দুজন সফল মানুষ একই সঙ্গে চলে গেলেন। জগতের রীতি অনুযায়ী সবাই যাবে। কীভাবে কে যাবে সেটাই বড় কথা। আগের দিন সুরেশ্বর কার্তিকপুরের জয়নুল হক সিকদার, পরদিন হবিগঞ্জের সফিকুল হক চৌধুরী। জয়নুল হক সিকদার আমার থেকে ১২ বছরের বড়, সফিকুল হক চৌধুরী বছর কয়েক ছোট। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে প্রতিরোধ যুদ্ধে হবিগঞ্জ-সুনামগঞ্জের হাওর-বাঁওড়ে বিস্তর ঘোরাফেরা করেছি। ভদ্রলোককে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না, নাম শুনেছি। বিশ্বজোড়া ক্ষুদ্র ঋণের তাঁর কারবার। অন্যদিকে জয়নুল হক সিকদার আমার খুবই পরিচিত। লতিফ ভাইয়ের বন্ধু মোহসীন বুলবুল ভাই জয়নুল হক সিকদারের খুবই আস্থাভাজন প্রিয় মানুষ ছিলেন। বিশেষ করে জয়নুল হক সিকদারের ভাতিজা এস এম রেজা, যাকে প্রায় সবাই দুম্বা রেজা বলে জানত। একসময় আমাদের সবার প্রিয় দুম্বা রেজার সঙ্গে ’৬৮ সালে ঢাকা জেলগেটে আমার প্রথম দেখা। কারণ সে সময় লতিফ ভাই পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে ঢাকা জেলে ছিলেন। সেই থেকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় যা আমৃত্যু ছিল। এস এম রেজার চাচা হিসেবে একসময় ইপিআরের হাওয়ালদার জয়নুল হক সিকদারের সঙ্গে পরিচয়। আমার সঙ্গে যখন পরিচয় তখন তিনি বেশ নামিদামি মানুষ। কিন্তু যতবার দেখা হয়েছে ততবার আপনজনের মতো ব্যবহার করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সোনার বাংলা প্রকৌশলিক সংস্থার ফরিদপুর আরকান্দি ব্রিজ জয়নুল হক সিকদার নিয়েছিলেন। সেখানে আমাদের অনেক টাকার রড-সিমেন্ট-ইট-পাথর ছিল। আমাদের কোম্পানির পরিচালক আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিমকে যে টাকা দেওয়ার কথা ছিল হয়তো সব দেননি বা তখন দিতে পারেননি। কিন্তু ’৯০-এর ১৬ ডিসেম্বর আমি দেশে ফিরলে বাড়ি এসে কখনোসখনো অনেক টাকা দিয়ে যেতেন। ধনবানদের মধ্যে জহুরুল ইসলাম সেই ’৬২ সাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কখনো ভোলেননি। হাজার হাজার লাখ লাখ টাকা দিয়েছেন। জয়নুল হক সিকদারও ছিলেন অনেকটা তেমনই। আমরা যখন প্রতিরোধযুদ্ধে ছিলাম তখন কলমাকান্দা উপজেলায় সীমান্তের পাশে তাঁর বেশ বড়সড়ো ব্রিকফিল্ড ছিল। প্রায়ই তাঁর লোকজন ধরা পড়ত। সিকদারের নাম বলে ছাড়া পেয়ে যেত। এ সেই ১৯৭৬-৭৭ সালের কথা। তখন রন হক ও দিপু হক সিকদার কতটুকু বলতে পারব না। ’৯০-এ দেশে আসার পর সব সময় তাঁকে একজন পরমহিতৈষী হিসেবেই পেয়েছি। বীর মুক্তিযোদ্ধা আমাদের পোকামারা খোকার মেয়ে লিমার সিকদার মেডিকেলে পড়ায় যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিলেন। সেই প্রিয় আপন মানুষ হঠাৎই চলে গেলেন। তাঁর ছেলে রন হক সিকদার বাবার লাশ ঢাকায় আসার আগে দেশে ফেরায় গ্রেফতার হয়েছিল। বাবার মৃত্যুর কারণে আদালত তাকে ১২ মার্চ পর্যন্ত জামিন দিয়েছে। আদালত যথার্থ করেছে। একজন অভিযুক্ত আপনজনের মৃত্যুতে জেলে থাকলেও প্যারোল পেতে পারে। আর এ তো একজন নামিদামি মানুষ। তার বাবার মৃত্যুর কারণে জামিন দেওয়া যথাযথ হয়েছে। একেই বলে আইনের শাসন। কিন্তু সব ক্ষেত্রে কোর্ট-কাচারির এ রকম দৃঢ়তা দেখি না। আইন-আদালত ভালো থাকলে, মানুষের আস্থায় থাকলে দেশের অর্ধেক অশান্তি এমনিতেই চলে যেত।
যাক, সারা সপ্তাহ যা নিয়ে ভাবছি তাই এবার বলি। এমনিতেই মুক্তিযোদ্ধারা ভালো নেই। জামুকা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে খুব একটা ভালো করছেন না। আমার মনে হয়, যা তারা করছেন তার জন্য তাদের গঠন করা হয়নি। কমিটি করা হয়েছে নানা কারণে- এখনো যদি কেউ বাদ পড়ে থাকেন তাদের যাচাই-বাছাই এবং চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত করা। ১০-১৫-২০ বছর আগে বা তারও আগে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের আবার যাচাই-বাছাই তাদের কাজ নয়। আর যাচাই-বাছাইয়ের পদ্ধতি অনেকটাই ত্রুটিমুক্ত নয়। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো দফতরে গিয়ে অসহায়ের মতো ভিড় করা জাতির জন্য সম্মানজনক নয়। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের গর্ব। তাদের যদি কেরানি-পিয়নকে ঘুষ দিতে হয়, দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয় তাহলে গৌরবের কী থাকে? একবার যারা মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছেন তাদের নিয়ে যত কম নাড়াচাড়া করা হবে ততই মঙ্গল। এরা কেউ দেশের সম্পদ লুটপাট করেনি। যে সামান্য ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা পায় তাতে দেশ তলিয়ে যাবে না। এখন ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ সিটির সুইপারের বেতনও ৩০-৪০ হাজার, পুলিশের কনস্টেবলের বেতন ২০-২২ হাজার। তারা যখন অবসরে যায় তাদের তখন বেতন দাঁড়ায় ৫০-৬০ হাজার। আর ১০-১২ হাজার টাকা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী দিতে এত অসম্মান আল্লাহ সইবে না। তাই মাননীয় মন্ত্রী আপনাকে বলি, জামুকা সম্পর্কে একটু যত্নবান হোন, যা করার তা করুন। কিন্তু ভালো করতে গিয়ে চুলকিয়ে ঘা করবেন না, যন্ত্রণা হবে। আপনি ভালো করেই জানেন আপনাকে আমি খুবই ভালোবাসি, সম্মান করি। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী বহুবার বলেছেন, আপনি আমাকে অসম্ভব সম্মান করেন। তিনি বলতেন, ‘বজ্র, আ ক ম মোজাম্মেল তোকে এত সমীহ করে কেন? তোর কথা শুনলে উতালা হয়ে যায়।’ বড় ভাইকে বলেছি, তিনি কেন আমার জন্য উতালা হন তা তাঁকেই জিজ্ঞেস করুন। লতিফ ভাই বলেছেন, ‘বজ্র, আমি মোজাম্মেলকে জিজ্ঞেস করেছি। ও বলেছে, কাদের ভাই প্রত্যক্ষ যোদ্ধা। তাঁকে সম্মান করব না তো কাকে করব?’ কিছু দিন আগে আপনার কাছে গিয়েছিলাম। সারা জীবনে একবার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ৬০-৭০ হাজার টাকা কল্যাণ ট্রাস্টে চিকিৎসা বিল পাঠিয়েছিলাম, তা পেয়েও ছিলাম। তাই মেয়ের চিকিৎসা বিল পাঠিয়ে ছিলাম যা এখনো পাইনি। কেউ কেউ বলছে, শুধু মুক্তিযোদ্ধাই চিকিৎসা ভাতা পাবেন। তার পরিবারের কেউ পাবে না। যদি আইনে এমনটা থাকে আমি ভাবতে যাব কেন? আর যদি মুক্তিযোদ্ধা বলতে পরিবার বোঝায় তাহলে আমার মেয়ের চিকিৎসা বিল না পাওয়া খুবই দুর্ভাগ্যজনক। যাক, এসব ব্যক্তিগত কথা বলে আপনাকে বিব্রত করতে চাই না। কিন্তু যে কারণে দেশ জ্বলে উঠতে পারে সে বিষয়ে না বলে পারছি না। গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই বন্ধ করুন। যদি কারও নামে কোনো অভিযোগ আসে তা গোপনে খোঁজখবর করুন। আর যিনি অভিযোগ করছেন তিনি কী করে জানেন যে যার নামে অভিযোগ করছেন তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন। একজন মুক্তিযোদ্ধাও তার এলাকার কথা খুবই সামান্য বলতে পারবেন- কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে না। ইচ্ছে হলো বলে দিলাম এটা কোনো ভালো কথা নয়। মুক্তিযুদ্ধ তো বলে কয়ে হয়নি, স্বাধীনতাবিরোধীদের দেখিয়েও হয়নি। তাই কেউ বলল ‘মুক্তিযোদ্ধা না’ শুনে দাঁত কেলিয়ে হি হি করে উঠলাম তা কী করে হয়? আর ‘অমুক মুক্তিযোদ্ধা না’ এটা যিনি বলবেন তাকে আগে যাচাই-বাছাই করা দরকার তিনি কে, যুদ্ধের সময় কোথায় ছিলেন, কী তার ভূমিকা। মুক্তিযোদ্ধার ব্যাপারে কারও অভিযোগ অসত্য বলে প্রমাণিত হলে অভিযোগকারীর কয় বছর জেল এবং কত টাকা জরিমানা এটার নির্দিষ্ট বিধান থাকা দরকার। আমার জানা মতে ‘অমুক মুক্তিযোদ্ধা না’ এসব বলে কাউকে কাউকে সত্যিই হেরাজ করা হচ্ছে। কিন্তু যারা বা যে অভিযোগ করেছে তার কোনো খবর নেই। আমার জাহাজমারা কমান্ডার হাবিবুর রহমান বীরবিক্রমের এবার যাচাই-বাছাইয়ে নাম এসেছে। কি দুর্ভাগ্য! ’৭৩ সালে গেজেটে বীরবিক্রম খেতাব পেয়েছে তার যদি এখন জামুকার কল্যাণে যাচাই-বাছাইয়ে যেতে হয় তাহলে তার বেঁচে থেকে লাভ কী? আর হাবিবুর রহমান বীরবিক্রম ১০-১২ বছর আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ঘাটাইলের বাছেত মাস্টার, তাঁর ভাতা বন্ধ। কে বা কারা অভিযোগ করেছে, বাছেত মাস্টার নাকি মুক্তিযোদ্ধাই না। বাছেত কাদেরিয়া বাহিনীর একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। এসব অনিয়মের প্রতিকার কোথায় চাইব? সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারাই বা কোথায় চাইবে? মুক্তিযুদ্ধের মহিমা যাতে অম্লান থাকে, মুক্তিযোদ্ধারা যাতে সমাজের কাছে হাসির পাত্র না হয় সে জন্য কথাগুলো বলছি। আপনি ভালো করেই জানেন, সত্য বলতে কখনো আমার বুক কাঁপে না। নিজের বিরুদ্ধেও সত্য বলতে আমি কখনো পিছপা হইনি, যত দিন বেঁচে থাকব তত দিন কখনো পিছপা হব না।
বীরউত্তম জিয়াউর রহমান অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর খুনের আসামি হতে পারেন, এ নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু যেসব মহাপন্ডিত বঙ্গবন্ধুর খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত বলে জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা নন অথবা তাঁর বীরউত্তম খেতাব কেড়ে নেওয়া যাবে- এসব যারা ভাবেন তারা আহম্মকের স্বর্গে বাস করছেন। প্রদত্ত খেতাব কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। এমনকি যে সরকার দিয়েছে সে সরকারেরও নেই। মুক্তিযুদ্ধ যেমন দয়া নয়, মুক্তিযোদ্ধাও তেমনি কারও করুণা নয়। মুক্তিযোদ্ধা এবং যুদ্ধ দুটিই অর্জন। তারপর আবার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা এ তো মহা অর্জন। এখানে হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে। তাই বিনয়ের সঙ্গে আপনার কাছে অনুরোধ, যা কিছু করুন এসব নিয়ে নাড়াচাড়া করবেন না। আপনারা খুব বেশি নিরাপদে নেই। কতটা দুশ্চিন্তা এবং অশান্তিতে আছেন তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করবেন। তাই এ সংঘাতের রাস্তা ভুলে যান। জিয়াউর রহমান বীরউত্তম এবং অন্য বীরউত্তম তাঁরা যত দিন বাংলাদেশ থাকবে তত দিনের জন্য বীরউত্তম। যাঁরা বীরবিক্রম, বীরপ্রতীক তাঁরাও তত দিনের জন্য। কারও ইচ্ছায় একবার গেজেট করলাম আরেকবার কেটে দিলাম এসব হওয়ার নয়। যদি দয়া করে আপনি না শোনেন নিশ্চয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রিয় বোনকে বলব। তাঁর এখন যে রাজনৈতিক গভীরতা তাতে নিশ্চয়ই তিনি অন্য কথা শুনুন আর না শুনুন আমার এ কথা অবশ্য অবশ্যই শুনবেন। তাই মেহেরবানি করে জিয়াউর রহমান বীরউত্তমের খেতাব নিয়ে, তিনি মুক্তিযোদ্ধা কিনা এসব নিয়ে পানি ঘোলা করবেন না- এটা কোনো হুঁশিয়ারি নয়, একেবারে বিনীত অনুরোধ।
লেখক : রাজনীতিক।
www.ksjleague.coms