বাংলাদেশ যত দিন টিকে থাকবে আগস্ট মাসের কলঙ্ক ততদিন বাঙালি জাতিকে শোকাহত, মর্মাহত যেমন করবে, তেমনি নতুন নতুন উপলব্ধিতে সমৃদ্ধ করবে, শোক হবে শক্তির প্রেরণা। রবীন্দ্রনাথকে বাইরে রেখে যেমন কেউ বাঙালি হতে পারে না, তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দূরে রেখে কেউ বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারে না। কিন্তু কঠিন ও নির্মম বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের মানুষের মধ্য থেকে একাংশ রবীন্দ্রনাথকে দূরে রেখে ছদ্মবেশী বাঙালি এবং বঙ্গবন্ধুকে দূরে রেখে ছদ্মবেশী বাংলাদেশি নাগরিক হয়ে এখনো পাকিস্তানি মনমানসিকতায় পূর্ণ ধর্মীয় উগ্রবাদের বিষবাষ্প ছড়িয়ে বাংলাদেশের অদম্য অগ্রযাত্রাকে পিছন থেকে ছুরি মারছে। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত অসীম চিন্তাশক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে তারা অজুহাত সৃষ্টিতে ওস্তাদ। শয়তানি শক্তিতে বলীয়ান, তারা মরীচিকা সৃষ্টি করতে পারে।
রাবণের হুকুমে রাক্ষস মারীচ-যেমন শোভাময় মৃগের রূপ ধারণ করে রাম-সীতাকে বিভ্রান্ত করেছিল, ঠিক তেমনিই এরা বিভিন্ন রূপ ধারণ করে বাংলাদেশের সহজ-সরল মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। সুতরাং উল্লিখিত ছদ্মবেশীদের মুখোশ উন্মোচন এবং তাদের অনুসৃত পাকিস্তানপন্থি রাজনীতি থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত না করা পর্যন্ত উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে নিষ্কণ্টক ও টেকসই করা যাবে না। তাই আগস্ট মাস এলে জাতির পিতার প্রতি যেমন শ্রদ্ধা জানাব, তেমনি ওই ছদ্মবেশীদের কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার পথ ও পন্থা নির্ণয়ে সুস্থ বিতর্কের মাধ্যমে উপলব্ধি শক্তিকে জাগ্রত করব। একটি রাষ্ট্র যে স্তম্ভগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকে তার মধ্যে এক নম্বর হলো সেই দেশ, তারপর দুই নম্বর হলো জাতির সম্মিলিত সংস্কৃতি ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। বাংলাদেশের জন্য এই তিনটি স্তম্ভের প্রতিটির সঙ্গে যে নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত সে নামটি হলো শেখ মুজিবুর রহমান। একটি অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে, মাত্র ৫৫ বছরের জীবন, নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত, দুঃখী মানুষের মুক্তির জন্য যে পথ দেখিয়ে গেছেন এবং নিজের জীবন ও কর্মের ভিতর দিয়ে যে উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন তা পৃথিবীতে বিরল। একজন ক্ষুদ্র রাজনৈতিক কর্মী থেকে নেতৃত্বের সর্বোচ্চ সোপান। কিন্তু চরিত কাল স্বল্প। এই স্বল্প সময়ে রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণাবলি ও তার সব বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণ পরিস্ফুটন ঘটেছে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের মাধ্যমে। অকুতোভয় সাহস, দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি, সীমাহীন ত্যাগ, সব ধরনের বস্তুগত প্রলোভনকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান, মানুষের প্রতি নিখাঁদ ভালোবাসা, মানবতার প্রতীক ক্ষমা করার উদারতা, প্রতিহিংসা-প্রতিশোধমুক্ত মন, সবকিছুই তিনি আত্মস্থ করেছিলেন স্বল্প জীবনের পরিসরে। আর এর মূল উৎস ছিল বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ। তিনি ছাত্ররাজনীতি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের কর্মী ও নেতা হিসেবে সমগ্র বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরেছেন খেয়ে, না খেয়ে। তার মাধ্যমে গরিব-দুঃখী মানুষের হৃদয়ের স্পন্দনকে তিনি তার হৃদয়ে ধারণ করেছেন। একই সঙ্গে তার স্পর্শে মাটির মানুষ স্ফুলিঙ্গের মতো জেগে উঠেছে, প্রতিবাদী হয়েছে, বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে দিয়েছে এবং চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য ৩০ লাখ জীবন দিয়েছে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মৌলিক দর্শন ও আদর্শ যা বাহাত্তরের সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছিল এবং মৃত্যুর আগ দিন পর্যন্ত যে পথ ধরে তিনি মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, তার সবকিছুই তিনি ধারণ করেছিলেন বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের মধ্য থেকে। মানুষের মনের আকাক্সক্ষাগুলোকে প্রোসেস ও ফিল্টারিং করে নিজের চেতনায় পরিস্ফুটিত করেছেন এবং ফিনিশড প্রোডাক্ট বা পাকা পণ্যরূপে মানুষের সামনে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে তুলে ধরেছেন। সেগুলোকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন প্রথমে ছয় দফা এবং পরবর্তীতে বাহাত্তরের সংবিধানে। বঙ্গবন্ধুর কথা ও সুর আর বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের কথা ও সুর ছিল এক ও অভিন্ন। যার কারণে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো বাংলাদেশের মানুষ তার পিছনে ছুটেছে, মৃত্যুকে পরোয়া করেনি। এরকম একজন মহান নেতা জাতিকে যার দেওয়ার মতো যখন আরও অনেক কিছু বাকি ছিল, স্বাভাবিক জীবন চক্রের ধারায় সময়ও ছিল, কিন্তু তার কিছুই আর সম্ভব হলো না। বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য। দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী চক্রের সহায়তায় একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করল এই মহান নেতাকে। তারপর পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসা দুই সামরিক শাসক এবং তাদের থেকে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দল বিভিন্ন মেয়াদে মোট ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিল। দেশের জন্য তারা কী করেছেন? কিছু রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্ট, দু-চারটি দালানকোটা আর স্কুল-কলেজ নির্মাণ, এটা একটা রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। এটা দিয়ে কোনো সরকারের মূল্যায়ন হয় না। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও জনগণের যে সূচকগুলো রয়েছে তার অগ্রগতি এবং আগামী প্রজন্মের জন্য সম্ভাবনার দ্বার কতখানি উন্মোচন করতে পারা গেল সেটাই হয় একটা সরকারের মূল্যায়নের মাপকাঠি। বিগত সময়ে জিয়া, এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিভিন্ন মেয়াদে যখন দেশ পরিচালিত হয়েছে তখন এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে বাংলাদেশের সমপর্যায়ের যে দেশগুলো রয়েছে তাদের তুলনায় সব সূচকে বাংলাদেশ ছিল তালিকার সর্বশেষ দেশ। আর নতুন প্রজন্মের জন্য তৈরি হয় এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ। বিশ্বের বড় বড় মিডিয়া হাউস ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে ভবিষ্যৎ বাণী করা হয়, বাংলাদেশ হবে পরবর্তী আফগানিস্তান। তাতে বিশ্বব্যাপী বিরাজমান সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলো আমাদের তরুণ প্রজন্মের জন্য একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়। কারণ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মতো জঙ্গি সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের তরুণদের উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশসমূহ কখনো নিরাপদ মনে করে না। কিন্তু আজকে ২০২১ সালে এসে বাংলাদেশের চিত্র ২০০১-২০০৬ মেয়াদের চেয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানুষের জীবনমান উন্নয়নের সব সূচকে বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর প্রথম সারির দেশসমূহের মধ্যে অন্যতম। জঙ্গি সন্ত্রাস দমনে রোল মডেলের স্বীকৃতি পাওয়ায় বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের সামনে থেকে সব কালো মেঘ কেটে গেছে। বিশ্ব অঙ্গনের সব দ্বার আজ তাদের জন্য উন্মুক্ত। মেধা চর্চা এবং সুন্দর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য পুরো পৃথিবীই আজ তাদের অবারিত বিচরণ ক্ষেত্র। কোনো বাধা নেই। বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি বলেছে, দারিদ্র্য দূরীকরণে বাংলাদেশের উদাহরণ অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। নিউইয়র্ক টাইমের সাম্প্রতিক এক খবরে দেখলাম, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেন কোনো এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, দারিদ্র্য কীভাবে দূর করতে হয় তা জানতে হলে বাংলাদেশের দিকে তাকাতে হবে। এর আগে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কেনিয়ার জনগণের উদ্দেশে একই কথা বলেছিলেন। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় এসে অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রের সব সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান পাকিস্তানের চেয়ে দ্বিগুণ ওপরে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের ১ টাকা এখন পাকিস্তানের ১.৮৪ রুপির সমান। গত ১২ বছর একনাগাড়ে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর চিন্তা, দর্শন ও আদর্শের ওপর পরিচালিত হচ্ছে বলেই এত সব বড় অর্জন সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর দুই সামরিক শাসকের হাত ধরে তৈরি হওয়া অপশক্তি অনবরত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে, যাতে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ওপর পরিচালিত হতে না পারে। তাদের ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্র ও রূপ অনেক। প্রথমত, তারা জামায়াত-হেফাজতের মাধ্যমে চরম ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে দেশের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা এবং অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে চায়, যাতে সরকারকে অস্থিরতার মধ্যে ফেলে ষড়যন্ত্রের চরম অস্ত্রটি তারা প্রয়োগ করার সুযোগ পায়। এ কাজে ধর্মের চরম অপব্যবহারেও যে তারা পিছপা হবে না তার বহু প্রমাণ ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। চরম ভন্ডামি আর প্রতারণাকে অবলম্বন করে আবির্ভূত হয়েছে হেফাজতে ইসলাম। মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এরা সব সময় আরবি শব্দ ও ভাষা ব্যবহার করে। হেফাজতে ইসলাম, এর অর্থ হলো ইসলাম রক্ষাকারী। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরে কখনো কি এমন একটি ঘটনাও ঘটেছে, যার দ্বারা ইসলাম ধর্মের ক্ষতি হয়েছে অথবা হতে পারে বলে মনে হয়েছে? এমন একটি ঘটনাও ঘটেনি। বরং মসজিদ, মাদরাসাসহ ইসলামিক প্রতিষ্ঠান বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহলে ২০১৩ সালে এসে ইসলাম রক্ষাকারী একটি দল বা সংগঠনের প্রয়োজন হলো কেন? এদের প্রতারণা মানুষ ধরে ফেলেছে। তারা পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার টাকায় বলীয়ান হয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবাহী আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে চায়। বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী এবার অলিম্পিক লরেলে ভূষিত হয়েছেন। মারহাবা! ২০০৬ সালের শেষের দিকে নোবেল প্রাপ্তি, সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতে নেমে পড়া এবং ২০০৭-২০০৮ মেয়াদের কথা স্মরণ করলে ভবিষ্যতের অনেক কিছুই নজরে আসবে। অন্যদিকে আফগানিস্তানে অচিরেই ক্ষমতা দখল করবে চরমপন্থি তালেবান বাহিনী। আফগানিস্তানে তালেবান সরকার মানেই পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সরকার। কক্সবাজারে ১১ লাখ রোহিঙ্গা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে একটা ট্রাম্প কার্ডে রূপ নিচ্ছে। অত্র অঞ্চলকে ঘিরে ভূ-রাজনীতির যে নতুন সমীকরণ তৈরি হচ্ছে তাতে শেখ হাসিনা বেঁচে থাকতে বাংলাদেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি কোনো পক্ষকেই কোনো বাড়তি সুবিধা দিবেন না। এটা সবাই জানে। ষড়যন্ত্রের মনিবদের চিনতে হবে। মনিবদের থেকে সতর্ক হতে পারলে কিছু বাংলাদেশি বিতাড়িত ব্যক্তি বিদেশের মাটিতে বসে ঘেউ ঘেউ করে কিছু করতে পারবে না। এরা পোষা প্রাণীর মতো মনিবের অঙ্গুলি হেলনে লম্ফঝম্ফ এবং ডাকাডাকি করে। এদের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে তা এখনো চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে। তাদের মূল লক্ষ্য শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে মাইনাস করা অথবা হত্যা করা। কিন্তু এটা ১৯৭৫ নয়, এটা শেখ হাসিনার নতুন বাংলাদেশ। কোনো ষড়যন্ত্র সফল হবে না, যদি আওয়ামী লীগের ভিতরে ঢুকে পড়া জামায়াত-বিএনপির চরদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় এবং ষড়যন্ত্রের ভিতরে চরম দুর্নীতিপরায়ণ কিছু মানুষ যারা টাকার লোভে দেশ বিক্রি করে দিতে পারে তাদের নিষ্ক্রিয় রাখা সম্ভব হয়।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।