বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

ছেলেবেলার সেই বর্ষবরণ

তপন কুমার ঘোষ

ছেলেবেলার সেই বর্ষবরণ

বাংলা বর্ষবরণের প্রাক্কালে ছেলেবেলার দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। ফিরে যাই শৈশবের সেই নানা রঙের দিনগুলোয়। নড়াইলের অজপাড়াগাঁর একটি পটভূমি থেকে রাজধানী ঢাকায় এসেছি সত্তরের দশকের শুরুতে, উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে। অর্ধশতবর্ষ পেরিয়ে গেছে। স্মৃতিতে ধূসর হয়ে উঠেছে অনেক কিছুই। আমাদের ছেলেবেলায় বাংলা বর্ষবরণের মূল আকর্ষণ ছিল বৈশাখী মেলা আর হালখাতার অনুষ্ঠান। সেই সাদা-কালো যুগেও মেলার সবকিছু রঙিন মনে হতো। ছোটদের কাছে মেলা ছিল বিনোদনের। আর বড়দের কাছে ছিল প্রয়োজনের। মেলায় চিত্তবিনোদনের নানা ব্যবস্থা থাকত। নাগরদোলায় প্রথম ওঠার মিশ্র অনুভূতি আজও ভুলিনি। সদ্য ভাজা পাঁপড়, মচমচে চানাচুর, গরম জিলাপি আর রঙিন বন্দিয়ার লোভ সামলানো ছিল কঠিন। ছোটদের জন্য ভেঁপু, বাঁশের বাঁশি, বেলুন, মাটির পুতুল, শোলার পাখি, ঢোল, ডুগডুগি, মুখোশসহ আরও কত কি বিক্রি হতো মেলায়। মেয়েদের প্রসাধনসামগ্রী যেমন কাচের চুড়ি, রঙিন ফিতে, কানের দুল, আলতা-সিঁদুর, স্নো, পাউডারের পসরা সাজিয়ে বসতেন দোকানিরা। এ ছাড়া গৃহস্থালির জন্য প্রয়োজনীয় কুলা, চালনি, কাঠের পিঁড়ি, মাটির হাঁড়ি-পাতিল, নকশা করা মাটির সরা সবই পাওয়া যেত। গৃহস্থরা দা-কুড়াল, ছুরি-কাঁচি, লাঙ্গল ইত্যাদি মেলা থেকে সংগ্রহ করতেন। নড়াইলের প্রাচীনতম মেলা টেংরাখালীর ‘বউমেলা’। প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো। সদর উপজেলার সিঙ্গাশোলপুর ইউনিয়নের বড়কুলা গ্রামে প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমায় উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হয়ে আসছে জমজমাট বউমেলা। এখন পাল্টে গেছে মেলার ধরন। বাঁশ, বেত বা মাটির তৈরি পণ্যসামগ্রীর কদর আগের মতো নেই। বাজার এখন প্লাস্টিক-মেলামাইন-অ্যালুমিনিয়াম আর সিরামিক পণ্যের দখলে। কৃষিজমিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে চাষাবাদ হচ্ছে। ফলে সনাতন পদ্ধতিতে চাষবাসের উপকরণের চাহিদা এখন নেই বললেই চলে।

পয়লা বৈশাখে ব্যবসায়ীরা ঘটা করে হালখাতা উৎসব আয়োজন করতেন। এ উপলক্ষে রঙিন নিমন্ত্রণপত্র বিলি করা হতো। গ্রাহকরা সামর্থ্য অনুসারে দেনা আংশিক বা সম্পূর্ণ পরিশোধ করতেন। দোকানিরা হিসাব-নিকাশ হালনাগাদ করে নতুন বছরে লালশালুর মলাটে মোড়ানো নতুন খাতায় তা লিখে রাখতেন। এ অনুষ্ঠানে গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করাতেন দোকানিরা। বড়দের হাত ধরে কচিকাঁচারাও যেত হালখাতার অনুষ্ঠানে।

শান্ত-শ্যামল গ্রাম সুমেরুখোলা। আজও পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে গ্রামের মানুষের। গ্রামের কোলঘেঁষে বয়ে গেছে চিত্রা নদী। চৈত্রের ভরদুপুর। মাথার ওপর কাঠফাটা রোদ। পায়ের নিচে তপ্ত বালুকণা। দমকা গরম হাওয়া বইছে। একটু স্বস্তি পেতে সমবয়সীরা মিলে নদীতে ঝাঁপ দিতাম। নদীর জলে কিছুক্ষণ দাপাদাপি। একসময় ডুবসাঁতার দিয়ে দূরে ভেসে ওঠা। এভাবেই কেটেছে দুরন্ত শৈশব। নদীর ঘাটে সকাল-বিকাল আড্ডা দেওয়া ছিল আমাদের নিত্যদিনের অভ্যাস। চিত্রার দখিনা বাতাস জুড়িয়ে দিত প্রাণ। আড্ডা ছিল গ্রামের মানুষের প্রিয় বিনোদন। কী সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো!

ছোটবেলায় বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল রেডিও। বিনোদনমূলক অনেক অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে। আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বাংলা নাটক ও ‘অনুরোধের আসর’ ছিল বেশ জনপ্রিয়। বিবিসির সন্ধ্যাবেলার খবর শোনার জন্য আগ্রহভরে অপেক্ষা করতেন গ্রামের মানুষ। মহকুমা শহর নড়াইলে কোনো সিনেমা হল ছিল না। সিনেমা দেখতে যেতে হতো জেলা শহর যশোরে। নড়াইলে টেলিভিশন পৌঁছেছে আরও অনেক পরে। গ্রামে-গঞ্জে ফুটবল খেলা ছিল খুব জনপ্রিয়। ক্রিকেট অতটা জনপ্রিয় তখন হয়নি। আনন্দ-উৎসবের অনেক উপলক্ষ ছিল। এখনকার মতো জীবন অতটা যান্ত্রিক ছিল না। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, কবিগান, জারিগান, যাত্রাপালা, সার্কাস, নৌকাবাইচ, ঘোড়দৌড়- এসব ছিল আমাদের ছেলেবেলার নির্মল বিনোদন। এলাকার কবিয়াল বিজয় সরকার ও মোসলেম বয়াতির খুব নামডাক ছিল দেশজুড়ে।

আমাদের ছেলেবেলায় এখনকার মতো ঘটা করে জন্মদিন পালন করা হতো না। ইদানীং লক্ষ্য করছি জন্মদিনের অনুষ্ঠানের ছবিতে সয়লাব সোশ্যাল মিডিয়া। কেক কাটা হয় মধ্যরাতে। জন্মদিনে মা যত্ন করে পায়েস বানাতেন। ওটাই ছিল ফিবছর আমার জন্মদিন উদ্যাপন। মায়ের হাতের পায়েস ছিল যেন অমৃত!

পাড়ার মেয়েরা মাঝেমধ্যে চড়ুইভাতির আয়োজন করত। এ আয়োজনে ছেলেরা দূর থেকে দর্শকমাত্র। আয়োজন সামান্যই। কিন্তু এ সামান্য আয়োজন কেন্দ্র করে পাড়ার মেয়েদের সে কী উৎসাহ। ‘চড়ুইভাতি’ শব্দটার সঙ্গে আমার সেই প্রথম পরিচয়। সামাজিক অনুষ্ঠানে দিনভর মাইকে বাজানো হতো গ্রামোফোন রেকর্ডের গান। একে বলা হতো কলের গান। চৈত্রে খাল-বিল শুকিয়ে যেত। পলো দিয়ে মাছ ধরার উৎসব দেখতে জড়ো হতো শত শত মানুষ। এদিন দারুণ মজা হতো।

শৈশব-কৈশোরের সেই গ্রাম এখন বদলে গেছে। বৈদ্যুতিক বাতি, বৈদ্যুতিক পাখা, ফ্রিজ-টেলিভিশন এখন ঘরে ঘরে। অধিকাংশ বাড়িতেই ডিশ সংযোগ। প্রায় সবার হাতে মুঠোফোন। নতুন প্রজন্মের অনেকের হাতে স্মার্টফোন। সুলভে ইন্টারনেট প্যাকেজের অফার। গ্রামের বাড়িতে বসেই দেখছে ইউটিউব-ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ-মেসেঞ্জার। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া ছবি আর অসত্য তথ্যের ছড়াছড়ি। উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব করা হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের একাংশের সময় কাটে স্মার্টফোনের ছোট পর্দায় চোখ রেখে। পর্দার বাইরের জগতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ কম। সুস্থ বিনোদনের জায়গা দখল করে নিয়েছে অসুস্থ বিনোদন। এটা সুলক্ষণ নয়। এর ফলে সামাজিক অপরাধ বাড়ছে। পরিবারে সৃষ্টি হচ্ছে নানা টানাপোড়েন। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রতারণা ঘটছে এন্তার। এর শেষ কোথায় কে জানে!

লেখক : পরিচালক, পরিচালনা পর্ষদ, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর