ভারতবর্ষের গণতন্ত্র সন্ত্রাসবাদ ও সরকারের সব দিকের অবহেলার ফলে আজ আক্রান্ত। আক্রান্ত ১৩৮ কোটি মানুষ। পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন পর্বে পশ্চিমবঙ্গের ঘটনাবলি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে সুনামি বেগে করোনার আক্রমণে বেড়েছে মৃতের সংখ্যা। প্রথম পর্যায়ে কিছুটা সামাল দেওয়া গেলেও দ্বিতীয় পর্যায়ে করোনা আক্রমণ দেশকে কোন পথে নিয়ে যাবে সে বিষয়ে বিজ্ঞানী-চিকিৎসক কেউ কিছু বলতে পারছেন না। ১৫ এপ্রিল এ লেখা যখন লিখছি, বেলা ৩টায় খবর এলো বিগত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ১৭ হাজার ৩৬৩। প্রথম দফায় যিনি কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন, সেই দিল্লির এইমসের ডিরেক্টর (করোনা বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত) রণদীপ গুলেরিয়া মনে করেন, দ্বিতীয় দফায় যে করোনা আসবে সে ব্যাপারে সরকার কোনো কর্মসূচি নেয়নি। এখন সারা ভারতবর্ষে কোভ্যাক্সিন ও কভিশিল্ড- দুটি টিকার কোনোটিই রাজ্যগুলোয় পাওয়া যাচ্ছে না। কলকাতায় করোনা ভ্যাকসিন রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এক বেসরকারি টিভি চ্যানেলে বলেন, করোনার টিকার ভাঁড়ার শূন্য। অক্সিজেন সিলিন্ডারও মিলছে না। কলকাতায় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলো থেকে ঘন ঘন সরকারকে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে ভ্যাকসিন চাই। ভ্যাকসিন দিন। করোনা মোকাবিলায় কেন্দ্র যেমন ব্যর্থ, তেমনই ব্যর্থ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, দিল্লির দাদা ও বাংলার দিদি একই মুদ্রার দুই পিঠ। মানুুষকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া, মানুষের জীবন নিয়ে খেলা তাঁদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। এর পরিণাম যে কী সে ব্যাপারে চিকিৎসক বা চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা কোনো দিশা দেখাতে পারছেন না লাখ লাখ রোগীকে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, হাসপাতালগুলো থেকে বলা হচ্ছে এবার করোনার চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে হবে। ইতিমধ্যে টিকার উৎসব শুরু করে দিয়েছেন মোদি। যেন তিনি বিশ্ব জয় করে ফেলেছেন। চুপ করে বসে নেই প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। মোদি ক্ষমতায় এসেই কংগ্রেসমুক্ত ভারত করতে চেয়েছিলেন। আর দিদি চাইছেন বিরোধীশূন্য পশ্চিমবঙ্গ। এরা দুজনই নিজেদের গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক বলে দাবি করেন।
মোদির টিকা উৎসব : দেশে করোনা টিকার অভাব দেখা দিয়েছে। কোভ্যাক্সিনের উৎপাদক ভারত বায়োটেক এবং কভিশিল্ডের উৎপাদক সেরাম ইনস্টিটিউট সিদ্ধান্ত নিয়েছে উৎপাদন বাড়ানোর। তবু খুব শিগগির এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া মুশকিল বলেই মনে করা হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর টিকা উৎসব কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কারণ টিকা বণ্টন নিয়ে প্রথম থেকেই কেন্দ্রীভূত নীতি নিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। কোন রাজ্যকে কত প্রতিষেধক দেওয়া হবে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রই। খোলাবাজার থেকে রাজ্যগুলোকে টিকা কিনতে দেওয়া হয়নি। বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোকে বেশি বেশি করে প্রতিষেধক দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষেধক নিয়ে এসব দুর্নীতির কারণেই করোনা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে বলে ধারণা ওয়াকিবহাল মহলের।
![](/assets/archive/images/Print-Edition/2021/April/18-04-2021/bd-pratidin-4-2021-04-17-02a.jpg)
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে চলতি নির্বাচনের পাঁচ দফা সম্পন্ন হয়েছে, বাকি আর তিন দফা। ক্ষমতা দখল করার জন্য প্রধানমন্ত্রী বৈশাখের এ দাবদাহ পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকায় নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় একটা বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তাঁর দল পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী মতুয়াদের ভোটের ৭৫ শতাংশ পাবে। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন, প্রধানমন্ত্রী এ তথ্য কোথা থেকে পেলেন? কারণ ২ মের আগে তো ভোটের ফলাফল জানা যাবে না। সংযুক্ত মোর্চা (বাম, কংগ্রেস, আইএসএফ) দাবি তুলেছে, তাহলে কি ভারতের মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে তাঁর যে সম্পর্কের কথা হাওয়ায় উড়ছে সেটাই সত্যি? বিজেপি রাজ্য নেতাদের দাবি, প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের পরই মতুয়াদের কাছে একটি বার্তা এসেছে। তা হলো, বিজেপিকে ভোট দাও। এ পর্যায়ে ভারতের পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন হচ্ছে। দক্ষিণের কেরল, তামিলনাড়ু, পুদুচেরি এবং পুবের অসম ও আমাদের পশ্চিমবঙ্গ। দক্ষিণের তিনটি রাজ্যেই শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হয়ে গেছে। বাংলার নির্বাচন কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে বেশ কিছু সংঘর্ষ ঘটেছে। বোমা, গুলিতে মৃত্যু হয়েছে একাধিক। সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটেছে গত বৃহস্পতিবার কোচবিহারের শীতলকুচিতে। সেদিন মোট পাঁচজন গুলিতে মারা যান। শীতলকুচির এক ভোটার জীবনে প্রথমবার ভোট দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর নাম আনন্দ বর্মণ। বুথের মধ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে যে চারজনের মৃত্যু হয় তারা হলেন হামিদুল মিয়া (২৪), ছামিউল হক (২৭), মনিরুজ্জামান মিয়া (৩০) এবং নুর আলম হোসেন (১৮)। এরা সবাই ছিলেন পরিযায়ী শ্রমিক। ভিনরাজ্যে কাজ করতেন। ভোট দিতে বাড়ি ফিরেছিলেন। মমতা অভিযোগ করছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেই এদের গুলি করা হয়েছে। মমতা আরও বলেছেন, এটি একটি গণহত্যা।
পশ্চিমবঙ্গের আরএসএস তথা বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ দাবি করেছেন, বাকি নির্বাচনে প্রতিটি বুথেই গুলি চালানো হবে। তাঁর এ মন্তব্যের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। চর্চা চলছে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের। প্রশ্ন উঠেছে, আর কত রক্ত ঝরবে? ভারতের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুনীল অরোরা প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর খুবই ঘনিষ্ঠ। তিনি গুজরাট ক্যাডারের আইএএস অফিসার। সব বিরোধী দলের অভিযোগ, সে কারণেই তিনি বিজেপি নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করলেও কোনো বাধা দেন না। কেন বাধা দেন না, সে ব্যাপারে রাজনৈতিক মহল ও সংবাদমাধ্যমে নানা ব্যাখ্যা চলছে। ২ মে পাঁচটি রাজ্যের ফলাফল প্রকাশ হবে। আর ৩০ মে সুনীল অরোরা অবসর নিচ্ছেন। অভিযোগ উঠেছে, বিজেপির হয়ে পাঁচ বছর তিনি যে ‘কাজ’ করলেন, তার পুরস্কার হিসেবে তাঁকে কোনো একটি রাজ্যের রাজ্যপাল করা হবে।
কোচবিহারে নির্বাচন শুরুর ৪৮ ঘণ্টা আগে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা মূল্যের ৫০০ টাকার জালনোট ধরা পড়েছে। একই দিনে জালনোট ধরা পড়েছে মালদায়ও। এসব জালনোট নির্বাচনে ভোটারদের কেনার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছিল বলে অভিযোগ।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে নোটবন্দীর সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন, বাইরে থেকে জালনোট আসা বন্ধ করতে তিনি এ নোটবন্দী করলেন। কিন্তু কত কোটি টাকার জালনোট তিনি ধরলেন, সে হিসাব দেননি চার বছর পরও।
দিল্লির দাদা এবং বাংলার দিদি ক্ষমতার লোভে যে ধর্মীয় মেরুকরণ শুরু করেছেন তার পরিণাম কী হবে, অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কেউ জানে না। এভাবে চলতে থাকলে ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশেরই বিপদ।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক [ভারত]।