ইংল্যান্ডের রাজা জন তাঁর রাজনৈতিক সংকটের একটি বাস্তবসম্মত সমাধানের জন্য ১২১৫ সালে বিরোধীদের সঙ্গে এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। বিশ্ব ইতিহাসে এটি ‘ম্যাগনা কার্টা’ বা ‘দ্য গ্রেট চার্টার’ হিসেবে পরিচিত। এতে প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠিত হয় কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এমনকি রাজা, ব্যক্তির মানবিক অধিকার ও ব্যক্তির ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার।
বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে প্রধান বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদের ঐতিহাসিক বিচারিক অনেক রায় ‘ম্যাগনা কার্টা’ হিসেবে আইনের জগতে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। মানুষের মৌলিক অধিকার, সুশাসন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদের বিচারিক রায়গুলো তথাকথিত ব্যাসিক ডেমোক্র্যাসির লেবাসে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের শরীরের মাংসপিণ্ডে এক একটি কাঁটা হয়ে ওঠে। বিচারপতি মোর্শেদকে কেবল জাতীয়তাবোধই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রশংসা, খ্যাতি অর্জন ও আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে যায়। পেশাগত জীবনে তাঁর কঠোর পরিশ্রম, অসামান্য মেধা এবং জ্ঞান অর্জনের অফুরন্ত ক্ষুধা তাঁকে নিয়ে গেছে খ্যাতির শীর্ষ অবস্থানে। ১৯৫৪ সালের শেষের দিকে তিনি ঢাকা হাই কোর্টে যোগ দেন এবং একই বছর বিচারক পদে নিযুক্ত হন। বিচারপতি মোর্শেদ পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৬২ থেকে ’৬৩ সাল পর্যন্ত। ’৬৪ সালে তিনি হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিত হন। প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি নিম্ন আদালতের ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন। সামাজিক ন্যায়বিচার, স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ধারণা এবং তা কার্যকরের ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বিচারপতির দায়িত্ব পালনকালে তাঁর কিছু ঐতিহাসিক রায় ও সাংবিধানিক ব্যাখ্যা উপমহাদেশের পরিধি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপক প্রশংসিত হয়। আইন পেশায় সুখ্যাতি অর্জনের পাশাপাশি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক কঠিন সময়ে বিচারপতি মোর্শেদ এগিয়ে এসেছিলেন এবং দায়িত্ব নিয়েছিলেন একজন অকুতোভয় বীর সৈনিকের মতো। তাঁর দূরদর্শী চিন্তা, মেধা, পরিশ্রম এবং সোচ্চার ভূমিকার জন্য এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ এবং বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী মহলের এক বিরাট সমর্থন লাভ করেছিল।
ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভের পর পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন-শোষণের বিপরীতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়নে মাহবুব মোর্শেদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি আবুল মনসুর আহমদের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকারের ২১ দফা ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করেন। আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে ১৯৬৬ সালে ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি মাজহারুল হক বাকী পরবর্তী সময়ে বলেছিলেন যে প্রধান বিচারপতি মোর্শেদ ছাড়া অন্য কেউ তাঁদের বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করতে সাহস করেননি। বিচারপতি মোর্শেদ তাঁর জীবৎকালে শুধু ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না তিনি নিজেই সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস। বিচারপতি মোর্শেদের পেশাগত সুখ্যাতি, আভিজাত্যময় ব্যক্তিত্ব, উচ্চ মর্যাদাশীল হওয়া সত্ত্বেও সাধারণের মধ্যে অংশগ্রহণ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা ও অবস্থানের গুরুত্ব জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হয়েছিল। সে সময় ঐতিহাসিক ‘নেহরু-লিয়াকত’ চুক্তি প্রণয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, আইয়ুব খানের ঐতিহাসিক গোলটেবিল বৈঠকে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯৬৯) সমগ্র পাকিস্তানের যে ৩৫ নেতা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন, বিচারপতি মোর্শেদ ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সে বৈঠকে বিচারপতি মোর্শেদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।ইতিহাসবিদদের মতে সেদিন গোলটেবিল বৈঠকে বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদের ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ এ দাবি সামরিক জান্তাদের রক্ত চোখের সামনে থেকে ছিনিয়ে আনেন। এর আগে পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের সমানসংখ্যক আসন নির্ধারিত ছিল। মাহবুব মোর্শেদের দেওয়া প্রস্তাব ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ নীতি গ্রহণের ফলে নির্ধারিত ৩০০ আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫০ থেকে বেড়ে ১৬৯-এ। রাজনৈতিকভাবে এ আসন সংখ্যার বিভাজনটি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীকে ব্যাপকভাবে পরাভূত করে, যার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় ১৯৭০ -এর নির্বাচনে। বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদের এ অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যখন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আইয়ুব খান তাঁর সামরিক শাসন পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে ঐতিহাসিক ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা দায়ের করেন সে সময় বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ ইতিহাস সৃষ্টি করে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে জনতার কাতারে এসে দাঁড়ান। বিচারপতি মোর্শেদ গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানুষের অধিকারে বিশ্বাস করতেন এবং সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতেন। তিনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মারফত গণতন্ত্রের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করেছেন এবং সফলতাও অর্জন করেছেন।
প্রধান বিচারপতি পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর প্রথমেই তিনি মনোযোগ দেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের পক্ষে মামলার প্রস্তুতি গ্রহণের এবং পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গঠন করেন। এ জনমত গঠনের মাধ্যমেই মাহবুব মোর্শেদ রাজনীতিতে সরাসরি পদার্পণ করেন। তিনি সামনে থেকে আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ব্যাপক ‘আইয়ুববিরোধী আন্দোলন’ (Anti-Ayub Movement) গড়ে তোলেন। সে সময়ের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব আসামির গ্রেফতারি পরোয়ানার বিরুদ্ধে ও তাঁদের মুক্তির জন্য সভা-সমাবেশ, সেমিনার করেন এবং আন্তর্জাতিক মহলে আবেদন জানান। তাঁর এ অবদানের কথা ইতিহাসের পাতা থেকে কখনো মোছা যাবে না। তাঁর মতো গুণীর জন্ম বারবার হবে কি না এ প্রশ্নের উত্তর না জানলেও তিনি আমাদের মধ্যে আছেন জীবন্ত ইতিহাস হয়ে তা জানি।
লেখক : আইনজীবী।