শনিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

কৃষকের বাংলা নববর্ষ

শাইখ সিরাজ

কৃষকের বাংলা নববর্ষ

ঠিক পয়লা বৈশাখে এ লেখাটি লিখতে বসেছি। সবাইকে বাংলা ১৪২৯ বঙ্গাব্দের শুভেচ্ছা। আমাদের অধিকাংশ কাজকর্মের সঙ্গে ইংরেজি সন-তারিখের প্রাধান্য থাকলেও বাঙালির জীবনের সঙ্গে মিশে আছে বাংলা সন-তারিখ। বাংলা বর্ষের সঙ্গেই বাঙালির ঋতুবৈচিত্র্য ও পালাবদল। বাংলা তারিখের সঙ্গে চান্দ্র ও ফসলি সনের সম্পর্ক। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে বাংলা দিনপঞ্জির অপরিহার্যতা যেন হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রামীণ জীবনে শুধু ফসলের আবর্তনের সঙ্গে মিশে আছে ঋতুবৈচিত্র্যের খেলা। শহরে-নগরে বাংলা বর্ষপঞ্জির হিসাব গৌণ হয়ে গেলেও মোটা দাগে সামনে এসে গেছে বর্ষবরণের উচ্ছ্বাস। অগ্রহায়ণে সে সময় নতুন ফসলও উঠত। এ থেকে ধারণা করা যেতে পারে প্রাচীন বাংলায় হয়তো বছরের প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ। সম্রাট আকবরের নির্দেশে আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌরবর্ষের বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটি বর্ষপঞ্জি প্রণয়ন করেন। মূলত হিজরি সনকে ফসলি সনে রূপান্তরিত করা হয়। তবে মাসের নামের ক্ষেত্রে বাংলা নামগুলোই রাখা হয়। সে সময় থেকে বৈশাখকে প্রথম মাস হিসেবে গণনা করা হয়। এ হিসেবে আজকের বাংলা সনের জন্ম ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে।

আবহমান বাঙালির গ্রামীণ সংস্কৃতি, কৃষি ও কৃষককে ঘিরে যে জীবন বাস্তবতা, সেখানে বাংলা বর্ষপঞ্জির এক গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। মাসের সঙ্গে মিলিয়ে ঋতুবৈচিত্র্যের পালাবদলের দৃশ্যপট বাঙালির মতো এত গভীরভাবে আর কোনো জাতি উপলব্ধি করে না। বাঙালির জীবনযাপন ও ফসলি বৈচিত্র্যের সঙ্গেই আবর্তিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে যে বারোমাসির সন্ধান পাই সেখানে নানা বিষয়ের মধ্যে ঋতুবৈচিত্র্য ও ফলফসলের কথাই বারবার উচ্চারিত হতে দেখি।

এখনো গ্রাম বাংলায় বৈশাখের সঙ্গে খেতের ফসলের সম্পর্ক অনেক বেশি গভীর। এখন মাঠে মাঠে ফসল বৈচিত্র্য বেড়েছে। বিভিন্ন ফসলের নতুন নতুন জাত এসেছে। সারা বছরই পাওয়া যায় বেশির ভাগ ফসলের ফলন। তার পরও বছরের শুরুতে কৃষকের কোন ফসলটি ঘরে উঠছে বা মাঠে রয়েছে সে হিসাবটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কৃষক সূর্যের উত্তাপ থেকে শুরু করে ফসলের সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধির সঙ্গেই জীবনকে রাঙিয়ে থাকে। তাই বৈশাখ তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বৈশাখের এই সময়ে এখন গাছে গাছে মৌসুমি গুটি আম। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষকের গাছে রয়েছে পরিণত আকারের বারোমাসি আম। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে ফসল চাষাবাদে। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় এখন অতিগরমের ফলে আমের গুটি ঝরে পড়ছে। পানির অভাবে ফসলি খেত ও আম-লিচুর বাগানের ফলন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও বাজারে উঠতে শুরু করেছে পরিণত কাঁচা আম। আবার কোথাও গাছে গাছে বড় হচ্ছে লিচু। মৌসুম সামনে রেখে কৃষকের কাছে, ফলের এ সম্ভাবনাই যেন নিয়ে আসে বৈশাখী আমেজ।

টাঙ্গাইলের মধুপুর কিংবা রাঙামাটির পাহাড়ি অঞ্চলে এ বৈশাখে খেতে খেতে ভরপুর জলডুবি আনারস। কৃষকের কাছে এ আনারসই ছড়াচ্ছে বৈশাখী আমেজ। ভোলা, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে এখন আনারসের ভরা মৌসুম। আনারস ঘিরেই তাঁরা হিসাব কষছেন বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির।

প্রযুক্তিভিত্তিক কৃষি ও ফসল বৈচিত্র্যের এই সময়ে মাঠে মাঠে এখন প্রধান ফসল বোরো ধানের সবুজ সমারোহ। এ সময়ই হাওরাঞ্চলে ধান কাটা শুরু হয়। এবার আগাম বন্যাসহ নানা কারণেই হাওরের অনেক জমি ডুবে গেছে। অনেক কৃষক রক্ষা করতে পারেননি তাঁদের ধান। অনেকেই ফসল রক্ষায় আধপাকা ধান কেটে নিতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকেই রক্ষা করতে পেরেছেন তাঁদের সোনাফসল। তবে এর মধ্যেই সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকায় পাহাড়ি ঢলে কিছু জমির ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষক। এক সংবাদ সম্মেলনে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল জাহিদ ফারুক বলেছেন, আকস্মিক বন্যায় হাওরের ৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।

একইভাবে এবার চৈত্রের শেষেই বাজারে গিয়ে সংকট গুনতে হয় কৃষককে। পিঁয়াজ চাষিরা শোনান হতাশার বার্তা। উৎপাদন খরচের অর্ধেক দাম না পাওয়ার বঞ্চনা দিয়েই এবার বৈশাখ শুরু হচ্ছে তাঁদের।

বছরজুড়ে বহু সাফল্য আর বৈচিত্র্যের ভিড়ে এসব বঞ্চনাও পেছনে লেগে থাকে কৃষকের। তাই বছরের প্রথম দিনে তাঁরা চান তাঁদের দিন হোক নিষ্কণ্টক। পাহাড়জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নানা বৈশাখী আয়োজন। বর্ণিল আয়োজনে পাহাড়ে পাহাড়ে চলছে বর্ষবরণের উৎসব ‘বৈসাবি’। পুরনো বছরের দুঃখ-কষ্ট আর হতাশা পেছনে ফেলে নতুন বছরে শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের প্রত্যাশায় নদীতে ফুল ভাসিয়ে উৎসব শুরু হয়।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এসব উৎসবের মধ্যেও থাকে কৃষিনির্ভর জীবন -ব্যবস্থার সুর। বিশেষ করে বৈশাখী ফসল ও চাষের সমৃদ্ধিকে তাঁরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জুড়ে এখনো বইছে উৎসবের হিল্লোল। বৈসাবি, চৈত্রসংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ- নাম যা-ই হোক, উৎসবের রঙে সেজেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। সর্বত্রই যেন উৎসবের আমেজ।

সারা দেশেই পয়লা বৈশাখ এখন অন্য রকম রঙিন দিন। শিশু-কিশোর থেকে তরুণ-তরুণী, বয়োবৃদ্ধও নতুন পোশাক পরে দিনটি উদযাপন করেন। আমাদের আর্থিক উন্নয়নের প্রতীকই বহন করছে এসব।

বৈশাখকে আমরা যেভাবেই উদযাপন করতে চাই না কেন, বাংলার আদি রূপ কিন্তু জড়িয়ে থাকে ফসলে। গ্রামীণ জীবনের প্রতিটি অনুষঙ্গে। ফসলের সমৃদ্ধি ও ভালো ফলনে। এখন সারাটি বছর কৃষি সাফল্যের একটি জয়গান চলতেই থাকে কোথাও না কোথাও। সেগুলোর সঙ্গেও মিশে থাকে আমাদের ঋতুবৈচিত্র্য, আমাদের বাংলা বর্ষপঞ্জি, দিন, তারিখের হিসাব। এর মধ্যেই মিশে থাকে বাঙালির আদি চেতনা।

গ্রাম বাংলায় বাংলা বর্ষের শেষ আর শুরু ঘিরে আগের মতো হালখাতার আয়োজন এখন নেই বললেই চলে। তার পরও বাঙালির ব্যবসায়ীর রীতি মেনে গ্রামাঞ্চলের কোথাও কোথাও পুরনো বছরের হিসাবের খাতা পাল্টে নতুন খাতা খোলার রীতিটি রয়ে গেছে। সে উপলক্ষে মিষ্টিমুখ ও আনন্দ আয়োজনের ব্যবস্থা করেন ব্যবসায়ীরা।

পয়লা বৈশাখ ঘিরে কারুপণ্যের একটা বড় বাণিজ্য গড়ে উঠেছে। এটি গ্রামের মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করছে। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গেও রঙিন হয়ে জড়িয়ে আছে এসব কর্মকান্ড। অন্যদিকে নগরে বৈশাখ এসেছে অন্য এক আনন্দপ্রভা নিয়ে। এখানে শিল্পসামগ্রী আর বাণিজ্যিক তৎপরতাই সবচেয়ে বড়। ঢাকায় চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান আয়োজন এখন নগরবাসীর বৈশাখী আয়োজনের অপরিহার্য অংশ। এর বাইরে নগরে বৈশাখ সেজেগুজে আসে বাহারি পোশাকে, ব্যবহার্য পণ্যে, খাদ্যের বাহুল্যের ভিতর দিয়ে। বৈশাখের আমেজ নিয়ে পোশাক আর শিল্প সামগ্রীর প্রস্তুতি নিতে থাকেন ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা ও শিল্প কারিগররা। এ শিল্পের বিকাশে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। গ্রামের কোনো অখ্যাত তরুণী হয়তো সুঁই দিয়ে ফুঁড়ছে অনন্য নকশি। যার প্রভা ছড়িয়ে পড়ছে শহরের অন্য তরুণ-তরুণীর ভিতর। পয়লা বৈশাখের এ উৎসব, আমেজ মূলত গ্রাম ও শহরের সেতু রচনাকারী।

বাংলা নববর্ষে সারা বিশ্বের বাঙালির প্রতি শুভেচ্ছা জানাই। শুভেচ্ছা জানাই অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের প্রতিও। বিশেষ করে গ্রামীণ কৃষিজীবী জনগোষ্ঠী যাঁরা সবুজের আয়োজন আর ফলফসলের সমৃদ্ধির পেছনে ভূমিকা রেখে চলেছেন তাঁদের জন্য বাংলা নববর্ষের উষ্ণ শুভেচ্ছা জানাই। নতুন বাংলা সন সবার জন্য হোক সমৃদ্ধি আর কল্যাণের।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর