শুক্রবার, ৬ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

রবীন্দ্রনাথের ‘লোকহিত’ চিন্তা ও সমকালীন সমাজ বাস্তবতা

ড. আতিউর রহমান

রবীন্দ্রনাথের ‘লোকহিত’ চিন্তা ও সমকালীন সমাজ বাস্তবতা

আমরা এখন এক নয়া পৃথিবীতে বাস করছি। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যস্ত এ পৃথিবীর ঘাড়ে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে চেপে বসেছে কভিড-১৯। এ অদৃশ্য ভাইরাস প্রতিনিয়ত রূপ বদলাচ্ছে। আবার নানা দিক থেকে মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর হামলে পড়ছে। কোনো বিশ্বযুদ্ধেও সারা বিশ্বের মানুষ এমন করে একযোগে আক্রান্ত হয়নি। এ  বিশ্বজনীন সংক্রমণে সর্বত্রই সমাজ ও অর্থনীতিতে বিরাট ধাক্কা লেগেছে। একদিকে মহামারী থেকে বাঁচার জন্য ঘরের বাইর হতে পারছেন না শ্রমজীবী মানুষ, অন্যদিকে আয়-রোজগার না থাকায় খেয়ে-পরে বাঁচার সুযোগও সংকুচিত হয়ে আসছে। ধনী দেশগুলো তাদের সম্পদ ও সুপ্রতিষ্ঠিত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বদৌলতে টিকা ও সামাজিক সুরক্ষা দিয়ে সব মানুষেরই জীবন ও জীবিকা বাঁচিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নিতে পেরেছে। কিন্তু স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনেকের পক্ষেই তা সম্ভব হচ্ছে না। এসব দেশের মানুষ স্বার্থান্বেষী এ ধনী দেশগুলোর অতিলোভী আচরণে অনেকটাই হতভম্ব। এরই মধ্যে নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী তারা এ বদলে যাওয়া পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছে। নয়া এ বাস্তবতায় বাংলাদেশও তার মতো করে এ সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করছে। তবে এত মানুষ এবং এমন গভীর তাদের জীবন-জীবিকার সমস্যা যে এ সংকট মোকাবিলা মোটেও সহজ নয়। এমন পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ বরাবরই আত্মশক্তির কথা বলতেন। সচেষ্ট সমাজের কথা বলতেন। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুও সংকটকালে একইভাবে মানবিকতার উদ্বোধনের কথা বলতেন। দুর্যোগ ও দুঃসময়ে মানুষকে এক হতে বলতেন। তিনিও রবীন্দ্রভাবনায় গভীরভাবে সিক্ত ছিলেন। আর সেজন্যই চলমান এ বিশ্বসংকটেও রবীন্দ্রনাথের লোকহিত চিন্তা আগের মতোই সমান প্রাসঙ্গিক। তিনি যে আমাদের চিরকালের সঙ্গী।

রবীন্দ্রনাথের সমাজ পরিবর্তনের ভাবনা ছিল গভীরভাবে মানবিক ও অধিকারভিত্তিক। জমিদারি পরিচালনার কাজে তিনি এসেছিলেন পূর্ববঙ্গে। সমাজের নানা অসংগতি ও সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব ও দুর্দশা হৃদয় দিয়ে অনুভব করার সুযোগ পেয়েছিলেন। একই সঙ্গে প্রজাদের অভাব ও দুঃখ দূর করার জন্য নানা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও জীবনঘন সামাজিক সংস্কারে তিনি হাত দেন। শিলাইদহ ও পতিসরে কৃষি উন্নয়ন, কুটিরশিল্পের প্রসার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, পূর্তকর্ম, স্বাস্থ্যসেবা, সালিশ-বিচারসহ অসংখ্য উন্নয়নমূলক কাজে নিজের উদ্ভাবনীমূলক চিন্তা ও অর্থের সম্মিলন ঘটান। নিজের সন্তান, বন্ধু ও আত্মীয়দের পর্যন্ত এসব কর্মে যুক্ত করেন। এসব কর্মকান্ডের অভিজ্ঞতায় শান্তিনিকেতনে শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর প্রতিটি সামাজিক উদ্যোগের মূলে ছিল মানুষের সম্মিলন।

রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন মানুষ সংগঠিত হলে উন্নয়ন সহজ হয়। সেজন্যই তিনি ১৯০৪ সালে লেখা ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে ‘সমাজ’ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। শিলাইদহে সমগ্র এলাকাকে কয়েকটি মন্ডলীতে ভাগ করে কবি সমবায়ভিত্তিক উন্নয়ন কর্মকান্ড শুরু করেন। যদিও পরবর্তীকালে এসব উদ্যোগ নানা কারণে বেশিদূর এগোয়নি। তবে আরও পরে শান্তিনিকেতনে ‘শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতী সমিতি’, শিলাইদহে ‘পল্লী সমিতি’, পতিসরে ‘লোকসভা’, ‘মন্ডলী’, ‘হিতৈষীসভা’সহ বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। এসব ভাবনা ও উদ্যোগের পেছনে রবীন্দ্রনাথের লোকসাধারণের হিতসাধনের চিন্তা ছিল একেবারেই মৌলিক ও সৃজনশীল। তাঁর সেই ভাবনার অন্তর্নিহিত সুরটি ধরতে পারলে আমাদের সমকালীন উন্নয়নভাবনাকে আরও মানবিক ও অধিকারভিত্তিক করার তাগিদ অনুভব করব বলে আমার বিশ্বাস। তাঁর ‘কালান্তর’ পর্বের ‘লোকহিত’ প্রবন্ধটি সব অর্থেই একটি যুগান্তকারী রচনা। এখানে তিনি এমন কিছু মৌলিক বিষয়ের অবতারণা করেছেন যা বর্তমানের সমাজভাবনাকেও সমানতালে প্রভাবান্বিত করার ক্ষমতা রাখে।

আজকাল প্রতিটি রাজনৈতিক দল সুযোগ পেলেই জনহিতকর কাজের দীর্ঘ তালিকা দেয়। নির্বাচনী ইশতেহারে দলগুলো এখন আরও সুপরিকল্পিতভাবে এসব লোকহিতকর চিন্তা তুলে ধরে। তাতে দোষের কিছু নেই। তবে এ ভাবনার মূলে যেন নাগরিক অধিকারের বিষয়টি শক্ত করে প্রোথিত থাকে সে শিক্ষাই আমরা পাই রবীন্দ্রচিন্তা থেকে। আর বাস্তবায়নের দিকটিতেও সমান গুরুত্ব দাবি করে। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন পরের উপকার করার জন্য প্রথমেই অধিকার অর্জন করা চাই। ‘মানুষ কোনো দিন কোনো যথার্থ হিতকে ভিক্ষারূপে গ্রহণ করিবে না, ঋণরূপেও না, কেবলমাত্র প্রাপ্য বলিয়াই গ্রহণ করিতে পারিবে।’ (লোকহিত, ii, দ্বাদশ খন্ড, পৃ. ৫৮৪)।

এখানে ‘প্রাপ্য’ শব্দটির মধ্যেই অধিকার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাঁর মতে লোকসাধারণকে সব অর্থেই ছোটজ্ঞান করে, অনুগ্রহপ্রার্থী মনে করে দৃশ্যমান হিত করার মাঝে মানুষের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষতই করা হয়। এতে তাদের বরং আহতই করা হয়। যারা প্রকাশ্যে হিত করার আত্মাভিমানে মত্ত তাদের জন্য রবীন্দ্রনাথের বার্তাটি হচ্ছে যে, ‘হিত করিবার একটিমাত্র ঈশ্বরপ্রদত্ত অধিকার আছে, সেটি প্রীতি। প্রীতির দানে কোনো অপমান নাই কিন্তু হিতৈষিতার দানে মানুষের অপমান হয়। মানুষকে সকলের চেয়ে নত করিবার উপায় তাহার হিত করা অথচ তাহাকে প্রীতি না-করা।’ (লোকহিত, ii, দ্বাদশ খন্ড, পৃ. ৫৮৪)।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে মুসলমানদের ডেকেও ভালো সাড়া না পাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন যে সেটিই ছিল স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কেননা, দীর্ঘদিন উপেক্ষিত মুসলমান সমাজকে প্রীতির ডাকে সাধারণ সামাজিকতাটুকু পালন করেনি সে সময়ের নেতৃস্থানীয়রা। হৃদয়ে আঘাতপ্রাপ্ত মুসলমানকে হঠাৎ ‘ভাই বলিয়া’ ডাকলেও প্রত্যাশিত সাড়া মেলার কথা নয় বলে তিনি লিখেছেন। এ উদাহরণ শুধু একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্যই প্রযোজ্য নয়। সমাজ আজ যেভাবে অভিজন ও অভাজনে বিভক্ত হয়ে পড়েছে তাতে আর্থসামাজিকভাবে উপেক্ষিত শেষাংশকে প্রীতির ডোরে বাঁধতে না পারলে তাদের জন্য বাহ্যিক হিত করার মাধ্যমে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা বেশ কঠিনই হবে।

প্রকৃতপক্ষে যে মানুষ অন্য মানুষকে সম্মান করতে পারে না, সে মানুষকে উপকার করতে অক্ষম। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি’তে লিখেছেন শিক্ষাই সবচেয়ে বড় রাস্তা যা মানুষকে সম্পূর্ণতা এনে দেয়। কেবল রাশিয়ায় নয়, মধ্য এশিয়ায়ও বন্যার বেগে বিজ্ঞানভিত্তিক মানবিক শিক্ষার বিস্তার হয়েছে। তিনি ভারতবর্ষের সম্ভাবনা ও বাস্তবতার সঙ্গে এসব অঞ্চলের মানুষের উচ্চ মানবিক চেতনা উন্নয়নের প্রয়াসের ব্যবধান অনুভব করে আহত হয়েছেন। আমরা যারা সুবিধালোভী ভদ্রলোকেরা সর্বক্ষণ সুবিধাবঞ্চিতদের শুধু দান করে, কৃপা করে মন জয় করতে আগ্রহী তাদের জন্য রবীন্দ্রনাথের ‘লোকহিত’ ভাবনাগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন মহাজন ঋণ দিয়ে সুদ গ্রহণ করে। সেই সুদ অনেক সময় আসলকেও ছাড়িয়ে যায়। সেই মহাজন যদি ঋণগ্রহীতার কাছে সুদের পাশাপাশি কৃতজ্ঞতাও আদায় করতে চায় তাহলেই মুশকিল। তাকে তিনি ‘শাইলকেরও বাড়া’ বলে মনে করেন। সমকালীন বাংলাদেশেও আমরা এমন অসংখ্য হিতকারীর সন্ধান পাই যাদের মাঝে এ ধরনের আত্মাভিমানের বাড়াবাড়ি বেশ চোখে পড়ে। এভাবে দেশহিতৈষা হয় না। দেশহিতৈষায় হিতৈষার চেয়ে দেশের অংশ যতক্ষণ বেশি না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত এ সংকট থাকবেই। আমরা যখন লোকসাধারণের কাছে হিতসামগ্রী নিয়ে যাই তখন শুধু তাদের বর্ধিত হাতটাই দেখতে পাই। তাদের অন্তরের দুঃখটা অনুভব করতে পারি না। হৃদয়ের আদান-প্রদান নেই বলে শুধু তাদের হাত-পায়ের নড়াচড়াই দেখতে পাই। সমাজ এখন ধনের নিরিখে পুরোপুরি বিভক্ত। মানুষের পেটের জ্বালা আমরা শুধু ব্যবসায়ীর লাভের চাহিদার চোখে দেখতে পাই। ধনীর ধনই যে দারিদ্র্য সৃষ্টির প্রধানতম হাতিয়ার সে কথাটি বুঝেও না বোঝার ভান করি। ধনীর ধনেও যে গরিবের হক আছে সে কথাটি আমরা অনেক সময়ই স্বীকার করি না। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা গরিবের মনেও আয়-রোজগার করে ধনার্জনের অধিকারের বিষয়টি গেঁথে দিতে পারছি ততক্ষণ পর্যন্ত হিতচিন্তার এ নেতিবাচক দিকটি থেকে আমরা মুক্তি পাব বলে মনে হয় না।

বর্তমানে ধনের বৈষম্যের চাপে সাধারণ মানুষ ছটফট করছে। তাই তারা অনেক সময়ই সংগঠিত শক্তি হিসেবে আবিভর্‚ত হতে চাচ্ছে। আর ভিক্ষা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়, বরং তারা এখন তাদের প্রাপ্যের দাবি করতে আগ্রহী। তাই দয়া করে নয়, নিজের গরজেই তাদের বেঁচে থাকার সুযোগ সৃষ্টি করা আমাদের কাজ। কেননা তারা এখন আমাদের ভাবিয়ে তুলতে সক্ষম হয়ে উঠছে। রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ আগেই এমনটি যে হবে তা অনুমান করেছিলেন। ‘আমাদের ভদ্র সমাজ আরামে আছে, কেননা আমাদের লোকসাধারণ নিজেকে বোঝে নাই। এই জন্যই জমিদার তাহাদিগকে মারিতেছে, মহাজন তাহাদিগকে ধরিতেছে, মনিব তাহাদিগকে গালি দিতেছে, পুলিশ তাহাদিগকে শুষিতেছে, গুরুঠাকুর তাহাদের মাথায় হাত বুলাইতেছে, মোক্তার তাহাদের গাঁট কাটিতেছে, আর তাহারা কেবল সেই অদৃষ্টের নামে নালিশ করিতেছে যাহার নামে সমন-জারি করিবার জো নাই।

আমরা বড়োজোর ধর্মের দোহাই দিয়া জমিদারকে বলি তোমরা কর্তব্য করো, মহাজনকে বলি তোমার সুদ কমাও, পুলিশকে বলি তুমি অন্যায় করো না- এমন করিয়া নিতান্ত দুর্বলভাবে কতদিন কতদিক ঠেকাইব। চালুনিতে করিয়া জল আনাইব আর বাহককে বলিব যতটা পারো তোমরা হাত দিয়া ছিদ্র সামলাও- সে হয় না; তাহাতে কোনো এক সময়ে এক মুহুর্তের কাজ চলে কিন্তু চিরকালের এ ব্যবস্থা নয়। সমাজে দয়ার চেয়ে দায়ের জোর বেশি।’ (লোকহিত, ii, দ্বাদশ খন্ড, পৃ. ৫৫১)।

সমাজের সেই দায় নিশ্চিত করতে হলে লোকসাধারণের পরস্পরের মাঝে একটা যোগাযোগের রাস্তা চাই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘সেটা যদি রাজপথ না হয় তো অন্তত গলির রাস্তা হওয়া চাই।’ আর তাঁর মতে, ‘লেখাপড়া শেখাই এই রাস্তা।’ এ শিক্ষা হয়তো গাঁয়ের ‘মেটে রাস্তা’। ‘কেবলই রাস্তা’। আপাতত এ-ই যথেষ্ট, কেননা এই রাস্তাটা না হইলে মানুষ আপনার কোণে বদ্ধ হইয়া থাকে। ‘সে কারণেই একটা বৃহৎ লৌকিক যোগের জন্য চাই তার অন্তত প্রাথমিক শিক্ষা।’ মানুষ যদি মনের চালাচালি করতে না জানে, দেশের জন্য তার অনুভব কোত্থেকে আসবে? মানুষের মনকে বিস্তৃত না করা গেলে মানুষ তার অন্তরের শক্তি কোত্থেকে পাবে?

এ প্রসঙ্গে তিনি ইউরোপের কথা পেড়েছেন। ওই সময় ইউরোপে প্রাথমিক শিক্ষার প্রয়োজনীয় প্রসার ঘটেছিল বলেই সেখানকার সাধারণ মানুষ লিখতে-পড়তে শিখে পরস্পরের কাছে পৌঁছানোর উপায় খুঁজে পেয়েছিল। আর এ কারণে সেখানে অধিকার-সচেতন লোকসাধারণ আলাদা সত্তায় আপন শক্তিতে জেগে উঠতে পেরেছিল। রাশিয়া ভ্রমণ করে কবি সেখানকার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপে তাদের শিক্ষাব্যবস্থার লোকহিতকর দিকটি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। ‘রাশিয়ার চিঠি’তে কবি এমনই একটি অনুভূতি প্রকাশ করেছেন, ‘... এদের শিক্ষা কেবল পুঁথি পড়ার শিক্ষা নয়। নিজের ব্যবহারকে চরিত্রকে একটা বৃহৎ লোকযাত্রার অনুগত করে এরা তৈরি করে তুলেছে। সেই সম্বন্ধে এদের একটা পণ আছে এবং সেই পণ রক্ষায় এদের গৌরববোধ।’ (‘রাশিয়ার চিঠি’, ii, দশম খন্ড, পৃ. ৫৭১)।

এ প্রসঙ্গে শান্তিনিকেতনের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কবির আকাক্সক্ষার কথা প্রকাশ পেয়েছে এভাবে, ‘আমার ছেলেমেয়ে এবং শিক্ষকদের আমি অনেকবার বলেছি, লোকহিত এবং স্বায়ত্তশাসনের যে দায়িত্ববোধ আমরা সমস্ত দেশের কাছ থেকে দাবি করে থাকি শান্তিনিকেতনের ছোটো সীমার মধ্যে তারই একটি সম্পূর্ণ রূপ দিতে চাই। এখানকার ব্যবস্থা ছাত্র ও শিক্ষকদের সমবেত স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা হওয়া দরকার- সেই ব্যবস্থায় যখন এখানকার সমস্ত কর্ম সুসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে তখন এইটুকুর মধ্যে আমাদের সমস্ত দেশের সমস্যার পূরণ হতে পারবে। ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে সাধারণ হিতের অনুগত করে তোলবার চর্চা রাষ্ট্রীয় বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়িয়ে হতে পারে না, তার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করতে হয়- সেই ক্ষেত্র আমাদের আশ্রম।’ (‘রাশিয়ার চিঠি’, ii, দশম খন্ড, পৃ. ৫৭১)।

নানা কারণেই আমাদের উপযুক্ত শিক্ষার বড়ই অভাব অনুভূত হচ্ছে। শিক্ষা এখন যেন অধিকার নয়, গণ্য হচ্ছে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক বৈষম্য ও নীতিহীনতার। শিক্ষার মানের তারতম্যের কারণে এক বাংলাদেশে কয়েক বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন এ বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, আশা-আকাক্সক্ষার ভিন্নতা হতে বাধ্য। গুণগতমানের নৈতিক ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা নিশ্চিত করা গেলে সমাজের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। আমাদের দেশে ইতিমধ্যেই প্রাথমিক শিক্ষার যথেষ্ট প্রসার ঘটেছে। কিন্তু এ চলমান মহামারী তার গতি রোধ করে বসে আছে। তবে বেশ কিছুদিন আগে আধুনিক সমমানের শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে যে শিক্ষানীতিটি তৈরি হয়েছে তার যদি সঠিক বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় তাহলে এ দেশেও লোকসাধারণের নাগরিক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া আরও মজবুত হবে। দয়া নয়, অধিকারের ভিত্তিতেই তারা তখন তাদের সমস্যা সমাধানের দাবি তুলবে। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাই তাদের এ মনের রাস্তা খুলে দিতে এগিয়ে এসেছে। এটিই স্বস্তির কথা। তবে এখনো সমাজের এক বিরাট অংশের ছেলেমেয়েরা কূপমন্ড‚ক হওয়ার অনাধুনিক শিক্ষা পাচ্ছে। এ দুর্ভাবনা থেকে জাতিকে মুক্ত করাও আমাদের বড় একটি কাজ। কাজটি মোটেও সহজ নয়।

শিক্ষার পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আয়-রোজগার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্প্রসারণ করা হয়েছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক (ইনক্লুসিভ) উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত জনপদের সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় আর্থিক সেবা পৌঁছানোর জন্য হতদরিদ্রদের ব্যাংক হিসাব খোলাসহ আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিংসেবা প্রবর্তন করা হয়েছে। এসব সেবা তৃণমূলের জনসাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। দেশে ব্যাপক হারে যে প্রবাসী আয় আসছে তার পেছনেও এ চটপটে আর্থিক সেবার অবদান স্বীকার করতেই হবে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও জোগানের সমতার জন্য কৃষি খাতের বহুমুখীকরণ, ছোট ও মাঝারি শিল্প উন্নয়নে জোর দেওয়া হয়েছে। সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সৃজনশীল উদ্যোক্তা তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে ইলেকট্রনিক বাণিজ্য (ই-কমার্স ও এফ-কমার্স) লেনদেনের সুযোগ দিন দিনই বাড়ছে। করোনাকালে এ প্রবণতা আরও গতি পেয়েছে। তরুণ সম্প্রদায় এ সুযোগের সবচেয়ে বড় উপকারভোগী। এটিই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সূচিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর সাফল্যের বড় উপাখ্যান। এ গল্পের নায়ক যেমন রয়েছেন, তেমনি নায়িকাও রয়েছেন। কেননা নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রবর্তিত অগ্রাধিকারভিত্তিক বিশেষ ঋণ সহায়তা বাংলাদেশে একটি বড় নারী উদ্যোক্তা শ্রেণি সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। উদ্যোক্তাদের বিকাশের প্রভাব ইতিমধ্যে আমাদের সমকালীন সমাজ ও অর্থনীতিতে বেশ ভালোভাবেই পড়তে শুরু করেছে। বর্তমান প্রজন্মের সৃজনশীল প্রতিভাকে আমাদের সমাজের ঐতিহ্যের মধ্যে সন্নিবেশিত করা গেলে জাতির জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা নিশ্চয় সম্ভব হবে।

সমাজ সবার বড়। যুগে যুগে বাংলাদেশে সমাজব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এখানকার শিক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতি, নৈতিকতা সবকিছুই সমাজ থেকেই বয়ে আসত। এমনকি সব ধরনের সংকটের মধ্যেও সমাজ নিজেকে রক্ষা করেছে। আমাদের সমাজ লোকসাধারণের জন্য কারিগরিসহ উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ আরও বিস্তৃত করতে পারলে সমাজেরই লাভ হবে। সমাজের নিম্নবর্গের অধিকার-সচেতনতা তখন আরও বাড়বে, ভদ্রলোকদের আরও বেশি জবাবদিহির সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হতে হবে। তখন দয়া-দাক্ষিণ্য নয়, অধিকারের ভিত্তিতে এ দেশের মানুষের ভাববিনিময় হবে। তারা পরস্পর সম্মিলিত হবে শিক্ষা নামক অধিকারের সূত্র ধরে। আর তখনই সম্ভব হবে সত্যিকারের সবার জন্য উন্নয়ন। তখনই নিশ্চিত করা যাবে প্রকৃত লোকহিত। বঙ্গবন্ধু তাঁর সংবিধান, প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনে এমন প্রাসঙ্গিক শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যাও আধুনিক গুণমানের শিক্ষার প্রসারে অঙ্গীকারবদ্ধ। তবে হঠাৎ করে করোনা সংকট এসে পড়ায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা স্বাস্থ্য খাতের মতোই বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। আশা করি সবাই মিলে সচেষ্ট থাকলে এ সংকটকাল নিশ্চয় পাড়ি দিতে পারব।

লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর