সোমবার, ২৮ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

একটি ব্যক্তিগত দুঃখগাথা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

একটি ব্যক্তিগত দুঃখগাথা

গাড়ি চলছে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের উদ্দেশে। বাসের নাম মায়ের দোয়া পরিবহন। জরুরি কাজে বরিশাল যাওয়া। কাজ শেষে হাতে এক দিন সময় থাকায় কুয়াকাটার উদ্দেশে যাত্রা। বরিশাল শহর থেকে বাস যখন পটুয়াখালী এসে পৌঁছল তখন একজন ভিক্ষুক বাসে উঠলেন। বয়স ৪০-এর আশপাশে। গায়ের রং শ্যামলা। ছোটখাটো মানুষ। উঠেই ঠিক শিশু বাচ্চার মতো ডাকাডাকি শুরু করলেন। আহলাদি কিন্তু দরদি সুরে যাত্রীদের উদ্দেশে বলছেন, ‘এই যে ভাইয়া! এই দেখেন, ভাইয়া! কিছু দ্যান...!’ সেদিন সকালে প্রচুর শীত ছিল। কিন্তু দুপুরবেলা পড়েছে প্রচন্ড গরম। এমনিতেই বাসের জার্নি খুব কষ্টের। গরমে অবস্থা আরও কাহিল। এর মধ্যে ভিক্ষুকের বিরক্তিকর ডাকাডাকি। মেজাজটা চড়ে গেল। ভিক্ষুকের ওপর নয়, ভিক্ষাবৃত্তির ওপর। পৃথিবীর বৈষম্যপূর্ণ অর্থব্যবস্থা এবং ছোটলোকি চিন্তাভাবনার ওপর। আজ যারা গরিব, ভিক্ষা যাদের পেশা, না খেয়ে থাকা যাদের নিয়তি, তারা চাইলে হয়তো ভাগ্য বদলাতে পারেন। বহু মানুষ কুঁড়েঘর থেকে রাজপ্রাসাদের মালিক হয়েছেন। কীভাবে হয়েছেন? পরিশ্রম ও কৌশলী জীবনযাপনের মাধ্যমে। আমাদের দেশের ভিক্ষুকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভিক্ষুকই পেশাদার ভিক্ষুক। এদের ভিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে শরিয়তে আপত্তি আছে। এসব বিষয় আমি আগে থেকেই ভাবতাম। আমার সিট ছিল বাসের মাঝামাঝি। ভিক্ষুকটি বাসের সদর দরজা থেকে ডাকাডাকি শুরু করেছে, এখনো ডেকেই চলছে। যতই অপছন্দের হোক, ভিক্ষুককে ধমক দেওয়ার অনুমতি ইসলামে নেই। সুরা দোহায় আল্লাহ তার নবী (সা.)-কে বলেছেন, ‘হে নবী! আমি আপনাকে নিঃস্ব অবস্থা থেকে ধনী করেছি। সুতরাং কোনো নিঃস্ব-অসহায়-সাহায্যপ্রার্থীর সঙ্গে ধমক দিয়ে কথা বলবেন না।’ যেখানে নবীজিকেই আল্লাহ ভিক্ষুক-সাহায্যপ্রার্থীকে ধমক দিতে নিষেধ করেছেন, সেখানে উম্মতকে তো সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতেই হবে। তবে উম্মত যত সতর্কই হোক, শয়তানের ধোঁকা তারচেয়েও বেশি সূক্ষ্ম। আশার কথা হলো আল্লাহর দয়া ও ক্ষমা শয়তানের ধোঁকার চেয়েও বড়।

পাশেই আমার সফরসঙ্গী। সামনের সিটের পিছন দিকটায় মুখ গুঁজে ঘুমাচ্ছিলেন তিনি। ভিক্ষুক লোকটা এতই বিরক্তির ছিল যে, প্রতিটি ঘুমন্ত ব্যক্তিকেই ডেকে তুলে ভিক্ষা চাইছিল। আমার সফর সঙ্গীকে যখন ঘুম থেকে জাগানোর জন্য জোরে জোরে ‘এই যে ভাইয়া দেখেন’ বলে ডাকতে শুরু করল, তখন আমি অনেকটা বিরক্তি মেশানো গলায় বললাম, ‘দেখতেই তো পাচ্ছেন মানুষটা ঘুমাচ্ছে...।’ এতটুকু বলেই আমার কথা বন্ধ হয়ে গেল। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। এখন দেখলাম, লোকটার দুই হাত সিনা থেকেই কাটা। মনের ভিতর কে যেন হামার দিয়ে বাড়ি দিল। ভিতরে বয়ে যাওয়া একটি ঠান্ডা স্রোত আমাকে নিস্তেজ করে দিল। কত ভিক্ষুক দেখেছি। পঙ্গু, পা নেই, এক হাত নেই, বিকলাঙ্গ; কিন্তু একেবারেই দুই হাত নেই এমন ভিক্ষুক প্রথম দেখলাম। আহারে, মানুষের কাছে চাইতে হলে বা মানুষের থেকে কিছু নিতে হলে তো হাত বাড়িয়েই নিতে হয়। কিন্তু লোকটার তো সে হাতই নেই। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ভিক্ষুকটি চলে গেল এবং বাস আবার ছুটতে শুরু করেছে টেরই পায়নি।

তার এক দিন পর দুপুরের ঘটনা। খুব একটা বাইরে খাওয়া হয় না তাই শখ করে মধ্যাহ্নভোজের জন্য এসেছি মতিঝিলের একটি অভিজাত রেস্তোরাঁয়। সবচেয়ে কম মূল্যের এক প্লেট খাবারের দাম ৩০০ টাকা। আমি একাই ৩০০ টাকার খাবার অনেকবার খেয়েছি। কিন্তু সেদিন দুপুরে যা দেখলাম তাতে চোখ ছানাবড়া অবস্থা। এই দুর্মূল্যের বাজারে এত দামি খাবার খাওয়ার জন্য আমাকে কমপক্ষে ৩০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। আগেই বলেছি, রেস্তোরাঁটি অভিজাত। মানে বসার পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে। তবুও এত ভিড়!

হঠাৎ কানে ভেসে উঠল সেই ডাক, ‘এই যে ভাইয়া, দেখেন...কিছু দ্যান!’ মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল। নিজেকে এত অপরাধী মনে হলো ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমার সঙ্গে মেহমান ছিল। তিনি বললেন, হঠাৎ আপনি গম্ভীর হয়ে গেলেন কেন? আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। একজন ভালো মানুষের কাজ হতো যদি সঙ্গে সঙ্গে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে যেতে পারতাম। লজ্জায় অতিথিকে সে কথা বলতে পারিনি। খাওয়ার সময় খাবার সামনে নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি, গলা দিয়ে খাবার নামেনি। অনেকবারই মেহমানের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যের হাসি হেসেছি। বিখ্যাত লেখক শিবখেরা বলেছেন, হাসি সুন্দর, কিন্তু তা যদি হয় আন্তরিকতাশূন্য তবে এরচেয়ে বিশ্রী আর কিছু নেই। সেদিন মেহমানও বুঝতে পেরেছেন আমি শুধু নিয়ম রক্ষার হাসিই হেসে গেছি কেবল, মনটা পড়েছিল অন্যখানে।

প্রভুকে বললাম, হে আল্লাহ! পৃথিবী থেকে ধনী-গরিবের এই জঘন্য বৈষম্য দূর করার তাওফিক আপনি আমাকে দিন। যেন আর কোনো বনি আদম একবেলা খাওয়ার জন্য মানুষের কাছে হাত না পাতে। আরেকটি কথাও আল্লাহর কাছে বলেছি। তা হলো, আমরা যারা খাওয়ার পিছনে প্রতিযোগিতা করে অপব্যয় করি, তাদের মনে যেন ওই সব মানুষের জন্য একটু দয়া সৃষ্টি করেন। আমিন।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর