রবিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

আলুই রুখে দিতে পারত ফরাসি বিপ্লব

সাইফুর রহমান

আলুই রুখে দিতে পারত ফরাসি বিপ্লব

আলোর ফুল নয়!! আলুর ফুল। হ্যাঁ আলুর ফুলের কথাই বলছি। সময়টা ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দ। রাজা ষোড়শ লুই সবে সিংহাসনে বসেছেন। সম্প্রতি সময়ে তাঁর নিত্যদিনের পোশাক-পরিচ্ছদ ও সাজসজ্জায় নতুন একটি অনুষঙ্গ যুক্ত হয়েছে- তা হলো আলুর ফুল। আপনারা কেউ কেউ হয়তো আলুর ফুল দেখে থাকবেন। কিন্তু যারা দেখেননি তাদের চোখ ও কানের বিবাদ ভঞ্জনের জন্য বলছি, আলুর ফুলের পাপড়িগুলো হয় ধবধবে সাদার মধ্যে হালকা গোলাপি আভাযুক্ত। মাঝখানে গম্বুজের মতো গাঢ় হলুদ ঈষৎ ছোট্ট ও উঁচু হয়ে থাকা যেন আরেকটি ফুল। আলু অনেকের কাছে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সবজি হলেও আলুর ফুলের সৌন্দর্য কিন্তু অসাধারণ। যাকগে সে কথা, যা বলছিলাম; রাজা কোটের ভাঁজ করা ল্যাপেলে সাধারণত শৌখিন ও কেতাদুরস্ত মানুষ গোলাপ কিংবা কোনো ফুল গুঁজে রূপসজ্জা করেন সেখানে ষোড়শ লুই রাজদরবারে আসেন কোটের ওপর সদ্য তুলে আনা টাটকা ও তাজা আলুর ফুল গুঁজে।

রানী মেরি আঁতোয়ানেতও খোঁপায় পরেন আলুর ফুল। রাজাকে খুশি করতে রাজ অমাত্য ও আমির-ওমরারাও কোটের বোতামঘরে আলুর ফুল এঁটে হাঁসের পালের মতো ঘুরে বেড়ান রাজার চারপাশে। অনেকেই হয়তো ভাবছেন রাজার হঠাৎ এমন মতি হলো কেন যে কোটের ওপর আলুর ফুল গুঁজে রাজদরবারে কার্য পরিচালনা করতে শুরু করেছেন। এর পেছনের কারণটি হলো, ফরাসি কৃষককে আলু চাষে উৎসাহ ও ধনী-গরিব নির্বিশেষে আলু খাওয়ার জন্য এ ধরনের এক অভিনব বিজ্ঞাপনে নেমেছেন তিনি। হঠাৎ রাজার আলুপ্রীতির পেছনেও ছোট্ট একটি কাহিনি আছে।

আঠার শতকের মাঝামাঝি ফ্রান্স আর প্রুশিয়ার মধ্যে সপ্তবর্ষীয় এক যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ করার মতো আর লোকজন না পেয়ে ফরাসি রাজা দলমতনির্বিশেষে সবাইকে দড়ি বেঁধে যুদ্ধ করতে নিয়ে যান। তার মধ্যে আঁতোয়া পারমেঁতিয়ের নামে এক ফরাসি ওষুধ প্রস্তুতকারকও ছিলেন। তো হয়েছে কি, যুদ্ধের এ সাত বছরে প্রুশিয়া বাহিনী দ্বারা পারমেঁতিয়ের বন্দী হন পাঁচবার। কয়েদখানায় তাকে শুধু আলু খেতে দিত। প্রথম প্রথম আলু খেতে বিরক্ত লাগলেও ধীরে ধীরে আলুর প্রতি ভালোবাসা গাঢ় হতে থাকে পারমেঁতিয়েরের। ক্রমে আলুর প্রেমে এতই দুর্দমনীয় হয়ে ওঠেন যে বন্দীদশা থেকে ছাড়া পেয়ে দেশে ফিরে রাজা ষোড়শ লুই ও রানী মেরি আঁতোয়ানেতসহ ধনী-গরিব সবাইকে আলুর মাহাত্ম্য সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগেন পারমেঁতিয়ের। ফরাসি সাধারণ প্রজাদের আলুর স্যুপসমেত আলুর নানা উপাদেয় রান্নার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকেন। ঘটনাক্রমে আমেরিকার অন্যতম জাতির পিতা ও পরে রাষ্ট্রপতি থমাস জেফারসন সে সময় প্যারিসে বাস করছেন। আঁতোয়া পারমেঁতিয়ের আলুর মাহাত্ম্য প্রচারের সময় তিনিও ভীষণভাবে আকৃষ্ট হন। পাঠক জেনে অবাক হবেন যে আমেরিকায় এ জেফারসনই আলু জনপ্রিয় করে তুলতে ভূমিকা রাখেন। এ জন্য ইংল্যান্ডে যে আলু ভাজা শুধু ফ্রাইজ, আমেরিকায় তা ফ্রেঞ্চফ্রাইজ নামে পরিচিত। সে যাই হোক, আগের কথায় ফিরে আসি। আঁতোয়া পারমেঁতিয়ের ভাগ্য বেশ সুপ্রসন্নই ছিল বলতে হয়, কারণ বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি যখন দেশে ফেরেন তার কিছুকাল আগে ফ্রান্সের রাজা হন ষোড়শ লুই। ক্ষমতায় আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে রাজা লুই খাদ্যশ্যস্যের ওপর থেকে মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর তুলে দেন। ফলে ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরে শুরু হয় ছোট ছোট আকারে গৃহযুদ্ধ। যা ইতিহাসে ‘ফ্লাওয়ার ওয়ার’ অর্থাৎ আটার যুদ্ধ নামে পরিচিত। সব মিলিয়ে ৮২টি শহরে ৩০০-এর মতো গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। পারমেঁতিয়ের মহাশয় নিরলসভাবে ফ্রান্সের মানুষকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করতে লাগলেন এই বলে যে, ‘রুটির জন্য যুদ্ধ করা তবেই থামবে যদি জনগণ আলু খাওয়া শুরু করে।’ আমি আগেই বলেছি, জেফারসন তখন প্যারিসে অবস্থান করছেন। তিনি প্যারিসে ছিলেন বছর পাঁচেকের মতো। তিনি রাজা ষোড়শ লুইকে বোঝালেন ফ্রান্সে দুর্ভিক্ষ ও গৃহবিবাদ থামাতে যে করেই হোক আলুকে জনপ্রিয় করে তুলতেই হবে।

রাজা লুইও জেফারসনের পরামর্শ অনুযায়ী আলু নামের এ সবজিটি জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা শুরু করেন। সেই সঙ্গে রানী মেরি আঁতোয়ানেত ও রাজ অমাত্যরাও। এরই ধারাবাহিকতায় রাজা লুই প্যারিস শহরের এক প্রান্তে ৪০ একরের মতো জমিতে আলুর চাষ করেন। এটা জানা সত্ত্বেও যে দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজারা হয়তো সেগুলো তুলে নিয়ে তাদের খাদ্য চাহিদা মেটাবে। যারা ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস পড়েছেন তারা জানেন ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল খাদ্যশস্যের অপ্রতুলতা। ক্ষুধার্ত মানুষ না খেয়ে পড়ে থাকত আঁস্তাকুড়ের এক পাশে। ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে এ সময় দলবেঁধে প্যারিসের সাধারণ মানুষ হানা দেয় রাজ্যের বিভিন্ন খাদ্যগুদামে। দেশের মানুষ যখন না খেয়ে মরছে রাজপ্রাসাদে সে সময় চলছে রাশ উৎসব। জেল্লাজৌলুসের কোনো কমতি ছিল না। মানুষের হাহাকার, আর্তনাদ, হুল্লোড় শুনে রানী মেরি আঁতোয়ানেত একদিন বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তার কোনো এক পরিচারিকাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘রাস্তাঘাটে এত চেঁচামেচি কী জন্য?’ পরিচারিকা বলেন, ‘ওরা রুটির জন্য আর্তনাদ করছে।’ রানী বললেন, ‘রুটি কি নেই?’ প্রতিউত্তরে পরিচারিকা বললেন, ‘না নেই।’ রানী বললেন, ‘তাহলে ওরা কেক খায় না কেন? রুটির বদলে কেক খেলেই তো ঝামেলা চুকে যায়।’ রাজেনবর্গ কিংবা রাজ অমাত্যদের ধারণাও নেই দেশে কী চলছে। তারপর অবধারিতভাবেই ফরাসি বিপ্লব এবং সেই সঙ্গে রাজা-রানী দুজনেরই শিরন্ডেদ। ওষুধ প্রস্তুতকারক পারমেঁতিয়েরের কথা মতো ফরাসিদের আলু খাওয়ানোয় যদি অভ্যস্ত করানো যেত তাহলে হয়তো দুর্ভিক্ষের এ ভয়াবহতা থেকে ফ্রান্সের জনগণ রেহাই পেত এবং ফরাসি বিপ্লব নাও হতে পারত।

হঠাৎ আলু নিয়ে লেখার প্রয়াস এ কারণে যে এবার অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে হঠাৎ করেই আলুর দাম বেড়ে যায়। এ নিয়ে দেশের পত্রপত্রিকাগুলোতেও লেখালেখি হয়েছে বিস্তর। নভেম্বরের শুরুর দিকে পুরনো আলু ৫০-৬০ টাকা কেজি দরে আর নতুনটা ১১০ টাকায় বিক্রি হতে দেখেছি। খোঁজখবর করে জানলাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী দেশে ৪০ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৮০ লাখ টন আলু উৎপাদন হচ্ছে। সে হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর ৪০ লাখ টন আলু উদ্বৃত্ত থাকছে এবং আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে ২০-৩০ লাখ টনের মতো আলু আমরা রপ্তানি করছি প্রতি বছর। তার পরও ভোক্তাদের আলুর জন্য উচ্চমূল্য গুনতে হচ্ছে যা বেশ দুঃখজনক। বিষয়টি নিয়ে আরেকটু অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেল কোনো কারণে যে কোনো ভোগ্যপণ্যের মূল্য যদি আমাদের পাশের দেশ ভারত কিংবা পশ্চিমবঙ্গে বেড়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এ দেশে সে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। সে হোক পিঁয়াজ, রসুন, আদা, মরিচ কিংবা আলু। দুঃখের বিষয়, দেশে এসব দেখার কেউ নেই।

পৃথিবীতে আলু হলো চতুর্থ স্টেপল ফুড। গম, চাল, ইক্ষুর পর আলুই বিশ্বে সবচেয়ে প্রচলিত খাদ্য। আলুর জন্ম দক্ষিণ আমেরিকার পেরু, বলিভিয়ার আন্দিজ পর্বতমালার উচ্চ মালভূমিতে। আলু খাওয়ার ইতিহাস ২ হাজার বছরের পুরনো। কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের সুবাদে আমরা পেয়েছি বেশ কিছু পণ্য, যার মধ্যে মরিচ, টমেটো, আনারস, কামরাঙা, তামাক, আলু প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ইতিহাসবিদরা আমাদের জানাচ্ছেন প্রাচীনকালে ইনকারা সবকিছুতেই আলু খেত। সেদ্ধ আলু, পোড়া আলু, ভর্তা আলু প্রভৃতি তো ছিলই। হাড় ভেঙে গেলে কাঁচা আলুর রস লাগাত। আলু খেত খাবার হজম করার ওষুধ হিসেবে। বাতের প্রতিষেধক হিসেবে সঙ্গে নিয়ে ঘুরত আলু। মাস কিংবা বছর পর্যন্ত গণনা করা হতো আলুর ফলন কবে হচ্ছে তা হিসাব করে। সেকালে আলু সংরক্ষণের জন্য হিমাগার ছিল না বলে তারা আলু শুকিয়ে গুঁড়া করে পাউডার বানিয়ে সেই আলুমিশ্রিত আটা দিয়ে তৈরি করত নানা উপাদেয় খাদ্য। সেই ২ হাজার বছর আগে থেকেই ইনকা ও এজটেক সভ্যতার মানুষ আন্দিজ পর্বতমালার ভাঁজে ভাঁজে আলু উৎপাদন করত। একেক উচ্চতায় একেক রকম আলু জন্মাত। সে সময় আলুর এত প্রকারভেদ ছিল যে এক গ্রামে জন্মানো আলু অন্য গ্রামের মানুষ দেখে বলত, ‘এ আবার কী বস্তু রে বাবা!’ এখনো পেরুর ‘ইন্টারন্যাশনাল পটেটো সেন্টারে’ ৫ হাজার প্রকার আলু সংরক্ষিত আছে। আমার ইচ্ছা আছে যদি কোনো দিন দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে যাই তবে আলুর সে সংগ্রহশালাটি অবশ্যই দেখে আসব। প্রাচীনকালে ইনকা ও আন্দিজদের উৎপাদিত আলুর বেশির ভাগই ছিল বুনো। তার অধিকাংশই ঈষৎ বিষাক্ত। তো হয়েছে কি, শরীরের সে বিষাক্ততা দূর করার জন্য সেকালের ইনকা সভ্যতার মানুষ এক প্রকার মাটি খেত। এ প্রসঙ্গে আমার একটি স্মৃতি মনে পড়ে গেল। পাঠককে তা জানানোর জন্য বেশ উশখুশ হচ্ছে। আমি ছোটবেলায় মা-বাবার সঙ্গে প্রায়ই গ্রামে যেতাম। আমার বাড়ির সামনেই শতবর্ষী একটি বটগাছ, যা আজও বহাল তবিয়তে দন্ডায়মান। তো সে বটগাছের আশপাশের বিস্তীর্ণ অবারিত জমিতে মরিচের চাষ হতো। আর সে বটগাছ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া পাখি মরিচ খেতে নেমে পটাপট মরিচ খেত। মরিচ টিয়া পাখির খুবই পছন্দের একটি খাবার। অন্য কেউ তা লক্ষ্য করেছেন কি না জানি না। বেশ পরিমাণে মরিচ খাওয়ার পর সেসব টিয়া পাখিকে দেখতাম মাটি খেতে। আমার ধারণা মরিচের ঝাল থেকে কিছুটা রক্ষা পেতেই টিয়াগুলো মাটি খেত।  সে যাই হোক, ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে স্প্যানিশ যুদ্ধবাজদের হাত ধরে অন্য সব পণ্যসামগ্রীর মতো আলুও চলে এলো ইউরোপে। আলু ইউরোপে এলো ঠিকই কিন্তু প্রথম প্রথম আলু দেখে মানুষ ভয় পেত। সেকালের মানুষ মনে করত আলু শারীরিক উত্তেজনা ভয়ানক বাড়িয়ে দেয়। তারই পরিণাম সিফিলিস আর কুষ্ঠ। দীর্ঘদিন জলে ভাসা নাবিকরা বিভিন্ন বন্দরে নেমে এসব রোগের জীবাণু শরীরে নেয়, ঘরে ফিরে সুবোধ ছেলের মতো দোষ চাপায় আলুর ঘাড়ে। কারণ তখনো আলু ছিল একেবারে অপরিচিত। অচিরেই সে ভুল ভেঙে যায়। আলু তার গুণ দেখিয়ে স্পেনের সেনাবাহিনীর রোজকার রসদে পাকাপোক্ত জায়গা করে ফেলে। ওদিকে স্পেন সাম্রাজ্য তখন বিক্ষিপ্তভাবে সারা ইউরোপেই ছড়িয়ে। সেনাবাহিনীর পিঠে চেপে আলু ছড়িয়ে পড়ে গোটা মহাদেশে।

জার্মানির রাজা ফ্রেডরিখ উইলিয়াম আলু খেয়ে ভীষণ মোহিত হয়ে পড়েন। তিনি প্রজাদের আদেশ দেন আলু চাষ করে সকাল-বিকাল খেতে। অবাধ্য হলেই নাক কেটে নেবেন! নাক যাওয়ার ভয়ে সবাই মিলে আলু চাষ শুরু করল। দেশে ও দেশের বাইরেও আলু উপচে পড়তে লাগল। প্রুশিয়ার লোকে যুদ্ধ ক্ষেত্রেও রসদ হিসেবে আলু নিয়ে যেতে শুরু করল।

যদিও বিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক উইলিয়াম শেকসপিয়ার তাঁর একটি নাটক ‘দ্য মেরি ওয়াইফস অব উইন্ডসর’- এ লেখেন, Let the sky rain potatoes. অর্থাৎ আকাশ থেকে আলুবৃষ্টি হোক। কিন্তু ইংল্যান্ডে আলু জনপ্রিয় হতে বেশ খানিকটা সময় লাগে। আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ডে আলু নিয়ে আসার কৃতিত্বটা স্যার ওল্টার র‌্যালে ও বিখ্যাত নাবিক স্যার ফ্রান্সিক ড্রেকেরই প্রাপ্য। র‌্যালে যখন আমেরিকা থেকে আলু নিয়ে এলেন ইংল্যান্ডে তখন রানী প্রথম এলিজাবেথের রাজত্ব। রানী আলু দেখে বললেন, এটা আবার কী? ঝুড়িভর্তি আলু তিনি পাঠিয়ে দেন রাজহেঁশেলে। রানী এলিজাবেথের বাবুর্চি আগে কখনো আলু দেখেননি বিধায় ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন। সে আলু কীভাবে রান্না হবে বুঝতে না পেরে আলুকে আবর্জনা ভেবে ফেলে দিয়ে আলু গাছের পাতাগুলো সেদ্ধ করে সেগুলো তুলে দেন রানীর পাতে। সেই শাকভাজা খেয়ে রানীর কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা অবশ্য জানা যায়নি। পরে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের একদল পাদরি যান স্পেনের ক্যানারি দ্বীপে। তারা সেখানে আলুর রমরমা দেখে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন।

ভারতবর্ষে কাগজ-কলমে প্রথম আলুর উল্লেখ পাওয়া যায় ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে। নুরজাহানের ভাই, মমতাজমহলের বাবা আসফ খান-প্রদত্ত ব্রিটিশ দূত টমাস রোর ভোজসভায় যেসব খাবারের কথা আছে তার মধ্যে আলুও ছিল। ১৭৮০ সালেও আলুকে গণ্য করা হতো অতি মূল্যবান সবজি। বিশেষ ভোজসভা শেষে ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁর মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের নানান মূল্যবান সামগ্রীর সঙ্গে এক ঝুড়ি করে আলুও দিতেন। ১৮৩০-এর দশকে দেরাদুনের উঁচু মালভূমিতে আলুর চাষ করেন ক্যাপ্টেন ইয়ুনস ও মিস্টার শোর। কলকাতায় ১৭৮০-এর দশকেই ইংরেজের রান্নাঘরে আলু, কড়াইশুঁটি ও বিন অন্যতম সবজি ছিল। কিছু উচ্চবিত্ত বাঙালি পরিবারে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করলেও সাধারণ বাঙালির ঘরে উনবিংশ শতকের প্রথমে আলু, পিঁয়াজ ও মসুর ডাল ছিল ব্রাত্য। যদিও কয়েক দশকের মধ্যেই দ্রুত বাঙালির হেঁশেলে ঠাঁই করে নেয় আলু। প্রাচীন বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ‘রন্ধন-প্রণালি’ গ্রন্থেও দেখা যায় আলুর কোনো ব্যবহার নেই। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য মনসামঙ্গল কাব্যে অনেকে হয়তো আলুর উল্লেখ দেখে ভাববেন আলু হয়তো বাংলায় সেই মধ্যযুগ থেকেই ছিল। যেমন কবি বিজয়গুপ্ত লিখেছেন, ‘বড় বড় ইচা মৎস্যের ফেলাইয়া তালু/তাহাদিয়া রান্ধিলেক সঙ্কচুর আলু।’ কিংবা ‘বড় বড় কই মৎস্য করিয়া ভাগ ভাগে/তাহা রান্ধিল লাউ আলু কচুর লগে।’ সংস্কৃত ‘আলু’ শব্দের অর্থ ছোট ঘটি বা গাড়ু। আকৃতিগত মিল থেকেই সবজিটির এমন নাম। অনেক পরে ‘আলু’ বলতে সাধারণ আলুও এ নামের সঙ্গে সমার্থ হয়ে যায়।

আলু রপ্তানির সবচেয়ে উপযুক্ত সময় ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ, কারণ আমদানিকারকরা হিমাগারে সংরক্ষিত আলুর চেয়ে ফ্রেশ আলুই বেশি পছন্দ করে। আলু সংগ্রহের পর থেকে কিছু দিনের মধ্যে এর আকারে কিছু অস্বাভাবিক অবস্থা (deformations) দেখা যায়, বিশেষ করে হিমায়িত আলু নির্দিষ্ট তাপমাত্রার নিচে রাখলে রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে মিষ্টতা বৃদ্ধি পায় ও অন্যান্য গুণগতমানের অবনতি ঘটে। এ জন্য দীর্ঘদিন ধরে কৃষক সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, আলু হিমঘরে সংরক্ষণ না করে সরকার নিজেই যদি ফেব্রুয়ারি, মার্চে ন্যায্য মূল্যে কৃষকের কাছ থেকে আলু কিনে তা রপ্তানি করে তবে সরকার ও কৃষক উভয়েই লাভবান হয়। কিন্তু পরিহাসের বিষয় সরকার কৃষকের কথা না শুনে শুনছে আলু বিশেষজ্ঞদের কথা! এ প্রসঙ্গে আমার একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। বিখ্যাত সাহিত্যিক দ্বিজেন্দ্র লাল রায়, যাঁকে আমরা ডি এল রায় নামেও চিনি, তখন তিনি কুষ্টিয়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চরম বিরোধ থাকলেও একসময় বেশ বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক ছিল। প্রায়ই গড়াই নদী পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথের বাড়ি বেড়াতে আসতেন দ্বিজেন্দ্র লাল রায়। রবীন্দ্রনাথ সে সময় শিলাইদহের কুঠিবাড়ীতে বিশাল এক বাগান করেন। সে বাগান দেখে হইহই করে ওঠেন ডি এল রায়। ডি এল রায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার আগে ব্রিটিশ সরকারের বৃত্তি নিয়ে বিলেত যান কৃষিবিদ হতে। সময়মতো পড়াশোনা শেষ করে ফিরে আসেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তখনো ভারতে কৃষি প্রশাসন গড়ে তুলতে পারেনি। তাই ডি এল রায়কে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। রবীন্দ্রনাথের বাগান দেখে তিনি তাঁকে বাগানের এক কোনায় গোল আলু চাষের পরামর্শ দেন। এ দেশে সে সময় গোল আলুর চাষ সেভাবে শুরু হয়নি। তবু শিলাইদহের কয়েকজন চাষি আলু চাষ করতেন। তাঁর মধ্য থেকে রবীন্দ্রনাথ এক চাষিকে ডেকে পাঠান। সেই চাষির কাছ থেকে আলুর বীজ নিয়ে সেগুলো বপন করেন ডি এল রায়ের পরামর্শ অনুযায়ী। তখন সেই চাষি বললেন, ‘করছেন কী মশাই! এভাবে আলু লাগালে তো আলু জন্মাবে না।’ রবীন্দ্রনাথ পড়লেন ভারি বিপদে। একদিকে অভিজ্ঞ চাষি, অন্যদিকে ডিগ্রিধারী কৃষিবিদ- কার কথা শুনবেন। শেষমেশ ডি এল রায়ের পরামর্শমতোই লাগানো হলো আলু। পরে দেখা গেল রবীন্দ্রনাথ যে পরিমাণ আলুবীজ বপন করেছিলেন সেটাই ফিরে আসেনি। সুতরাং চিরতরে সমাধি ঘটল আলু চাষি রবীন্দ্রনাথের।

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

ইমেইল :  [email protected]

সর্বশেষ খবর