সোমবার, ২১ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন এ যুগের শায়েস্তা খাঁ

সুমন পালিত

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন এ যুগের শায়েস্তা খাঁ

জীবনের পরপারে চলে গেলেন এ যুগের শায়েস্তা খাঁ। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অন্তিম বিদায় নিয়ে লিখতে গিয়ে এমন অভিধা কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কারণ শায়েস্তা খাঁ ছিলেন দিল্লির মুঘল সাম্রাজ্যের একজন সুবেদার অর্থাৎ প্রাদেশিক গভর্নর। আর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন ছিলেন স্বাধীন দেশের প্রধান বিচারপতি। দুই মেয়াদে তিনি রাষ্ট্রপ্রধানের পদও অলংকৃত করেছেন। একবার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদে। আরেকবার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে।

মধ্যযুগে সেই মুঘল আমলে দিল্লি থেকে শায়েস্তা খাঁ সুবেদার হয়ে আসেন বাংলাদেশে। তিনি ছিলেন সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের ভাইয়ের ছেলে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শ্যালকপুত্র। তার বোন মমতাজ মহল ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের প্রিয়তমা স্ত্রী। মমতাজের মৃত্যুর পর তাঁর কবরের ওপর নির্মিত হয় দুনিয়ার সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ও মূল্যবান সমাধি সৌধ তাজমহল।

শায়েস্তা খাঁ যখন বাংলাদেশে আসেন তখন এ দেশের অবস্থা ছিল বেশ নাজুক। দেশজুড়ে ছিল মগ জলদস্যুদের উৎপাত। পাশাপাশি পর্তুগিজ জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য। তারা যেখানে-সেখানে লুটপাট চালাত। মানুষকে বন্দি করে বিক্রি করে দিত দাস বাজারে। জোর করে খ্রিস্টান হতে বাধ্য করত। মগ আর পর্তুগিজ জলদস্যুদের শায়েস্তা করার দায়িত্ব অর্পিত হয় শায়েস্তা খাঁর কাঁধে। মগ জলদস্যুদের দস্যুতার মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় বণিক আর সাধারণ মানুষ সে সময় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। বিদেশি বণিক তো দূরের কথা, মোগল সাম্রাজ্যের অন্য এলাকার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারত না বাংলার মানুষ। জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। মগ আর পর্তুগিজ জলদস্যুদের নিশ্চিহ্ন করতে পারলে ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধি আসবে এমনটি ভেবে শায়েস্তা খাঁ ইংরেজদের সহায়তা চান। তবে ইংরেজরা শায়েস্তা খাঁকে সাহায্য করেনি। বাধ্য হয়ে তিনি জলদস্যু দমনে ওলন্দাজদের সহায়তা চান। তারা রাজি হয়। তবে সে সহায়তা পাওয়ার আগেই ভয়ভীতি দেখিয়ে পর্তুগিজ জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে আনেন শায়েস্তা খাঁ। মগদের দমনে তিনি ৪৩ হাজার সেনার বিশাল বাহিনী গড়ে তোলেন। নদী এবং স্থলপথে সম্মিলিত বাহিনী পাঠানো হয় মগ দস্যু দমনে। মোগল সৈন্যরা মগদের মনে ভয় ঢুকাতে সফল হয়। দস্যুতা করে বেড়ানো মগদের ধাওয়া করে আরাকানে ফেরত পাঠানো হয়। মগ এবং পর্তুগিজ আধিপত্য কমে আসায় বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসে। আরাকানদের কাছ থেকে চট্টগ্রাম দখল করেন তিনি। শায়েস্তা খাঁ বাংলাদেশে শুধু শান্তি প্রতিষ্ঠা নয়, নিত্যপণ্যের দাম মানুষের নিয়ন্ত্রণে আনার কৃতিত্ব দেখান। তাঁর আমলে টাকায় আট মণ চাল বিক্রি হতো। তিনি যখন সুবেদারের দায়িত্ব পালন শেষে দিল্লিতে ফিরে যান তখন তৈরি করেন একটি তোরণ। যে তোরণটি বন্ধ করে লাগানো হয় তালা। সেখানে একটি স্মারক চিহ্ন লিখে রাখা হয়। বলা হয় যদি কোনো শাসকের আমলে টাকায় আট মণ চাল বিক্রি হয়, তবে তিনি এ তোরণ খুলতে পারবেন।

শায়েস্তা খাঁর সেই তোরণ খোলা হয় ৪০ বছর পরে। সুবেদার সরফরাজ খানের আমলে। সে সময় চালের দাম ওই পর্যায়ে নেমে এসেছিল।

বলছিলাম বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের কথা। যাকে তুলনা করা যায় শায়েস্তা খাঁর সঙ্গে। শায়েস্তা খাঁ জনমনে শ্রদ্ধার যে আসন গড়ে তুলেছিলেন শত শত বছর পরও তা প্রাতঃস্মরণীয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের কৃতিত্ব কোনো অংশে শায়েস্তা খাঁর চেয়ে কম নয়। বরং অনেক অনেক বেশি। তিনি শায়েস্তা খাঁর মতো সৌভাগ্যের বরপুত্র ছিলেন না। বরং নিজ যোগ্যতায় দেশের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার পেমল গ্রামে ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৫১ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক এবং ১৯৫২ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। লাহোর সিভিল সার্ভিস একাডেমি থেকে সাফল্যের সঙ্গে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকপ্রশাসন বিষয়ে বিশেষ কোর্স করেন। ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে এবং পরে গোপালগঞ্জ ও নাটোরের মহকুমা প্রশাসক পদে চাকরির পর সাহাবুদ্দীন আহমদ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদে পদোন্নতি পান। ১৯৬০ সালের জুন মাসে তাঁকে বিচার বিভাগে বদলি করা হয়। প্রশাসনের নির্বাহী বিভাগে তাঁর চাকরির সমাপ্তি ঘটে। তিনি ঢাকা ও বরিশালে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা হাই কোর্টের রেজিস্ট্রার নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে বাংলাদেশ হাই কোর্টের বিচারক পদে উন্নীত করা হয়। তিনি প্রেষণে নিযুক্ত হয়ে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি বিচারপতি হিসেবে হাই কোর্ট বিভাগে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৮০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সাহাবুদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক পদে নিয়োগ পান। বাংলাদেশ সংবিধানের ৮ম সংশোধনীর ওপর তাঁর প্রদত্ত রায় দেশের শাসনতান্ত্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে এক অনন্য ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত। এ রায়ে তিনি অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে নিজেদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করা, গোষ্ঠী শাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, জনগণের সার্বভৌমত্বের বিরোধিতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অস্বীকৃতি এবং আইনের শাসনের পরিবর্তে আদেশ জারির মাধ্যমে সংবিধান রহিত করার প্রবণতার জন্য তৃতীয় বিশ্বের একনায়ক শাসকদের সমালোচনা করেন। বিচার বিভাগে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও ছুটির ক্ষেত্রে হাই কোর্টের চিরাচরিত ক্ষমতা খর্ব করা এবং রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক নিম্ন আদালত নিয়ন্ত্রণেও তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেন তাঁর রায়ে।

নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে সেনাশাসক  লে. জেনারেল এইচ এম এরশাদ সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে আসেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। এরশাদ পদত্যাগ করার পর রাষ্ট্রপতি পদে কে আসবে, নির্বাচন পর্যন্ত অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কে হবেন-সে বিষয়ে গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়।  এ বিষয়ে ৮ দল, ৭ দল ও ৫ দলীয় জোটের মধ্যে দেখা দেয় আস্থার সংকট। শেষ পর্যন্ত প্রধান বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে সমঝোতা হয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন রাষ্ট্রপতি পদে যেতে রাজি হননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে আবার ফেরার শর্তে  রাজি হন। মওদুদ আহমদ উপ-রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দিলে সে দায়িত্বে আসেন সাহাবুদ্দীন। ৬ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা ছাড়লে তিনি রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করেন। পরে তাঁর নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। নির্বাচনের পর আবার প্রধান বিচারপতি পদে ফেরেন তিনি। এ জন্য দেশের সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয়। যথারীতি প্রধান বিচারপতি চাকরি শেষে তিনি অবসরে যান।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তাকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করলে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত পুরো পাঁচ বছর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। দেশের প্রধান বিচারপতি ও রাষ্ট্রপতি পদে তিনি সক্রিয় নিরপেক্ষতার নজির রেখেছেন। রাষ্ট্রপতি যে জাতীয় ঐকমত্যের প্রতীক, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তাঁর দায়িত্ব পালনকালে সেটি স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব থাকাকালে সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের কালাকানুন বাতিল করেন। এ বিষয়ে আন্দোলনকারী তিন জোটও ছিল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু বিচারপতি সাহাবুদ্দীন এ বিষয়ে অপেক্ষা করা যুক্তিযুক্ত মনে করেননি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রত্যয়ী।

শায়েস্তা খাঁ সেই মধ্যযুগে সুশাসন ও সুনীতির প্রতিফলন ঘটিয়ে জনমনে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। অভিন্ন কৃতিত্ব বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের। মৃত্যুর শীতল ছায়া তাকে কেড়ে নিলেও আগামী দিনেও সুনীতি ও সুবিবেচনার প্রতীক হিসেবে নন্দিত হবেন বোদ্ধাজনদের মধ্যে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে অন্তিম অভিবাদন।  

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর