বৃহস্পতিবার, ২০ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

এত মৃত্যু প্রাণে সয় না

তসলিমা নাসরিন

এত মৃত্যু প্রাণে সয় না

১. যে কারণে আমি বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়াই, যে কারণে আমি পাকিস্তানের ক্রিশ্চান, শিয়া, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়াই, যে কারণে আমি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অত্যাচারিত ইহুদিদের পক্ষে থাকি, সেই একই কারণে আমি ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়াই, ফিলিস্তিনিদের পক্ষে থাকি। কারণটির নাম মানবতা। ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যারা জঙ্গি, না, আমি তাদের মোটেও সমর্থন করি না। আইসিস, আল কায়দা, তালিবান, বোকো হারাম ইত্যাদি প্রচুর জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রচণ্ড বিরোধী আমি। এমনকী যে কোনও ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীরও আমি বিরোধী। উগ্র জাতীয়তাবাদীদেরও আমি পছন্দ করি না। নাৎসিদের যতটা নিন্দে করি, ততটা নিন্দে ইসরায়েলের উগ্র জাতীয়াবাদীদেরও করি। ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে ক’টা হামাস নেতার মৃত্যু হয়েছে জানি না, তবে প্রচুর নিরপরাধ নারী-পুরুষ এবং শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ক’টা হামাস নেতার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে জানি না, তবে সাধারণ মানুষের বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে, এমনকী আলজাজিরা, এসোসিয়েট প্রেসের মতো নামি মিডিয়ার বহুতল অফিসবিল্ডিংও ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে ওই বিল্ডিং থেকে হামাস তার জঙ্গি কার্যকলাপ চালাতো। এসোসিয়েট প্রেসের সাংবাদিক বলেছেন, ওই বিল্ডিংয়ে তাঁরা ১৫ বছর যাবৎ আছেন, ওখানে হামাসের অস্তিত্বের কোনও প্রমাণ তাঁরা পাননি। কিন্তু ইসরায়েল গুঁড়িয়ে দেবে মিডিয়ার বিল্ডিং, কার কী বলার আছে? না, কারও কিছু বলার নেই। রকেট হামলায় ১০ জন মরছে তো বোমাবর্ষণে কয়েকশ জন মরছে। মনে আছে ২০১৪ সালে ২২০০ জন গাজাবাসী ফিলিস্তিনি মরেছিল ইসরায়েলি বোমায়, বেশির ভাগই ছিল সাধারণ মানুষ। মৃত্যু হয়েছিল ৫৫০ জন শিশুর।

ট্রাম্প উগ্রবাদী, বাইডেন উদার-এই ভেবে যারা বাইডেনকে সমর্থন করেছে, তারাও নিশ্চয়ই সেদিন বাইডেনের কঠোর কণ্ঠস্বরে অবাক হয়েছে, যখন বাইডেন বললেন হামাসের রকেট হামলার বিরুদ্ধে ইসরায়েল নিজেকে যে করেই হোক রক্ষা করবে। রকেট হামলাকে প্রতিরোধ করার জন্য যে লোহার ডোম, সেটি আমেরিকারই দেওয়া। নিজেকে রক্ষা করার নাম ডিফেন্স, কিন্তু অন্যকে, বিশেষ করে নিরপরাধ মানুষকে, হত্যা করার নাম কিন্তু অফেন্স। অফেন্সকে দেখছি বেশ ডিফেন্স নামে ডাকা হচ্ছে আজকাল। ইসরায়েল ধনী দেশ, কিন্তু তারপরও আমেরিকা প্রতি বছর কয়েক বিলিয়ন ডলার দেয় ইসরায়েলকে। ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠন হওয়ার পর থেকে, প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের সময় থেকেই, ইসরায়েলকে সমর্থন করছে আমেরিকা। এটিই আমেরিকার নীতি। তেলের দেশগুলোর মাঝখানে একটি বন্ধুরাষ্ট্রের তখন দরকার ছিল আমেরিকার। তাছাড়া ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিক্যান এই দুই দলের নেতাদের জন্য নির্বাচনের সময় ইসরায়েল-পন্থি আমেরিকানদের কাছ থেকে বিরাট অংকের ডোনেশন আসে। নির্বাচনে জিতে নেতাদের পক্ষে সম্ভব নয় দান অস্বীকার করা বা আমেরিকার এতকালের ট্রাডিশান না মানা। তবে ডেমোক্রেটদের মধ্যে যারা মানবাধিকারে বিশ্বাসী, তাঁদের চাপের কারণেই বাইডেন পরে বলেছেন গাজায় বোমাবাজি যেন বন্ধ হয়।

ফিলিস্তিনি আর ইসরায়েলের সংঘর্ষ আমার দেখতে ইচ্ছে করে না। করে না কারণ একদিকে মহাশক্তিধর, আরেকদিকে মহাদুর্বল। একদিকে আধুনিক যুদ্ধ বিমান, মিসাইল, আরেকদিকে ইটপাটকেল, রকেট। এই দুইয়ের মধ্যে কোনও যুদ্ধ হতে পারে না। যা হতে পারে, তা হলো একের ওপর আরেকের নির্যাতন। দীর্ঘকাল যাবৎ তাই চলছে ফিলিস্তিনিদের ওপর। ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র তৈরি করা ছাড়া কোনও সমাধান নেই। ফিলিস্তিনি এবং ইসরায়েল- এই দুই পক্ষকে কিছু ছাড় দিতে হবে। অত্যাচারিত ইহুদিদের জন্য ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র তৈরির যেমন দরকার ছিল, ফিলিস্তিনিদের জন্যও একটি রাষ্ট্রের দরকার ছিল এবং এখনও আছে। ৭২ বছর পার হয়ে গেল, এটি এখনও তৈরি হচ্ছে না। ফিলিস্তিনিদেরও কিছু জায়গা ছেড়ে দিতে হবে ইসরায়েলের জন্য, ইসরায়েলকেও জায়গা কিছু ছেড়ে দিতে হবে ফিলিস্তিন তৈরির জন্য। কিন্তু মুশকিল হলো কেউ কিছুই ছাড়তে চায় না। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ মনে করে ওদের সমস্যার কোনও সমাধান নেই। আমি মনে করি মানুষ চাইলেই গুরুতর সব সমস্যার সমাধান করতে পারে। এই চাওয়াটারই অভাব।

২. কোভিড থেকে বাঁচার জন্য প্রতিষেধক নিতে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে মানুষ এখন অস্থির হয়ে উঠছে। ভারতে এমন কিছু লোক আছে যারা গায়ে গোবর মাখলে এবং গোমূত্র পান করলে করোনাভাইরাস থেকে রেহাই পাওয়া যাবে বলে বিশ্বাস করে। গঙ্গার জলে ডুব দিয়ে এলেও করোনা থেকে বাঁচা যাবে বলে কুম্ভ মেলার গঙ্গা-স্নানে যাওয়া অনেকেরই গভীর বিশ্বাস। করোনাকে বিদেয় করার নানা কিছু করেও মানুষের কোভিড ধরা পড়ছে। তারপরও কিন্তু গঙ্গা-স্নানের ওপর বা গোবর-গোমূত্রের ওপর যে বিশ্বাস, তা একটুও কমছে না মানুষের। গোশালাগুলোয় এখন ভিড় বাড়ছে। কোভিড যেন ধারে কাছে না ঘেঁষতে পারে, সেজন্য সারা গায়ে গোবর মেখে বসে থেকে মাথায় গোদুগ্ধ ঢেলে স্নান করছে, আর গোমূত্র পান করছে মানুষ। বিশ্বাস মানুষকে দিয়ে অবিশ্বাস্য সব কাজ করিয়ে নিতে পারে। এদের জন্য আমার মায়া হয়। বিজ্ঞানে বিশ্বাস করলে পশুর বর্জ্য পদার্থ এদের পান করতেও হতো না, গায়েও মাখতে হতো না, মূল কথা, এত দুর্ভোগ পোহাতে হতো না।

ভারতীয় মেডিকেল এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট জেএ জয়লাল বলে দিয়েছেন, ‘গোবর বা গোমূত্র রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ায়-এরকম কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। গোবর গোমূত্র সেবন কিন্তু মানুষের শরীরে নতুন রোগ সৃষ্টি করতে পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।’ আমি জানি না জয়লালবাবুর এই উপদেশে আদৌ কোনও কাজ হবে কিনা। যদি কাজ হয় তাহলে নিশ্চয়ই মাস্ক পরবে মানুষ, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখবে। মুশকিল হলো, ধর্ম কর্ম করার পর অনেকে ভাবে যে ঈশ্বর ভগবান তাদের বাঁচাবে।

কুম্ভ মেলা, রাজনৈতিক সভা, নির্বাচনের মিছিল, করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট-সব কিছু মিলিয়েই কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গ এমন ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। লাশের লাইন লেগেছে। লাশ দাহ করার ব্যবস্থাও ভেঙে চুরচুর। যমুনায় এখন লাশ ভাসছে, শত শত লাশ ভাসছে গঙ্গায়। পচা গলা লাশ। আধপোড়া লাশ। কোভিড রোগে মৃতদের সৎকার আর সম্ভব হচ্ছে না। কাঠ নেই চিতা জ্বালাবার, জায়গা নেই মৃতদেহ রাখার। তাছাড়া কোভিড হওয়াদের নিয়ে টানা-হেঁচড়া করতেও তো ভয়। কখন না আবার সংক্রামিত হয় স্বজন-বন্ধু। অগত্যা সলিলসমাধিই তাদের সিদ্ধান্ত। লাশগুলো উত্তর প্রদেশ থেকে গঙ্গায় ভেসে ভেসে বিহারে এসে পৌঁছেছে। নদীর কিনারে জড়ো হয়েছে প্রচুর কুকুর। উড়ে এসেছে ঝাঁক ঝাঁক কাক। পচা গলা দেহগুলো খাচ্ছে। কুকুর এবং কাকের রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা, নদীর জল দূষিত হওয়ার আশঙ্কা-আমাদের অজস্র আশঙ্কার সঙ্গে যোগ হলো এই দুই আশঙ্কা।

মহামারীর সময় লাশ নদীর জলে ফেলে দেওয়া এ নতুন কোনও ঘটনা নয়। ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু-তে যখন ভারতবর্ষের মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল, কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, নর্মদা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল পচা গলা লাশ। তখনও চিতার কাঠের অভাব হয়েছিল। আত্মীয়রাও সংক্রামিত হচ্ছিল ফ্লুতে। তখনও কাক আর কুকুর ভিড় করেছিল লাশ খেতে। তখনও নদীর জল দূষিত হয়ে উঠেছিল।

এই তো গত কিছুদিন দিল্লির শ্মশানে লাশের ভিড় এত বেড়েছিল যে শহরটি শ্মশান হয়ে গিয়েছিল। সরকারি হিসাবে মৃত্যু চারশো। অথচ প্রতিদিন চিতা জ্বলেছে প্রায় দেড় হাজার। শ্মশানে সম্ভব হয়নি বলে মানুষ চিতা জ্বালিয়েছে পার্কে, গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায়। মানুষ মরেছে রাস্তায়, ফুটপাতে, হাসপাতালের বারান্দায়, গাড়িতে, অটোরিকশার ভিতরে। কী এক ভয়ঙ্কর চিত্র! মহামারী বা অতিমারী ঠিক কাকে বলে এবং দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবা আমূল ভেঙে পড়লে ঠিক কী হতে পারে-তা মানুষ বিস্ফারিত চোখে দেখেছে। মানুষ দেখেছে মানুষের হাহাকার, করুণ আর্তনাদ।

এখন তো মানুষ বিস্ফারিত চোখে নদীর জলে ভাসতে থাকা শত লাশও দেখছে। কোভিডের প্রথম তরঙ্গে এত বেশি সংক্রমণও ঘটেনি, এত বেশি মৃত্যুও ঘটেনি। দ্বিতীয় তরঙ্গ ঘরে ঘরে সংক্রমণ আর মৃত্যু দিচ্ছে। মানুষ টিকা নিয়েও অসুস্থ হচ্ছে। সবচেয়ে দুঃখজনক খবর শুনছি, কেউ কেউ কোভিড থেকে বাঁচার দু’ডোজ টিকা নিয়েও কোভিড থেকে বাঁচতে পারছে না। প্যানিক না হয়ে বোধহয় উপায় নেই।

এত দুঃখেও চোখ জুড়িয়েছে দেখে যে কিছু মুসলমান হিন্দুর সৎকারে সাহায্য করছে। তারাও দিল্লির শ্মশানে চিতাকাঠ বয়ে এনেছে। তারাও চিতা জ্বালিয়েছে। করোনাভাইরাস তো ধর্ম দেখে মানুষকে আক্রমণ করে না। মুসলমানদের ধর্মীয় জমায়েতে যেমন করোনা হামলা করেছে, হিন্দু ক্রিশ্চানদের ধর্মীয় জমায়েতেও একইভাবে হামলা করেছে করোনা। গণকবরে কোভিডে মৃত্যু হওয়া মুসলমানদেরও শোয়ানো হচ্ছে। চিতাকেও তো গণচিতাই করা হয়েছে। এক চিতার আগুনে কয়েকটি করে মৃতদেহ পোড়ানো হয়েছে। এই দুঃসময়ে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে না তো কবে দাঁড়াবে? মানুষের এই কঠিন সময়ে হিংসে ঘৃণা সাম্প্রদায়িকতা জাত পাত ভুলবে না তো কবে ভুলবে?

সাম্প্রদায়িকতা যখন দেশজুড়ে থিকথিক করে, তখন কাশ্মীরে ঘটে গেল এক অভিনব সৎকার। চমনলাল পণ্ডিত নামে ৭০ বছর বয়সী এক লোক দক্ষিণ কাশ্মীরের পুলবামা অঞ্চলের তাহাব গ্রামে বাস করতেন। নব্বই দশকে যখন কাশ্মীরের উগ্র মুসলমানরা কাশ্মীরের হিন্দুদের হত্যা করেছিল, প্রায় সব হিন্দুই কাশ্মীর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল, চমনলাল পণ্ডিত কিন্তু কাশ্মীর ছাড়েননি, তিনি থেকে গেছেন তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিতে। একাই থাকতেন, আত্মীয় খুব কমই ছিল তাঁর আশপাশে। তিনি মারা যাওয়ার পর হিন্দুরীতিতে তাঁর সৎকার করেছেন তাহাব গ্রামের মুসলমানরা। গাছ কেটে কাঠ এনেছেন চিতা জ্বালানোর জন্য। তাঁরা বলেছেন, ‘চমনলালের সৎকার তো আমরাই করবো, চমনলাল তো আমাদেরই একজন ছিলেন।’ এই অসাম্প্রদায়িক উদার মুসলমানের মতো যদি কাশ্মীরের আর সব মুসলমান হতো, তাহলে কাশ্মীরী পণ্ডিতরা নিজেদের ভিটেয় আজ বাস করতে পারতো।

উদারতা যত কমতে থাকে, মানুষের মধ্যে স্বার্থপরতা, লোভ হিংসে, ঘৃণা তত বাড়তে থাকে। উদারতার শিক্ষাটা জন্ম থেকে পেতে হয়। উদারতা থেকেই মানবতার বোধ জাগে। মানবতার বোধ মানুষকে বর্বরতা আর হিংস্রতা থেকে দূরে রাখতে পারে। ভারতে মানুষের চরম দুঃসময়ে যখন সামান্য অক্সিজেনের জন্য কাতরাচ্ছে কোভিড রোগী, সামান্য অক্সিজেনের অভাবে শত শত রোগী মরে যাচ্ছে, তখন অক্সিজেনের কালোবাজারি করছে কিছু লোক, অন্য কিছু লোক আবার পকেটের পয়সা খরচ করে অজানা অচেনা রোগীর জন্য অক্সিজেন কিনে আনছে। চিরকালই এই পৃথিবীতে দু’রকম মানুষ আমরা দেখি, ভালো এবং মন্দ। উদারতা বাড়লে ভালো মানুষের সংখ্যাটা বাড়ে। ভালো মানুষের সংখ্যা বাড়লে সমাজ বাসযোগ্য হয়।

৩. জঙ্গিবিরোধী অপারেশনে সবচেয়ে সফল যে পুলিশ অফিসার, তাঁর নাম বাবুল আক্তার। তাঁর তীক্ষè বুদ্ধি, বিচক্ষণতার পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন, তাঁর পদোন্নতি হয়েছে। জানি না এই বাবুল আক্তারের বুদ্ধি কী করে মস্তিষ্ক থেকে উড়ে গিয়েছিল যখন তিনি ভাড়াটে খুনি দিয়ে তাঁর স্ত্রীকে খুন করানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। বুদ্ধিরও পাখা থাকে!

তাঁর স্ত্রী মিতু যখন ছেলেকে স্কুলবাসে পৌঁছে দিতে বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাবেন, তখনই তাঁকে খুন করা হবে। এই ছক মেনেই খুনিরা মিতুকে নৃশংসভাবে খুন করেছে। বাবুল আক্তার ভেবেছিলেন, তিনি পার পেয়ে যাবেন, কারণ মানুষ ভেবে নেবে, যেহেতু তিনি জঙ্গি মেরেছেন, তাই জঙ্গিরা তাঁর স্ত্রীকে মেরে তাঁর প্রতিশোধ নিয়েছে।

তাঁর দুই সন্তান। দুই সন্তানের এক সন্তান নিজের মা’কে চোখের সামনে খুন হতে দেখবে, তা জেনেও বাবুল আক্তার খুনটি করিয়েছিলেন। স্বামী হিসেবে তিনি অযোগ্য, পিতা হিসেবেও।

সংসারে দীর্ঘদিন অশান্তি। স্ত্রীকে তুমি ভালোবাসো না। স্ত্রীর চেহারা তোমার দেখতে ইচ্ছে করে না। কখনও দুজনের মধ্যে সুসম্পর্ক ফিরে আসবে বলে তুমি বিশ্বাসও করো না। এ অবস্থায় যে কাজটি করতে হয়, তা হলো স্ত্রীকে তালাক দেওয়া, স্ত্রীকে মেরে ফেলা নয়।

বাবুল আক্তারের মতো মানুষ কেন এই সহজ সমাধানটি গ্রহণ করলেন না, বরং এমন এক সমাধান বেছে নিলেন, যে সমাধানে তাঁর ধরা পড়ার, তাঁর ফাঁসি বা যাবজ্জীবন হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। ওই যে বললাম না বুদ্ধিরও পাখা থাকে, কখন যে উড়ে যায় টেরই পাওয়া যায় না।

স্ত্রীকে খুন করার পর বাবুল আক্তার স্ত্রীর বাবার বাড়িতে ছ’মাস থেকেছিলেন। নিশ্চয়ই স্ত্রীর মৃত্যু-শোকে কাতর হওয়ার অভিনয় বেশ চমৎকার করেছিলেন। স্পর্ধা কম ছিল না মানুষটির।

পাঁচ বছর আগে যখন মিতু হত্যার খবরটা বেরিয়েছিল, তখনই বলেছিলাম মিতুকে হত্যার পিছনে বাবুল আক্তার আছেন। আমাকে তখন ‘পুরুষবিদ্বেষী’ বলে গালি দিয়েছিল অনেকেই। আজ তারা আমাকে কী বলে গালি দেবে জানি না।

কিছু সত্য তথ্য সবারই জানা উচিত। মেয়েদের সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ করে স্বামীরা। মেয়েদের সবচেয়ে বেশি শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন করে স্বামীরা। মেয়েদের সবচেয়ে বেশি খুন করে স্বামীরা।

২০১৮ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ জানিয়েছে, প্রতি বছর পঞ্চাশ হাজার মেয়ে স্বামী/প্রেমিক/পরিবারের লোক দ্বারা খুন হয়। ২০১৯ সালে জানিয়েছে পঞ্চাশ হাজারের চেয়ে বেশি মেয়ে খুন হয়েছে এ বছর। গত বছরের খুনের সংখ্যাটা জানি না। তবে লকডাউনের কারণে স্বামীরা বাড়িতে থেকেছে বেশি, স্ত্রীদের নির্যাতন করেছে বেশি। স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছে আত্মসম্মান নিয়ে যে মেয়েরা বেঁচে থাকতে চায় তারা। আর যাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, পরনির্ভরতা ছাড়া উপায় নেই, তারা আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে নির্যাতন সহ্য করেছে।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর