কমিটি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ এবং সভাপতি, তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি।