সোমবার, ৫ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা সমস্যা : বাংলাদেশের করণীয়

লে. জে. মো. মাহফুজুর রহমান (এলপিআর)

রোহিঙ্গা সমস্যা : বাংলাদেশের করণীয়

২০১৭ সালের অক্টোবরে আমি যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঙ্গরাজ্যের হনুলুলুতে একটি ইন্দো-প্যাসিফিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করি। ওই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ চেয়ারম্যান জেনারেল জোসেফ ড্যানফোর্ডও অংশ নিয়েছিলেন, যিনি একজন চিন্তাশীল জেনারেল হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আলোচনার একপর্যায়ে তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে; কিন্তু ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের ছন্দবিন্যাসী নৃশংসতা এতটা প্রকট কীভাবে হলো? এর উত্তরে রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের জাতীয় কৌশলগত কৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করাটা অতি প্রাসঙ্গিক বলে আমি মনে করছি। মিয়ানমারের এ কৌশলগত কৃষ্টি জ্যাকøাইডার এবং কলিন গ্রে-এর দৃষ্টিকোণ থেকে আমি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব (যারা কৌশলগত নীতিনির্ধারণ কৃষ্টি পরিভাষাটি নিরাপত্তা অভিধানে যুক্ত করেছেন)।

মিয়ানমারের জাতীয় কৌশলগত নীতিনির্ধারণ কৃষ্টি : মিয়ানমারের একটি প্রভাবশালী জাতীয় কৌশল নীতিনির্ধারক সম্প্রদায় সবসময় বিশ্বাস করে আসছিল, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জাতিগোষ্ঠী নয়। তাদের ধারণা হলো- রোহিঙ্গারা অনতিদূর/সম্প্রতি দেশান্তরিত হয়ে সে দেশে গিয়েছে। ফলে তাদের প্রতি ক্রমান্বয়ে শত্র“ভাবাপন্ন আচরণ বৃদ্ধি করা হচ্ছিল। অন্যদিকে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি এবং স্থানীয়দের সঙ্গে ক্রমাগত বিবাহ বন্ধন তাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর সঙ্গে সঙ্গে তাদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, পশ্চিমাঞ্চল থেকে সারা দেশ ইসলামীকীকরণ হয়ে পড়বে। এসব ধারণা মিয়ানমারের কৌশলগত সম্প্রদায়ের কাছে জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে যা অবশ্যই রোহিঙ্গাভীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। সুতরাং দরকার ছিল রোহিঙ্গামুক্ত মিয়ানমার। আর সেটা বাস্তবায়নের পদ্ধতি হলো সামরিক অভিযান এবং মাধ্যম হলো নিরাপত্তা বাহিনী। এখন আমি জেনারেল ড্যানফোর্ডের সেই প্রশ্নের আলোচনায় আসছি। এ পর্যায়ে আমি ক্রমান্বয়ে কিছু ছোট ছোট ঘটনা উপস্থাপন করার চেষ্টা করব আর যার উপসংহার পাঠকদের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিলাম।

২০১১ সালে সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং মিয়ানমারের প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই আমরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তার ‘ঘৃণাত্মক বক্তব্য’ দিতে শুনেছি। নিরাপত্তা বাহিনীদের প্রতি এক নির্দেশনায় তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছিলেন, ‘আমাদের একটি অসমাপ্ত কাজ রয়েছে’। একই সঙ্গে দেশটির সংবাদমাধ্যমও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত এবং বিরূপ জনমত গড়ে তুলতে শুরু করল এই বলে যে, রোহিঙ্গারা মূলত বাঙালি এবং রাখাইন রাজ্যে দেশান্তরিত হয়ে এসেছে। অপরদিকে আশিন উইরাথুর নেতৃত্বে কিছু বৌদ্ধ জঙ্গি সন্ন্যাসী এবং ৯৬৯ আন্দোলন (মুসলিমবিরোধী) রোহিঙ্গা বিষয়কে প্রচার করে যে, ভবিষ্যতে পশ্চিম সীমান্ত (রাখাইন/বাংলাদেশ) থেকে সারা মিয়ানমারে ইসলাম ছড়িয়ে পড়বে।

২০১৪ সালে বাংলাদেশের একটি উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার দল বেইজিংয়ে আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারক পর্যায়ের প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনার সময় চীনের এক সিনিয়র জেনারেল আমাদের একজন কর্মকর্তাকে বাংলাদেশের ঘরোয়া রাজনীতিতে রোহিঙ্গাদের গুরুত্ব কতটা এবং রোহিঙ্গা বিষয়ে যদি এমন কোনো উত্তপ্ত পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তবে বাংলাদেশ কি প্রতিবেশীর সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি নেবে (আমরা এ উভয় প্রশ্নের উত্তর জানি)?

২০১৩-১৪ সালে কিউকফ্যা (সিতওয়ে-রাখাইনের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চল) থেকে কুনমিং (চীন) পর্যন্ত মিয়ানমার-চায়না গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন করা হয়। চায়না এ প্রকল্পের জন্য কোটি কোটি ডলার ব্যয় করেছে। যেহেতু জ্বালানি চায়নার উৎকর্ষের ভারকেন্দ্র তাই তার সমৃদ্ধির জন্য জ্বালানি সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ (মিয়ানমার উপকূল থেকে থাইল্যান্ড পর্যন্ত ইয়াদানা গ্যাস পাইপলাইনের ক্ষেত্রে একইরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। সেই সময় মিয়ানমার সামরিক বাহিনী হাজার হাজার কারেন জাতিগোষ্ঠীর লোকজনকে নির্যাতন করে গ্যাস পাইপলাইনের আশপাশ থেকে বিতাড়িত করেছিল। ফলে অনেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছিল এবং অনেকে থাইল্যান্ডের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল)। গ্যাস পাইপলাইনের পাশাপাশি রাখাইনে বহু বিলিয়ন ডলারের তেল পাইপলাইন প্রকল্পটি নির্মাণাধীন ছিল, যা ২০১৪-২০১৫ সালে সম্পন্ন হয় (প্রকল্পটি ২০১৭ সালে চালুর অপেক্ষায় ছিল)।

২০১৬ সালে রাখাইন পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী উচ্ছেদ অভিযানের নামে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গা অসামরিক নাগরিকদের ওপর নৃশংসতা চালায় যার ফলশ্রুতিতে প্রায় ৯০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আমার মতে, বিশ্ববাসীর মনোভাব বোঝা এবং বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষমতাধর দেশের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য, বিশেষভাবে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য এটি একটি প্রাথমিক অভিযান ছিল। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে মিয়ানমারের দুজন সিনিয়র জেনারেল গোপনে ঢাকার মিয়ানমার দূতাবাসের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনার জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন।

২০১৭ সালের মে মাসে তেল পাইপলাইন চালু করা হয় (গ্যাস পাইপলাইনের সমান্তরালে চলমান) যা গ্যাস পাইপলাইনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর পরপরই জুলাই মাসে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের কাছে বাংলাদেশ সীমান্তের রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে মর্মে তথ্য আসতে থাকে। ফলে এ বিষয়ে আমাদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ মিয়ানমারকে জানানো হয়েছিল। এ ছাড়াও ২০১৬ সালের ঘটনা মনে করিয়ে দেওয়া হয় (যেখানে বিচ্ছিন্নতাবিরোধী অভিযানের নামে রোহিঙ্গা অসামরিক নাগরিকদের টার্গেট করার কারণে তারা বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে প্রবেশ করে)। বাংলাদেশের উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মিয়ানমার জানায় যে, ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠী এবং বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ‘মায়ু রেঞ্জে’ নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান হবে। আরও জানানো হয় যে, অসামরিক নাগরিকদের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই এবং ২০১৬ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।

২০১৭ সালের জুন ও জুলাই মাসে সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং যথাক্রমে রাশিয়া এবং ভারত সফর করেন। সেখানে তিনি রাষ্ট্রীয় উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন।

রাখাইনে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির কাজ ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়। এর মধ্যে কফি আনান কমিশন রিপোর্ট ২৪ আগস্ট ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়। উক্ত প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের বেশ কয়েকটি সমস্যার সমাধানের প্রস্তাবনা ছিল। কয়েক দশক ধরে অপেক্ষার পর রোহিঙ্গারা আশায় ছিল যে, প্রতিবেদনটির মাধ্যমে তাদের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার স্বীকৃতি পাবে। এরকম সুস্পষ্ট অগ্রগতি সত্ত্বেও মিয়ানমার দাবি করে যে, রোহিঙ্গা মদদপুষ্ট আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট ভোরে একসঙ্গে ৩০টিরও বেশি নিরাপত্তা বাহিনীর চৌকিতে হামলা করে কয়েকজনকে নিহত করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় মিয়ানমার সামরিক বাহিনী যারা আগে থেকেই রাখাইনে যুগপৎভাবে সমবেত ছিল তারা ইসলামপন্থি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে রোহিঙ্গা অসামরিক নাগরিকদের ওপর ব্যাপক জাতিগত নির্মূল অভিযান পরিচালনা করে। মিয়ানমারের এ তথাকথিত ARSA আক্রমণের যে অভিযোগ তাতে চারটি প্রশ্নের উদ্ভব হয়।

(১) ARSA , রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্পসমূহ পরিপূর্ণভাবে শক্তি বৃদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করছিল?

(২) ARSA কি একটা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত মিয়ানমারের নিয়মিত সুসজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে রামদা (Machete) এবং দেশি বন্দুক সমেত (মিডিয়াতে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক প্রদর্শিত ARSA অস্ত্র) আক্রমণ পরিকল্পনা করেছিল?

(৩) মিয়ানমার দাবি করছিল যে তাদের হতাহতের সংখ্যা অনেক। কিন্তু আক্রমণে নিহতদের কখনো সামরিক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান করতে দেখা যায়নি। সংবাদ মাধ্যমসমূহে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া জাতীয় কোনো খবর দেয়নি (গত ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে কারেন গোষ্ঠীর আক্রমণে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল সেটার সামরিক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার খবর মিয়ানমার সংবাদ মাধ্যমসমূহে ব্যাপকভাবে প্রচার করেছিল)।

(৪) ARSA ২৫ আগস্ট ২০১৭ সালের খুব ভোরে আক্রমণ চালায় এবং মিয়ানমার সামরিক বাহিনী ২৫ আগস্ট ২০১৭ সালের সকালে তাদের ব্যাপক সমন্বিত অপারেশন পরিচালনা করে (সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা জানি যে, একটি সমন্বিত অপারেশন পরিচালনার জন্য প্রয়োজন যথাযথ পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি)। ২৫ আগস্ট সকালে তথাকথিত ARSA আক্রমণের পর মিয়ানমার খুব তড়িঘড়ি করে বলতে শুরু করল যে, রাখাইনে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল তাই কফি আনান রিপোর্ট তখনই বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। একই সঙ্গে তারা তাদের নিজেদের মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করার জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদি মিয়ানমার সফরে আসেন। তিনি শান্তি ও জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে নেওয়া পদক্ষেপের জন্য মিয়ানমারের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এ ছাড়াও মিয়ানমারে চলমান সন্ত্রাসবাদ এবং বিভিন্ন উগ্রবাদী সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

২০১৭ সালে নভেম্বরে সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং-এর চীন সফরকালে রাষ্ট্রপতি শি জিন পিংয়ের সঙ্গে আলোচনার একপর্যায়ে তিনি রাখাইন বিষয়ে (রোহিঙ্গা ইস্যুতে) মিয়ানমারের পাশে থাকার জন্য তাদের ধন্যবাদ জানান।

কী ঘটতে যাচ্ছে? এ পর্যন্ত যে ঘটনাগুলোর অবতারণা করা হয়েছে তা থেকে শিক্ষা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তবে পরবর্তীতে কী ঘটবে তা অনুধাবন করা আরও বেশি গুরুত্ব বহন করে। সম্প্রতি এ বিষয়ে চলতি বছরের মে মাসে সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো অবকাশ নেই বলে মতামত পুনর্ব্যক্ত করেছেন। ইতিমধ্যে এনএলডি (অং সান সু চির পার্টি) নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) ঘোষণা দিয়েছে যে, একবার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়ে গেলে এবং তারা ক্ষমতায় ফিরে এলে রোহিঙ্গাদের সমাজে অন্তর্ভুক্ত করবে এবং তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার বিচার কার্য হাতে নেওয়া হবে। এটি একটি ইতিবাচক মনোভাব। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে জাতীয় ঐক্য সরকার পরিস্থিতির শিকার হয়ে এবং মুসলিম দেশগুলোর পাশাপাশি বিশ্বের বিবেকবান সম্প্রদায়ের সমর্থন পাওয়ার জন্য এ ধরনের ঘোষণা দিয়েছে। আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, মিয়ানমার নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কারা প্রভাব বিস্তার করে থাকে। আমার মতে, যতক্ষণ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দুটি স্থায়ী সদস্য দেশ মিয়ানমার সামরিক জান্তা সরকারকে সমর্থন করে যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত জান্তা ক্ষমতায় টিকে থাকবে। সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ এরকম একটি উদাহরণ। বিগত ঘটনাসমূহ পর্যালোচনা করে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় যে, যখন সংঘাত কমে যাবে এবং জান্তা সরকার স্থিতিশীল হবে তখন মিয়ানমারে বিশেষত রাখাইন রাজ্যে অবস্থানরত অবশিষ্ট রোহিঙ্গারা (সম্ভাব্য ৪-৬ লাখ) যথাসময়ে বিতাড়িত হবে।

এ অবস্থা প্রতিরোধে করণীয় কী? অনেক বিকল্প পন্থা রয়েছে। তবে শুরুতেই আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা খুবই ধূর্ত, বুদ্ধিমান ও পেশাদার নীতিনির্ধারণী ব্যক্তিবর্গ এবং তাতমাদোর (মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনী) মতো একটি সংস্থার সঙ্গে বচসা করছি। আমাদের রোহিঙ্গা সমস্যাটিকে দৈনন্দিন বা অন্য আর ১০টা সাধারণ বিষয় হিসেবে গণ্য করা ঠিক হবে না। জান্তা কর্তৃক বাকি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রেরণ রোধ করতে আমাদের সম্মিলিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নিরাপত্তা বিশ্লেষণের ছাত্র এবং কাঠামোগত বাস্তববাদ মতবাদের অনুসারী হয়ে আমি বুঝতে পারি যে, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা বেশ নৈরাজ্যবাদী এবং এ ব্যবস্থায় কারও নিরাপত্তার জন্য অপরকে বিশ্বাস করা যায় না। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি এখানে প্রতিরোধমূলক সামরিক ব্যবস্থার একটি অংশ নিয়ে আলোচনা করতে চাই। সেটা হলো- আমাদের একটি ভীতি প্রয়োগে সক্ষম বাহিনী গড়ে তুলতে হবে যে বাহিনীর অন্তর্নিহিত আক্রমণাত্মক সক্ষমতা থাকবে এবং একই সঙ্গে সমানুপাতিক হারে থাকবে সম্মুখ সারির যোদ্ধা ও তাদের পর্যাপ্ত সমর্থন (Appropriate Tooth to Tail Ratio)। আমরা নির্ভরযোগ্য ভীতি প্রদানে সক্ষম বাহিনী বলতে বুঝি অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি সামরিক সরঞ্জামাদিতে ক্ষেত্র বিশেষে প্রতিপক্ষের চেয়ে এগিয়ে থাকা। আমি সিঙ্গাপুরের উদাহরণ দিয়ে শেষ করতে চাই। লি কুয়ান ইউ যখন সিঙ্গাপুরের উন্নয়ন করছিলেন তখন ঠিক আমাদের মতোই তাঁর প্রথম বিবেচ্য বিষয় ছিল ‘স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং জনগণের উন্নত জীবন ব্যবস্থা’। তদুপরি, লি কুয়ান একটি নির্ভরযোগ্য ভীতি প্রয়োগে সক্ষম সশস্ত্র বাহিনীও গড়ে তুলেছিলেন। সেখানকার সমাজ লি কুয়ানকে প্রশ্ন করেছিল যে, সিঙ্গাপুরের মতো একটি ছোট উন্নয়নশীল দেশের জন্য Credible Deterrence Force তৈরি কি সম্পূর্ণ বিপরীত সিদ্ধান্ত না? লি কুয়ান জবাব দিয়েছিলেন যে, ‘আমাদের যদি একটি Credible Deterrence Force থাকে তবে আমাদের কেউ ঘাটাবে না এবং কেউ যদি আমাদের না ঘাটায় তাহলে আমরা আমাদের প্রথম বিবেচ্য বিষয় নিয়ে এগিয়ে যেতে পারব।’ ২০১৭ সালের আগস্টে আমাদেরকে (বাংলাদেশকে) আমাদের মতো থাকতে দেওয়া হয়নি।

লেখক : সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সাবেক প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার।

সর্বশেষ খবর